ধর্ষণ প্রতিরোধে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের ভাবনা

মেহেরাবুল ইসলাম সৌদিপ, জবি প্রতিনিধিঃ

দিন দিন দেশে বেড়েই চলেছে করোনার প্রকোপ। করোনা কারণে জনজীবন যখন বিপর্যস্ত তখন যেন করোনার সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়েই চলেছে ধর্ষণের ঘটনার। এখন এমন একটা দিন খুঁজে বের করা কষ্টকর যে দিনে সারা দেশে একটাও ধর্ষণের ঘটনা ঘটে না। ধর্ষণ যেন অন্যরকম মারাত্মক সামাজিক ব্যধি হয়ে দারিয়েছে আমাদের সমাজে। কেন এই নৈতিকতার অবক্ষয়!

এমতাবস্থায় ধর্ষণ প্রতিরোধ নিয়ে কী ভাবছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা তা নিয়ে আলোচনায় এসেছেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও সাংবাদিক মেহেরাবুল ইসলাম সৌদিপ।

শেখ জাকিয়া নূর ঐশী
রসায়ন বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।

যেকোন সমস্যা প্রতিরোধের প্রথম ধাপ হচ্ছে সমস্যার মূল বা ভিত্তি খুঁজে বের করা।
ধর্ষণের মত জঘন্য অপরাধ কেনো হচ্ছে?কেনোই বা এর হার দিনদিন বেড়ে যাচ্ছে?আপনি,আমি,আমাদের পরিবার সমাজ এর জন্য কতটুকু দায়ী? খবরের কাগজে, সোশ্যাল মিডিয়া বা টিভির পর্দায় প্রতিদিন ধর্ষণের খবর দেখি,ধর্ষকের বিচারের খবর কেন দেখি না?
ধর্ষকের কঠোর শাস্তির খবর শুনে আতংকে পুরুষরূপি জানোয়ারগুলোর হাড় কেনো কেঁপে উঠে না? জন্মের পর থেকে পরিবার ও সমাজ থেকে মেয়েকে বুঝিয়ে দেওয়া হয় ‘তুমি দূর্বল’, ‘তোমাকে সাবধানে চলতে হবে নাহলে ধর্ষণের শিকার হতে হবে।’ অথচ ছেলেকে এই ব্যাপারে কোনো ধরনের শিক্ষা দেওয়ার প্রয়োজনই মনে করে না কেউ। তাই তারা নিজ থেকেই বুঝে নেয় ‘আমি সবল’, ‘সকল ক্ষমতা আমার হাতে’, ‘আমি চাইলেই একটা মেয়ের জীবন নষ্ট করতে পারি’, ‘মেয়েরা ভোগ্যপণ্য মাত্র’। বাবা-মা রা তাদের সন্তানকে ফেরেশতা মনে করলেও সবাই তো ফেরেশতা হয় না! সবাই নিজেকে সামলাতেও পারে না। ছোট থেকে শুধু সন্তানের পরীক্ষার নাম্বার নিয়ে ব্যস্ত না হয়ে, আপনার সন্তান কিভাবে বড় হচ্ছে, কেমন মানুষিকতা নিয়ে বড় হচ্ছে তা নিয়েও সচেতন থাকতে হবে। অনেক সময় ছোটবেলার কোনো তিক্ত অভিজ্ঞতা বা নির্যাতনের কারণেও তাদের মানুষিক বিকৃতি ঘটতে পারে। যার কারণে তারা আস্তে আস্তে মানুষের প্রতি সম্মান হারিয়ে ফেলে এমনকি এদের আত্মসম্মানবোধ বলেও কিছু থাকে না। এরাই একসময় ধর্ষকে পরিণত হয়। সর্বোপরি ধর্ষকের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা, পারিবারিক ভাবে নৈতিক শিক্ষা নিশ্চিত করা, মেয়েদের দূর্বল না ভেবে তাদের আত্মরক্ষার প্রশিক্ষণ দেওয়ার মাধ্যমে ধর্ষনের মতো জঘন্য অপরাধ সমাজ থেকে নির্মূল করা সম্ভব বলে আমি মনে করি। আপনি আমি সচেতন হলে হয়তো আগামী প্রজন্ম একটি সুস্থ সমাজে বেড়ে উঠার সুযোগ পাবে।

মোঃ আমিনুল ইসলাম
রসায়ন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

Post MIddle

ধর্ষণের প্রধান কারণ সামাজিক নিরাপত্তা না থাকা, বিচারহীনতা, মাদকদ্রব্য এর বিস্তার,সুশিক্ষা ও মূল্যবোধের অভাব ইত্যাদি। ধর্ষণের হার কমানোর জন্য প্রথমে আইনের থেকে ঘটনা আড়াল করার সংস্কৃতি দূর করতে হবে। অনেক কেইস আড়ালেই থেকে যায়। এ ক্ষেত্রে সংবাদমাধ্যম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। সামাজিক মাধ্যম ও এক্ষেত্রে অগ্রসর হতে পারে। অবশ্যই ভিকটিম এর পরিচয় গোপন রাখতে হবে। তবে এক্ষেত্রে অবশ্যই ভিকটিম ব্লেমিং যেন না ঘটে তা খেয়াল রাখতে হবে।কিছু ক্ষেত্রে মিথ্যা অভিযোগ এ সম্মানহানি ঘটতে পারে। এজন্য মেডিকেল রিপোর্ট, প্রশাসন সবকিছু সম্মিলিতভাবে মিলিয়ে কাজ করতে হবে। ওয়ান স্টপ মেডিকেল চেক আপ নিশ্চিত করতে হবে যা স্বচ্ছ ও সব ধরনের প্রভাবমুক্ত। খুব কম কেসেই বিচার হয়। দ্রুত বিচার নিশ্চিত করতে হবে। এজন্য আলাদা দ্রুত বিচার ট্রাইবুনাল গঠন করতে হবে।এলাকায় সালিশ বসিয়ে কিছু টাকা হাতে দিয়ে মিটমাট বন্ধ করতে হবে। সকল ঘটনা আইনী প্রক্রিয়ার আওতায় আনতে হবে। এসিড নিক্ষেপের শাস্তি মৃত্যুদন্ড এরকম করে ধর্ষণের বিষয়টিও প্রচার করতে হবে। সামাজিক প্রতিরোধ নিশ্চিত করতে হবে। গণপরিবহন ও যাতায়াতে নিরাপত্তা নিশ্চিত কর‍তে হবে।মাদকাসক্তরা এ ধরনের ক্রাইমে যুক্ত থাকে বেশি। তাই এক্ষেত্রে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে।সেই সাথে ভিকটিমের সামাজিক প্রতিষ্ঠা নিশ্চিত করতে হবে। এখনো সামাজিকভাবে অনেকে ভিকটিম হয়ে সামনে আসতে চান না।পরবর্তীতে তাদের সামাজিকভাবে হেয় হতে হয়। তারা যেকোনো অর্থনৈতিক বা সামাজিক বিষয়ে বঞ্চিত হন। সমাজ তাকে গ্রহণ করে না।এই মনোভাব পরিবর্তন হওয়া প্রয়োজন। সর্বোপরি সামাজিক মূল্যবোধ, দায়বদ্ধতা এবং কঠোর আইনি প্রয়োগ ধর্ষণের হার কমাতে ভূমিকা রাখবে বলে আমি মনে করি।

অনন্যা সাহা
আইবিএ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।

আমার মতে ধর্ষণ বলতে পুরুষের স্বেচ্ছাচারিতাকে বোঝায় যেখানে একজন নারীকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে যৌনমিলনে বাধ্য করা হয়। যৌন সন্তুষ্টির জন্য জোরপূর্বক কোনো নারীর উপর নির্যাতন করা। ধর্ষণ বিষয়টি আমাদের সমাজে নতুন না। দিন দিন মানুষ শিক্ষিত হলেও বা সমাজ এগিয়ে গেলেও ধর্ষণ নামক শব্দটি এখনো বিদায় নিচ্ছে না। গণমাধ্যম গুলো ভালো করে দেখলে প্রতিদিন ধর্ষণের খবর পাওয়া যায়। সর্বশেষ খবর অনুযায়ী, গত জুন মাসে ধর্ষণের শিকার হয়েছে মোট ১০১ জন। এর মধ্যে গণধর্ষণের শিকার হয়েছে ২৫ জন। ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৭ জনকে। ধর্ষণ নিসন্দেহে একটি অমানবিক এবং ঘৃণীয় অপরাধ। কিন্তু পুরুষতান্রিক এই সমাজে ধর্ষণের পিছনে অনেকেই দায়ি করে নারীর পোশাক এবং চলাফেরাকে। কিন্তু আমি যদি কথাটিকে পুরোপুরি সত্য বলে মেনেও নেই তাহলে বলবো আমাদের সমাজে নারীর সাথে সাথে শিশুকেও কেন ধর্ষণের শিকার হতে হয়?? পুরুষতন্ত্রের চাপে পুরুষ হারাচ্ছে তার মনুষ্যত্ব। একজন পুরুষ যখন তার অর্ধাঙ্গিনীর উপর নির্যাতন করছে বা কোনো নারীকে ধর্ষণ করছে, তার ভিতর একটি মিথ্যা অধিকারবোধ কাজ করে। এর জন্য দায়ি পুরুষতন্র। ধর্ষণ প্রতিরোধে পরিবার,সমাজ ও প্রশাসনের যেসব পদক্ষেপ নেয়া উচিত বলে আমার মনে হয়:ছোট থেকেই সন্তানদের নৈতিক শিক্ষা দেয়া। এক্ষেত্রে পারিবারিক, ধর্মীয়, সামাজিক শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। স্কুলে নৈতিক শিক্ষার বিষয় থাকলেও বাস্তবে এর প্রয়োগ নেই। শিক্ষকরা এক্ষেত্রে যথাযথ ভূমিকা পালন করতে ব্যর্থ হচ্ছে। এদিকে নজর দেওয়া এবং সঠিক যৌনশিক্ষা দেওয়া। ধর্মীয় অপব্যাখ্যা বন্ধ করা। সমাজের অনেক বড় একটা অংশ মেয়েদেরকে ভোগ্য বস্তু বলে মনে করে। আর ওজুহাত হিসেবে ব্যবহার করে ধর্মকে। একটি ধর্ম কখনোই ধর্ষণ বা ধর্ষণ সম্পর্কিত বিষয়কে প্রশয় দেয় না। কোনো পরিবার বা সমাজের বড়রা যদি মেয়েদেরকে ঠিক করে সম্মান না দেয়, এই বিষয়টি ছোটদের মধ্যে অনেক বড় একটা প্রভাব ফেলায়। তাই পরিবার ও সমাজে মেয়েদের সম্মান নিশ্চিত করা উচিত। পরিবার থেকে ছেলে-মেয়ে দেরকে সমানভাবে বড় করা যাতে করে মেয়েরা নিজেদের দুর্বল না ভাবে আর ছেলেরা কখনো স্বেচ্ছাচারী না হয়।অপসংস্কৃতি রোধ করা। ইদানিং আধুনিকার নামে অবৈধ শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন ধর্ষণের মতো অপরাধকে উৎসাহিত করে। মেয়েদের উচ্ছৃখল জীবনযাপন পরিহার করা। পোশাকে নিজের সংস্কৃতি বজায় রাখা। আইনের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করা যাতে মেয়েরা অন্যয়ের প্রতিবাদ করতে ভয় না পায়। আইনকে সঠিকভাবে প্রয়োগ করতে না পারলে অপরাধ কমানো সম্ভব না। মেয়েদের প্রতি পরিবার ও সমাজের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন আনা। আমাদের সমাজ আজও কেন জানি ছেলে-মেয়েকে সমান ভাবতে পারে না। পুরুষতান্রিক সমাজব্যবস্থার জন্য মেয়েদের সব সময় গন্ডির মধ্যে রাখার বা কতৃত্বে রাখার প্রবণতা আমাদের দেশের খুব সহজ একটা দৃশ্য। এজন্য নারীদের সাথে অন্যয় করতে পুরুষরা খুব বেশি ভাবে না।পারিবারিক কলহ, দারিদ্রতা, পরিবার থেকে ভালবাসা না পাওয়া, ক্যারিয়ার নিয়ে হতাশা, খারাপ সঙ্গ প্রভৃতি কারণে প্রতিনিয়ত সৃষ্টি হচ্ছে নতুন একটি ধর্ষকের। তাই এসব দিকে সবার লক্ষ রাখা উচিত।প্রেমের প্রস্তাবে প্রত্যাখ্যান হওয়ার বিষয়কে ছেলেরা খুব একটা সহজভাবে মেনে নেও না যার কারণে ধর্ষণের মধ্য দিয়ে তারা আত্মসন্তুষ্টির পথ খোঁজে। ছেলেদের এই ধরণের বিকৃত মানসিকতার জন্য আমি দায়ি করবো নারী-বৈষম্যকে।তথাকথিত সমাজ মেয়েদের অবাধ চলাফেরা এবং পোশাকের চেয়ে যদি ছেলেদের অন্যয়ের দিকে বেশি নজর দেয়, তাহলে হয়তো ধর্ষণের মতো অপরাধকে অনেকটা কমানো সম্ভব। পরিশেষে বলবো, ধর্ষণ রোধে সুশিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। একজন পুরুষ সবার প্রথমে একজন মানুষ। আর একজন সঠিক মানুষ কখনো পাশবিক আচরণ করতে পারে না।

রুদ্র সাহা
যন্ত্র কৌশল, রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।

আমাদের দেশে বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে কুসংস্কারের অন্ত নেই এবং এগুলো কোনো দিক বিবেচনা না করেই কয়েক যুগ ধরে অপরিবর্তনীয় হয়ে আছে। এখনো এগুলো সমাজের লোকেরা নীতি হিসেবে পালন করে। এর মধ্যে অন্যতম একটি নারী সহিংসতা। নিচু জাতি, অবলা, ভোগ সামগ্রী আরও কতো কি বলে মনে করা হয়। আর এরকম বিষয়গুলো ধর্ষণ নামক পাশবিক কাজকে উস্কে দিচ্ছে। মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সলিশ কেন্দ্র ( আসক) এর মতে, গত বছর ২০১৯ সালে ১,৪১৩ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয় এবং ২০১৮ সালে ৭৩২ জন নারী। অর্থ্যাৎ, ধর্ষণের শিকার নারীদের সংখ্যা দ্বিগুণ বেড়েছে। সবচেয়ে বড় উদ্বিগ্নের বিষয়টা হলো যে ধর্ষণের শিকার নারীদের মধ্যে ৮৬ শতাংশই শিশু ও কিশোরী। ৬ থেকে ১২ বছর শিশু- কিশোরীর সংখ্যাই বেশি। এবল দিনে দিনে ধর্ষণের শিকারও বাড়ছে। দেশে কঠোর আইন থাকলেও, সঠিকভাবে প্রয়োগ এবং বাস্তবায়ন করতে পারলে তবেই ধর্ষণকে রোধ সম্ভব। তাছাড়া এই প্রায় বিচারহীনতার পরিবেশের অবসান না ঘটলে কোনো ভাবেই ধর্ষণের প্রবণতাকে রোধ করা সম্ভব না।

পছন্দের আরো পোস্ট