ঐতিহ্য হবে অর্থনৈতিক শক্তির চাবিকাঠি

মাহবুব পারভেজ

সেবাখাতে আমাদের অর্থনীতি দুর্বল, কেন ? আমরা কি সেবা পরায়ন জাতি না? নাকি আমরা অতিথিদের আপ্যায়ন করিনা। অথবা অন্যকে সেবা দিলে কি আমি ছোট হয়ে যাব? মানুষ থেকে মানুষে স্থানান্তরিত সেবায় আমাদের সমকক্ষ পৃথিবীতে কোন জাতি আছে বলে আমার জানা নেই।

আমরা সেই জাতি যে জাতির যে কোন ঘরে এক গ্লাস পানি চাইলে শুধু পানি সেখানে মিলবে না, তার সঙ্গে এক মুঠো মুড়ি কিংবা এক টুকরো গুড়ও মিলবে। আমরা সেই জাতি যে জাতি মনে করে অতিথি ঘরের লক্ষী। আমরা সেই জাতি যে জাতির মা বোনেরা সমস্ত দিনের রান্নার ক্লান্তি দূর করে অতিথির প্রসন্ন ভোজন দেখে কিংবা তার হাসিমুখের এক টুকরো প্রসংশায়। অতিথিসেবা, খাওয়ানো, রান্না এবং তার সুগন্ধ বাড়ি বাড়ি না ছড়ালে আমাদের মনোবাসনা পূর্ন হয়না, তৃপ্তি আসেনা আপ্যায়নে।

সম্ভবত এই কারনেই জাতি হিসেবে আমরা এখনো বুঝে উঠতে পারিনি রন্ধন, সেবা এবং অতিথিসেবা অর্থ উপার্জনের মাধ্যম হতে পারে, অবদান রাখতে পারে দেশের অর্থনীতিতে। অতিথি এবং সেবা বাংলাদেশের মানুষের রক্তের সাথে মিশে আছে। মিশে আছে বলেই তাতে আবেগ যতটা বেশী ঠিক উল্টোভাবে পেশাদারি মনোভাব ততটাই কম।

বাংলাদেশের প্রাথমিক অর্থনীতি কৃষি নির্ভর। ক্ষেতের ফসল আর নদীর মাছ নির্ভর জীবন ব্যবস্থায় অবস্থান করার পর ও বাংলাদেশ থেমে থাকেনি। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের জনসংখ্যা বেড়েছে প্রায় দ্বিগুন। চাষযোগ্য আবাদী জমির পরিমান কমেছে, কমেছে হাওড়, বিল নদী, কিংবা খালের সংখ্যা। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে বেড়েছে কৃষি উৎপাদন। একই জমিতে বছরে তিনবার ফসল ফলে। সত্যিকার অর্থে কমেছে আবাদী জমির পরিমান, বেড়েছে জনসংখ্যা। কিন্তু বাংলাদেশের বিজ্ঞানীদের অভূতপূর্ব সাফল্যে আশ্চর্যজনকভাবে স্বাধীনতা উত্তর বর্তমান বাংলাদেশের খাদ্য উৎপাদন বেড়েছে ৩ গুন। বাংলাদেশ এখন সব্জী রপ্তানীতে এবং মিঠা পানির মাছ চাষ ও রপ্তানিতে পৃথিবীর প্রথম ১০ টি দেশের মধ্যে অবস্থান করছে।

বাংলাদেশ সৃষ্টির প্রথম থেকেই সোনালী পণ্য হিসাবে পাট ছিল বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের হাতিয়ার। তবে তা কাঁচাপাট, পাটজাত পণ্য নয়। অর্থাৎ তা জড়িত ছিল প্রাথমিক অর্থনীতির সাথে। দিন বদলায় এবং আমরা বড় হতে থাকি, স্বাবলম্বী হতে থাকি। আমাদের ময়ুরপঙ্খী নাও প্রাথমিক অর্থনীতি থেকে পা রাখে মাধ্যমিক অর্থনীতির দোরগোড়ায়। বর্ধিত জনসংখ্যা আশির্বাদ হিসাবে এগিয়ে আসে পরিশ্রমে। কাপড় থেকে শার্ট, প্যান্ট, চামড়া থেকে জুতা, কিংবা ক্লিংকার থেকে সিমেন্টসহ আরো নানা পন্য তৈরীতেও।

আশ্চর্যের বিষয় হল এগুলোর ব্যবহারের উপর ভিত্তি করে যে পণ্যসমূহ বাংলাদেশের মাধ্যমিক অর্থনীতিকে সবল করেছে তার পেছনের কোন কাঁচামালই দেশে উৎপাদিত নয়। মুলত এই অর্থনীতির মূল মেরুদন্ড শ্রমশক্তি। ধীরে ধীরে শ্রমশক্তি রুপান্তরিত হচ্ছে, পরিবর্তিত হচ্ছে, পরিবর্ধন হচ্ছে। দেশের বাইরে ব্যাপকভাবে আলোড়িত করছে শ্রমবাজার।

আমাদের ব্যাপক সম্ভাবনা থাকার পর ও যে জায়গায় আমরা পিছিয়ে আছি তা সেবাখাত বা আক্ষরিক অর্থে পর্যটনখাত। এমন না যে, এই ক্ষেত্রে আমাদের ইচ্ছা নেই বা যোগ্যতা নেই। আমরা এখনো আমাদের চিরায়ত স্বভাব সুলভ সেবা দিয়ে মানসিক আনন্দ পাই এবং অতিথীকে আপ্যায়ন করে আনন্দিত হই। আমাদের এই জায়গা দখল করতে পারেনি অর্থনীতির সবল উপস্থিতি, তৈরী করতে পারেনি ক্ষেত্র। জীবিকা নির্বাহের জন্য সেবা জাতি হিসাবে বাংলাদেশের মানুষের চিন্তার সঙ্গে সামঞ্জস্য নয়। কর্মঠজাতি হিসাবে আমাদের উপস্থিতি সংগ্রামে, শক্তিতে, মেধায় এবং কায়িক পরিশ্রমে।

১৯১১ সালে বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দাতে বাংলাদেশ প্রভাবিত না হবার অনেকগুলো কারনের মধ্যে এই শক্তি বা আত্মকেন্দ্রিকতা কিছুটা হলেও কাজ করেছিল। কিন্তু বর্তমান মুক্তবাজার অর্থনীতিতে টিকে থাকতে হলে সেবাকে বেছে নিতে হবে অনন্য হাতিয়ার হিসাবে। মাধ্যমিক অর্থনিতির মতো ক্ষেত্র তৈরি হবে আপন মনে। নিজের পথ ধরে পর্যটন শিল্পে উন্নয়ন ছাড়া অনিশ্চিত বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ।

পৃথিবীর যে সমস্ত দেশ অর্থনীতিতে দ্রুত অর্থনৈতিক সাফল্য লাভ করেছে তাদের পেছনে পর্যটন জোরালোভাবে কাজ করেছে। এমনকি নেপাল সম্পূর্ন পর্যটনের উপর নির্ভরশীল, মালোয়েশিয়ার অর্থনীতির ভিত্তি দৃঢ় হয়েছে পর্যটনকে কেন্দ্র করে। পর্যটন সম্ভাবনার বিচারে বাংলাদেশ কে বলা হয় ইউনিক ডেল্টা অব সেভেন টিএ (7ta or Seven Tourist  Attraction) ।

Post MIddle

এই সেভেন টিএ হচ্ছে নদী, সমুদ্র, পাহাড়, বন, ইতিহাস-ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, ঋতু-বৈচিত্র এবং আতিথেয়তা। অর্থাৎ কোন স্থানে বা কোন দেশে এই সেভেন টিএ এর একটি উপস্থিত থাকে তাকে পর্যটনের জন্য বলা হয় Good যদি দুটি থাকে তাকে বলা হয় Better আর দুই এর অধিক থাকলে Best ।

আমাদের অবস্থান বেস্টের ও অনেক উপরে। 7TA এর একটি আতিথিয়তা বা Hospitality। যদিও আমরা মানসিকিতায় অতিথি পরায়নজাতি, তথাপি আমাদের শিক্ষার অভাব আছে, অভাব আছে পরিবেশনায় এবং তৈরী প্রক্রিয়াতে। আমাদের ভালোবাসার বা আন্তরিকতার কোন অভাব নেই। এই তৈরীর প্রক্রিয়া এবং পরিবেশনার জায়গাটিতে আমাদের কাজ করারও অবকাশ রয়েছে। কেননা আমাদের সময় হয়েছে সেবা বিক্রির এবং অর্থনৈতিক উন্নতির।

যে ফাঁক বা শুন্যস্থানটি আমরা ধরতে পেরেছি আমাদের চিন্তা এবং উপরোক্ত আলোচনার মাধ্যমে তা পূরণ করা একান্ত প্রয়োজন। প্রয়োজন সমন্বয়ের, সহযোগিতার এবং সাহসিকতার। সমন্বিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে আতিথেয়তার এই অভাবটুকু পূরণ করতে পারলেই বাংলাদেশসহ পৃথিবীর অন্যান্য দেশে আমাদের লোকবল হবে আরো শক্তিশালী এবং প্রয়োজনীয় ও গুরুত্বপূর্ন।

আমরা ড্যাফোডিল ইন্টারনেশনাল ইউনিভারসিটি সমন্বয় করতে চাই, এ জন্য একত্রিত হয়েছি অক্সফোর্ড কালচারাল কালেকটিভ এর সাথে। এই লক্ষ্যে একটি সেন্টার তৈরী হবে যার নাম হবে‘ ড্যাফোডিল অক্সফোর্ড সেন্টার অব এক্সিলেন্স ফর হসপিটালিটি’। পর্যটন বিষয়ের শুধু আতিথেয়তাকে কেন্দ্র করে তা জানা, শেখা, প্রয়োগ এবং তা দ্বারা কিভাবে বিশ্ব জয় করা যায় তাই হবে এই সেন্টারের কার্যক্রম।

আমাদের জনশক্তি আছে, আছে দেশের প্রতি ভালোবাসা। প্রয়োজন শুধু জানা সঠিকভাবে পরিবেশনা এবং খাদ্য তৈরীর প্রক্রিয়া। সেবা খাতেই এই দিক দিয়েও আমরা হতে চাই উন্নত এবং আধুনিক। আমাদের জনশক্তিকে বানাতে চাই জনসম্পদে। বর্তমানে এই সেন্টারের নাম ঠিক করা হয়েছে ড্যাফোডিল অক্সফোর্ড সেন্টার অব এক্সিলেন্স ফর হসপিটালিটি (DOCEH) । এর মূল উদ্দেশ্য হল কলিনারি আটর্স ও হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্টে (রন্ধন সম্পর্কীয় বিজ্ঞান এবং আতিথেয়তা) আন্তর্জাতিক মানের প্রশিক্ষন দেওয়া। আসছে ১০ই সেপ্টেম্বর ড্যাফোডিল ইন্টান্যাশনাল সিম্পোজিয়াম ফর হসপিটালিটি (DISH) এর মাধ্যমে এই কার্যক্রমের উদ্বোধন ঘোষিত হবে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য প্রফেসর ড. এস এম মাহাবুব-উল হক ছাড়াও আমাদের সঙ্গে আছে ড্যাফোডিল ফ্যামিলির চেয়ারম্যান ডঃ মোঃ সবুর খান, ড্যাফোডিল পরিবারের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ নুরুজ্জামান, অক্সফোর্ড কালচারাল কালেকটিভের চেয়ারম্যান ও অক্সফোর্ড ব্রুকস ইউনিভার্সিটির অক্সফোর্ড স্কুল অব হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্টের সাবেক প্রধান ডোনাল্ড স্লোয়ান এবং DOCEH এর উপদেষ্টা আজিজ রহমান।

আমাদের সাথে একত্মতা ঘোষনা করেছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর জেষ্ঠ্য উপদেষ্টা ডঃ গরহর রিজভী, বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ড এর সম্মানিত সিইও জাভেদ আহমেদ, শিক্ষাবিদ ড. সৈয়দ রাশিদুল হাসান, প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের মাননীয় মন্ত্রী ইমরান আহম্মেদ এমপি, বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশন এর চেয়ারম্যান রামচন্দ্র দাস, সাবেক রাষ্ট্রদূত ও BEI এর চেয়ারম্যান ফারুক সোবাহান।

আমাদের সমন্বিত প্রচেষ্টায় একটি শক্তিশালি আন্তর্জাতিক মানের কারিগরি জায়গায় আমরা উপনীত হতে পারবো বলে আশা করি। আমাদের শুধু জানতে হবে, শিখতে হবে। সম্পদ আমাদের আছে, শক্তি আমাদের আছে। সকলের সমবেত প্রচেষ্টায় আমরাও বিশ্বের বুকে আমাদের নাম আলাদাভাবে উজ্জ্বল করতে চাই। যা আমাদের ঐতিহ্য, তাই হবে এবার অর্থনৈতিক শক্তির চাবিকাঠি।

লেখকঃ মাহবুব পারভেজ। সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান।টুরিজম এন্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগ। ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি

পছন্দের আরো পোস্ট