জীবনের মণিকোঠায় প্রাণের জগন্নাথ
অনন্য প্রতীক রাউত
জীবনের মণিকোঠায় প্রাণের জগন্নাথ
দীর্ঘ এক যুগের শিক্ষাজীবনের পরিসমাপ্তির পরে সূচনা হয় অবাধ স্বাধীনতাময় উচ্চশিক্ষা জীবনের। যে জীবন মানুষকে করে আত্ননির্ভর, দূর করে পরাবলম্বনতা পাশাপাশি সৃষ্টি করে বৈচিত্র্যময়তা। যেখানে ক্লাস রুম কেন্দ্রিক সম্পর্ক বা মেলামেশা কিংবা বইপত্রে ডুবে থাকার চেয়ে সবার কাছেই প্রাধান্য পায় ক্যাম্পাসের সাথে সংশ্লিষ্ট বিষয়। ক্লাস রুমের বাইরে জীবনবোধ তৈরীর অন্যতম উপায় হিসেবে কমবেশী সবাই বেছে নেয় ক্যাম্পাস আড্ডাকে। যা জীবনের রূপ-রস বা লাবন্য যেমন বাড়ায় তেমনী সমৃদ্ধ করে জানার পরিধি বা ভান্ডারকে। হয়তো গদমুখস্ত লেখাপড়া জানা যায় না আড্ডায় তবে সেখানে ফুটে উঠে বাস্তব জীবনের চিরায়ত রূপ। সংকীর্ণতাকে পিছনে ফেলে মনকে করে যা শাণিত।
খুব ভোরে মধুর ঘুমকে বিসর্জন দিয়ে জোর করে উঠে কোনমতে রেডি হয়ে বাস ধরা বা হল থেকে বেরিয়ে দৌড়ে ক্লাসে যাওয়ার মতো অবস্থা যার যে জীবনে নেই সে অনেককিছু থেকেই বঞ্চিত নিঃসন্দেহে। ক্যাম্পাসের কোলাহলময় একেকটি চত্বরে যেন মিশে থাকে একেক রকম নতুনত্বের ছোঁয়া। কেউ ধোঁয়া উঠা চায়ের কাপে দিচ্ছে চুমুক, সাথে চলছে অবিরাম আড্ডা, কেউবা গাইছে গান কিংবা কেউ প্রিয়তমার হাতে হাত রেখে স্বপ্ন বুনছে জীবনের।
কারো ভালোবাসার বা ভালালাগার হচ্ছে সমাপ্তি, কারো বা শুরু। কখনো চলছে জ্বালাময়ী মিছিলের সংগ্রামী শোডাউন। যেখানে একদিকে তৈরী হয় নেতৃত্বের ভিত্তি অন্যদিকে সৃষ্টি হয় হাজারো তরুণের সংগ্রাম বা আদর্শ কেন্দ্রিক ঝরে পড়ার বেদনাময়ী গল্প। ভালো মন্দের দোলাচলেই যেন লেগে থাকে ক্যাম্পাস জীবনের স্মৃতিগুলো। সচরাচর এসব দৃশ্যপট দেশের বেশীরভাগ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েই লক্ষ্য করা যায়। ক্যাম্পাসের গল্পগুলো অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অভিন্ন। সেই ধারাবাহিকতায় পিছিয়ে নেই প্রাণের বিদ্যাপীঠ ঐতিহ্যবাহী জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়৷ নানান স্বল্পতার মাঝেও যেখানে গড়ে উঠে প্রাণের বন্ধণ, সৃষ্টি হয় অবিরাম ভালোবাসার।
ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকে কিংবা পড়ন্ত বিকালে ক্যাম্পাসে ফুটে ওঠে এক দারুণ প্রতিচ্ছবি। প্রতিদিন নিয়মিত আড্ডা জমে বিশ্ববিদ্যালয়ের শান্ত চত্বর, ভাস্কর্য চত্বর, শহীদ মিনার, মাসুক চত্বর (ভিসি ভবনের পিছনে) এমসিজে চত্বর, অসহায় চত্বর, কাঁঠালতলা, ক্যাফেটেরিয়া, বিড়ি চত্বর, লাইব্রেরি ও টিএসসির চায়ের দোকানগুলোতে। দলবেঁধে আড্ডা আর খুনসুটিতে মত্ত হয়ে ওঠে রক্তের বাঁধন না থাকার পরেও নিজেদের অতিআপন ভাবা জবিয়ানরা। হাসি-খুশি, মায়া জড়ানো আড্ডাতে উঠে আসে অনেক কিছুই। আড্ডা ব্যতীত ক্যাম্পাসে কাটানো মুহূর্ত অসাড় হয়ে যায়। ক্লাসের ফাঁকে কাঁঠাল তলার সামনে জমে ওঠে ক্রিকেট ও ফুটবলের মত খেলার আসর।
বিনোদনের অন্যতম অনুষঙ্গ গান-বাজনায় মেতে ওঠে সন্ধ্যার ক্যাম্পাস। টিএসসিতে বসে চায়ের আড্ডায় গিটার, হারমোনিয়াম নিয়ে জমে ওঠে আড্ডা। কত সুর-বেসুরা কণ্ঠ গেয়ে ওঠে গান, জমিয়ে তোলে রসিকতা। এর সাথে জড়িয়ে থাকে কত অজানা স্মৃতি, কত অজানা অধ্যায়। অনেকের হয়তো পারিবারিক সামর্থ্যহীনতায় পড়ালেখা হুমকির মুখে, কেউ প্রিয়জনের কাছ থেকে পাওয়া ব্যাথায় ভারাক্রান্ত, কেউবা পড়াশোনাকে অবহেলা করায় পরীক্ষা কেন্দ্রিক চাপে বিষাদগ্রস্হ।
তবুও সবাই এক ছাতার তলায় মানে ক্যাম্পাসে বসে আনন্দে মেতে উঠে বিষাদগ্রস্হতাকে দূরে ঠেলতে কিংবা সাময়িক আনন্দ তথা একটুখানি তৃপ্তির খোঁজে। প্রথাগত ভাবেই জানুয়ারি ২০২০ এ আমি বা আমরা (প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীরা) লোকমুখে শোনা ক্যাম্পাসের বাস্তব আনন্দ উপভোগের সুযোগ লাভ করি। দীর্ঘদিনের বোনা স্বপ্নের পর যা ছিল পরিপূর্ণ এক সফলতা। স্বাভাবিক ভাবেই মধুর ঘুম বিসর্জন দিয়ে শুরু হতো দিন, দৌড়ে ক্লাসের ঠিক দু-মিনিট আগে হতভম্ব হয়ে ঢুকতাম, কখনো একটু দেরী হলে শুনতাম স্যারদের ধমক।
এই ছেলে কি এত কাজ কর যে ক্লাসে আসতে দেরী হয়? শুরু হতো ক্লাস -স্যাররা পড়াতেন অবিরাম, আমরা ব্যাকবেঞ্চে দুষ্টুমি বা লুকুচুরি আড্ডায় থাকতাম মত্ত। ক্যাম্পাসে ছুটে চলতাম বুক ফুলিয়ে, থাকতো র্যাগের ভয় ! তবে, সৌভাগ্য র্যাগের নামে অমানবিক বা নিষ্ঠুর অত্যাচার পেতে হয়নি জবির প্রফুল্ল প্রস্ফুটিত প্রান্তরে। বাস্তবিক ভাবে সবচেয়ে বড় শিক্ষা পেয়েছি “জবিয়ানিজম ” কে ধারণ করার মধ্যে দিয়ে। এ বন্ধন সারাজীবনের, তুমি বা আপনি আমার আপন ভাই নও, নেই রক্তের বন্ধন তবুও আছি সর্বোচ্চ টা দিয়ে সবসময়। চলছিল সবটাই ঠিকঠাক হঠাৎ নেমে এলো আধারের কালো ছায়া বৈশ্বিক মহামারী করোনা।
প্রাণ চাঞ্চল্যময় ক্যাম্পাসকে করলো জনশূন্য, পরিবেশকে করলো নিস্তব্ধ। নিজের পায়ে দাঁড়ানোর অভিপ্রায় থেকে জীবনযুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া অনেক জবিয়ান হলো নিরুপায়, হাত হলো অর্থাভাবে শূন্য। এগিয়ে আসলেন “জবিয়ানিজম” বোধকে অন্তরে ধারণ করা অতি-আপন শ্রদ্ধেয় অগ্রজরা। উপহার হিসেবে দিলেন নিজেদের কষ্টে অর্জিত সাড়ে ৫ লক্ষ টাকার মতো। শত কষ্ট বা ক্লান্তিময় সময় জগন্নাথে পার করলেও সবাই যেন চেয়ে আছে সেই ব্যস্তময় নগরীতে কোলাহলপূর্ণ পরিবেশে ফিরে যাবার প্রয়াসে। বন্ধুদের সাথে সামান্য যোগাযোগেই বুঝা যায় সেই আকুতি কতোটা তীব্রতর। এই বিরূপ পরিস্থিতি একদিকে যেমন উল্টে দিয়েছি সোনালী সময়ের সমস্ত সমীকরণ তেমনী সৃষ্টি করেছে প্রিয় বিদ্যাপীঠের প্রতি আঘাত ভালোবাসার।
হাহাকার ভুলে সবাই মরিয়া মেছের পাতলা ডাল একটিবার খাওয়ার জন্য। মায়ের সিগ্ধ হাতের সুমিষ্ট রান্নার মতো হয়তো সুস্বাদু নয় সেই আলু-ভর্তা, ডাল-ভাত। তবে শত আকুলতা বা পরিপূর্ণভাবে খেতে না পারার কষ্ট অব্দি হার মানে শুধুমাত্র ভালোবাসার প্রয়াসে, জীবনযুদ্ধে টিকে থাকার প্রয়োজনে। কথায় আছে প্রয়োজনে পড়লে মানুষ সবকিছু করতে বাধ্য হয়। তেমনি জবির মেছে থাকা সবার জন্য বাস্তব সেকথা নিখুঁতভাবে।
অন্যজীবনে এভাবে পথ চলা কেউ মনে কষ্ট পুষে রাখলেও রাখে না জবিয়ানরা৷ তাঁরা জানে জীবন মানে যুদ্ধ, লড়তে হবে সংগ্রাম করে ভয়কে জয় করে দৃঢ়তার সাথে। যদি কেউ বলে তোমরাই তো চেয়েছিলে ধকলময় জীবনের পরিসমাপ্তি। মানে ক্লান্তিময় দিনশেষে বড় ভাই বা আপুদের বলতাম আর পারছি না। দরকার একটা বিরতির। অনেকটা অস্থির হয়ে গিয়েছি প্যারায়(বিরক্তি, বর্তমান সময়কার প্রজন্মের কাছে যা “প্যারা” বলে পরিচিত)। উত্তর সোজা বাংলায় “হ্যাঁ “তবে –
“টানা ৫ দিনের ধকলময় ক্লাস শরীরের ক্ষয় করালেও মনের পূর্নতা বাড়িয়েছে অজানা ভাবে সবসময়। বিশ্রাম কিংবা পুঁথিগত বিদ্যার বাইরে ছুটি চাইতাম সবসময় তবে এমন ছুটি নয় যা জীবনে এনে দেবে তীব্র অনিশ্চয়তা “….!
শুভ কামনা সকলের তরে। দেখা হবে প্রাণের ক্যাম্পাসে হাজারো বন্ধু তথা ভাতৃদ্বয়ের ভীড়ে। ভালো ও সুস্থ থাকুন। করোনা হোক পদানত জীবন হোক আলোকিত।
অনন্য প্রতীক রাউত
শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ (২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষ)।জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।