আত্মহত্যা কি পাপ!

জাকিয়া তাসনীম মুন।

আত্মহত্যা বা আত্মহনন হলো কোনো ব্যক্তির নিজের হাতে নিজের মৃত্যু সংঘটিত করার প্রক্রিয়াবিশেষ। এর ইংরেজি প্রতিশব্দ হলো সুইসাইড (suicide)  যার উৎপত্তি ল্যাটিন শব্দ ‘সুই সেইডেয়ার’ থেকে। আত্মহত্যা পাপ কিনা তা নিয়ে বিতর্ক বহুদিনের।

অনেক ধর্মে আত্মহত্যাকে মহাপাপ হিসেবে গণ্য করা হয়। ইতিহাস ঘাটলে এ নিয়ে অনেক তথ্যই পাওয়া যায়। ৪৫২ সালে ইউরোপে খ্রিস্টান কমিউনিটিতে Arles এর কাউন্সিলে আত্মহত্যাকে শয়তানের কাজ হিসেবে নিন্দা করা হয়েছিল।

ফ্রান্সের রাজা লুই চতুর্দশ ১৬৭০ সালে একটি ফৌজদারি অধ্যাদেশ জারি করেছিলেন,যা একজন আত্মহত্যাকারীর জন্য চুড়ান্ত অপমানজনক এবং জঘন্য। এমনকি সময়ের জন্যও এটি খারাপ ছিল। অধ্যাদেশ মোতাবেক, মৃত ব্যক্তির শরীরটি রাস্তায় টেনে আনা হত,এরপর মাথা নিচু করে আবর্জনা দিয়ে পুরো দেহ আবৃত করা হত। এরপর ব্যক্তির সমস্ত সম্পত্তি জব্দ করা হতো।

পূর্বে যেমন ছিল,বর্তমান সময়েও আত্মহত্যার প্রবণতা কিন্তু পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়নি। এখনো প্রতিবছর প্রায় দশ লক্ষ মানুষ কোনো না কারণে আত্মহত্যা করেন। কিছু সাধারণ কারণগুলোর মধ্যে আছে প্রেমজনিত ব্যর্থতা, পারিবারিক অশান্তি, কোনোকাজে ব্যর্থতা, ধর্ষণের লজ্জা থেকে মুক্তি পাওয়া, শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন ও মাদকাসক্তি। এছাড়াও পূর্বে গ্ল্যাডিয়েটর খেলায় অংশগ্রহণকারী স্বেচ্ছাসেবকরা একপ্রকার আত্মহত্যা করত। নারীদের থেকে পুরুষদের আত্মহত্যা করার প্রবণতা তিন-চার গুণ বেশি।

যুগে যুগে মানুষ এই আত্মহত্যার যৌক্তিকতা খুঁজে বেরিয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে, আত্মহত্যা কি সাহসিকতার কাজ? এটি নিয়ে পক্ষে বিপক্ষে নানা তর্ক বিতর্ক আছে। অনেকে আবার সুইসাইড এর আগে কমিট ব্যবহার করতেও নারাজ। কেননা আত্মহত্যা মানুষ নিজে সম্পাদন করে-এটি নৈতিকতাবিরোধী। কিন্তু কমিট (commit)  শব্দটির সাথে কোনো ভুল অর্থ জড়িয়ে নেই, এটি দ্বারা পূর্বপরিকল্পিত কিছু বোঝায়। অপরপক্ষে, আত্মহত্যা চিকিৎসাশাস্ত্রে মানসিক অবসাদের চুড়ান্ত রূপ হিসেবে পরিগণিত হয়-এটি পূর্বপরিকল্পিত নয়।

যাইহোক, আত্মহত্যা সাহসিকতা না ভীরুতা এনিয়ে বলছিলাম। ১৭৭৭ প্রবন্ধে ডেভিড হিউম জিজ্ঞেস করেছিলেন, “কেন আমি একটি করুণ অস্তিত্বকে দীর্ঘায়িত করবো?যাতে কিছু অসার সুবিধা যা জনসাধারণ হয়তো আমার কাছ থেকে গ্রহণ করতে পারে?”

এ প্রসঙ্গে আমার নিজস্ব অভিমত এখন আমি তুলে ধরব। এ প্রসঙ্গে Allan Rufus এর একটি উক্তি আমি তুলে ধরছি-
“Life is like a game of chess. To win you have to make a move. Knowing which move to make comes with IN-SIGHT and knowledge, and by learning the lessions that are acculated along the way.
We become each and every piece within the game called life!”

অর্থাৎ জীবন কুসুমাস্তীর্ণ নয়। জীবনে উত্থান এবং পতন দুটোই আছে। জীবন দাবাখেলার মতো, যেখানে হার ও আছে, জিত ও আছে। অথবা জীবনকে একটি কয়েনের সাথে তুলনা করা যায়, যার একপাশে থাকে প্রাপ্তি আর পূর্ণতা, অপরপাশে থাকে অপ্রাপ্তি আর অপূর্ণতা। দুটো সাথে নিয়েই আমাদের চলতে হয়। জীবন হলো স্রষ্টার দেওয়া একটা মূল্যবান উপহার। অন্যের জন্য না হোক, নিজের জন্যই আমাদের এই অমূল্য উপহারটির যথাযথ ব্যবহার করা উচিত। এইখানে আমি আমার দেখা কিছু বাস্তব উদাহরণ দেখাচ্ছিঃ

ঘটনা-১: মেয়েটির বাবা মা অত্যন্ত কঠিন শাসনে মেয়েকে মানুষ করেছে। অন্তত মেয়েটির মা মেয়েটিকে কখনো বোঝার চেষ্টা করেনি। ছোটবেলায় ও কিশোর বয়সে মেয়েটি তার গৃহশিক্ষক, প্রতিবেশী ও কাজিনের কাছে যৌন হয়রানির শিকার হয়। কিন্তু সে এটা প্রকাশ করতে পারেনি। স্কুলজীবনে তাঁর উল্লেখযোগ্য কোনো বন্ধু ছিল না। এমনকি প্রেমের ক্ষেত্রেও বিশ্বাসঘাতকতার শিকার হয়েছে মেয়েটি। এরপরেও মেয়েটি আত্মহত্যার কথা ভাবেনি। কারণ ছিল তার পড়াশোনা, বইয়ের প্রতি ভালোবাসা। তার মতে, সবাই তাকে ছেড়ে গেলেও বই তাকে কখনো ছেড়ে যায়নি, যাবেও না। বই আছে বলেই সে জীবনকে ভালোবাসে। বইই তার জীবনের প্রাপ্তি।

Post MIddle

ঘটনা-২: ছেলেটির যখন বোঝার বয়স হয়, তখন সে দেখে তার বাবা মা আলাদা বাস করছে। তার বাড়ির কাজের বুয়ার কাছে সে অমানবিকভাবে নির্যাতিত হয়। ছেলে হয়েও যৌন হয়রানির শিকার হয়। সেও কারো সাথে মিশতো না। একা একা থাকতো। কিন্তু জীবনকে সে ভালোবাসে। সে মুদ্রার অপর পিঠ ও দেখতে চায়। তাই সে বেরিয়ে আসে হতাশা ও একাকীত্ব থেকে।

উপরের দুইটি ঘটনায় ছেলেটি ও মেয়েটি কম কষ্ট ভোগ করেনি। কিন্তু তারা কেউ আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়নি। তারা সামনে থেকে নিজেদের প্রতিকূলতাকে মোকাবেলা করেছে, নিজেদের শান্তি ও সুখের উৎস খুঁজে নিয়েছে।

“The bravest thing I ever did was continuing my life when I wanted to die.”
-Juliette Lewis

হ্যাঁ,নিজের সমস্যা সামনে থেকে মোকাবিলা করার মত সাহসিকতা আর কোনো কিছুতে নেই। আর এজন্য দরকার তিনটি জিনিস-

১.নিজের জন্য ভালোবাসা।
২.মানসিক সামর্থ্য। নিজেকে ভালোবাসলে এই সামর্থ্য মানুষ এমনিই অর্জন করে।
৩.অবিরাম ধৈর্য।

এই তিনটি জিনিস থাকলে মানুষ যেকোনো ব্যর্থতাকে কাটিয়ে উঠতে পারে;যেকোনো সমস্যাকে মানুষ সমাধান করতে পারে। সে নিজেকে এমনভাবে গড়ে তুলতে পারে যাতে অন্যকেউ তার সুবিধা নিতে না পারে। অপরপক্ষে, যার এই তিনটি গুণ থাকে না, সে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা না করে সেখান থেকে পালিয়ে আসতে চায়। অবশেষে জীবনকে দোষারোপ করে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। সমস্যা থেকে পালিয়ে আসা তো কোন সাহসিকতা নয়। বরং এটি ভীরুতারই লক্ষণ।

অতএব জীবনকে ভালোবেসে, নিজেদের জন্যই আমরা জীবনকে এগিয়ে নিয়ে যাব। স্রষ্টার উপর একটু ভরসা করতে শিখব, নিজেদের সমস্যার মুখোমুখি হতে জানব, আর দিনশেষে চোখের পানি নয়, ঠোঁটের একচিলতে হাসি নিয়ে ঘুমুতে যাব।

যেরকম Allan Rufus ও বলেছেন-
“Life is like a sandwitch.
Birth as one slice,
and death is the other.
What you put in between the slices is up to you.
So, is your sandwich tasty? Or sour?”

 

জাকিয়া তাসনীম মুন

ডিপার্টমেন্ট:মাইক্রোবায়োলজি।ব্যাচ:১৫তম।মেধা:১৭৭১।জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।

পছন্দের আরো পোস্ট