ব্রিটেনের বর্ষসেরা চিকিৎসক হলেন ফারজানা
লেখাপড়া ডেস্ক।
ব্রিটেন সম্প্রতি ১২ জন বর্ষসেরা চিকিৎসকের একটি তালিকা প্রকাশ করেছে। দেশটির জাতীয় স্বাস্থ্য ব্যবস্থা এনএইচএস’র ৭২তম বর্ষপূর্তিতে করোনা মোকাবিলার দায়িত্বশীল ভূমিকার জন্য তাদের বিশেষ সম্মান দেয়া হয়েছে। সেই তালিকায় থাকা একজনের নাম ফারজানা হুসেইন। তিনি বাংলাদেশী বংশদ্ভুত। তাই তাকে নিয়ে ব্রিটেনের পাশাপাশি বাংলাদেশীরাও গর্বিত।
এনএইচএস’র ওয়েবসাইট থেকে জানা গেছে, এবারের বর্ষপূর্তি সংস্থাটি ব্যতিক্রমভাবে উদযাপন করছে। কিংবদন্তি ব্রিটিশ ফটোগ্রাফার র্যানকিনকে দিয়ে ওই ১২ চিকিৎসকের ছবি তোলানো হয়েছে। সেই ছবি দেশটির বিভিন্ন স্টপেজ এবং গুরুত্বপূর্ণ স্থানে বিলবোর্ড আকারে ঝোলানো হয়েছে।
হলিউড তারকাদের ছবি তুলে পৃথিবীজুড়ে তুমুল জনপ্রিয়তা অর্জন করা র্যানকিনের আসল নাম জন র্যানকিন ওয়াডেল। জুনের শেষ দিকে তিনি ছবিগুলো প্রকাশ করেন।
৫৪ বছর বয়সী র্যানকিন তরুণ বয়সে হাসপাতালের কর্মী ছিলেন। সেই দিনগুলোতে তিনি ভাবতেন, স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য কিছু একটা করবেন। এখন সেই সুযোগ পেয়ে বিনা মূল্যে ফারজানাদের ছবি তুলে দিয়েছেন।
এনএইচএস’র ওয়েবসাইটে ১২ জন চিকিৎসক নিজেদের গল্প লিখেছেন। সেখানে ফারজানা এভাবে নিজের ‘লড়াইয়ের ইতিহাস’ তুলে ধরেছেন, ‘১৯ বছর বয়সে আমার মা হার্টফেল করেন। ওই সময় মেডিক্যাল স্কুলে আমার প্রথম টার্ম ছিল। আমি মাকে দেখতে ২৫৯ মাইল পাড়ি দিয়ে হাসপাতালে যেতাম’।
‘বুঝতাম না মেডিক্যালে ফেরা হবে কি না। কিন্তু মা বলতেন, ‘তোমাকে যেতেই হবে। তোমাকে আমি ডাক্তার হিসেবে দেখতে চাই।’ মা পাঁচদিন পর মারা যান।
‘প্রায় দুই দশক পর নিজেকে যে কতটা সৌভাগ্যবতী মনে হয়, তা বলে বোঝাতে পারবো না। রোগীদের মুখের দিকে তাকালে মনে হয়, তারাও কোনো পরিবারের।’
গত কয়েক দিন ধরে দেশের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এই ফারজানাকে অনেকে ‘বাংলাদেশী’ বলে পরিচয় করাচ্ছেন।
তার বাড়ি বাংলাদেশের কোথায় সেটি এনএইচএস’র ওয়েবসাইট থেকে জানা যায়নি। পেশাজীবীদের সামাজিক যোগাযোগের ওয়েবসাইট লিঙ্কডইন কিংবা তার টুইটার অ্যাকাউন্টে এ বিষয়ে বিস্তারিত কিছু লেখা নেই।
দুদিন আগে ব্রিটেনের সাপ্তাহিক পত্রিকা ইস্টার্ন আইতে একটি সাক্ষাৎকার দেন ফারজানা। এক সময় দ্য গার্ডিয়ানের অধীনে থাকা পত্রিকাটির প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, ফারজানার বাবা পূর্ব পাকিস্তান থেকে ১৯৭০ সালে ইংল্যান্ডে যান। তিনিও এনএইচএস-এ কাজ করতেন।
সেই দিনগুলোর কথা স্মরণ করে ফারজানা বলেন, ‘আমার বাবা ১৯৭০ সালের শেষ দিকে পূর্ব পাকিস্তান থেকে এনএইএস-এ কাজ করতে আসেন। ওই সময় তিনি বৃত্তি পেয়ে অ্যানেসথেসিয়ার পোস্ট-গ্রাজুয়েশন শেষ করতে আসেন।’
‘কিন্তু কিছুদিনের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়। তার বৃত্তি চলে যায়। তারপর এনএইচএসে বছরের পর বছর কাজ করেন। উনি ৬০ বছর বয়সে অবসর নেন। এখন ৭৮ বছর বয়স।’
প্রতিবন্ধকতা জয় করে বর্ষসেরা : ফারজানার বর্ষসেরা হওয়ার তথ্য জানতে গিয়ে তার জীবনযুদ্ধের আরেক মর্মান্তিক গল্প জানা গেছে।
ফারজানা মূলত বর্ষসেরা জিপি নির্বাচিত হন গত নভেম্বরের শেষ দিকে। ‘প্রতিবন্ধকতা জয় করে’ চিকিৎসাখাতে অবদান রাখায় এই পুরস্কার দেয় পালস নামের একটি সংগঠন। এটি ব্রিটেনের একটি সম্মানজনক পুরস্কার। নভেম্বরের ২৯ তারিখ লন্ডনের পার্ক প্লাজা ওয়েস্টমিনস্টার ব্রিজে তার হাতে পুরস্কার তুলে দেয়া হয়।
ফারজানা পুরস্কারটি পেয়েছেন নিউহ্যামের প্রজেক্ট সার্জারিতে অবদান রাখার জন্য। এই প্রজেক্টে তার একমাত্র সঙ্গী ছিলেন ড. পিটার জনস। সিনিয়র এই ট্রেইনার আত্মহত্যা করলে ভেঙে পড়েন ফারজানা। পালসের সহযোগী একটি চিকিৎসা বিষয়ক আউটলেটের সঙ্গে আলাপকালে ফারজানা বলেন, মায়ের মৃত্যুর পর এই ঘটনা তার জীবনের দ্বিতীয় ট্র্যাজেডি ছিল। তবু তিনি হার মানেননি।
‘পিটার আমার বেস্ট ফ্রেন্ড ছিলেন। উনি চলে যাওয়ার পর ভেঙে পড়ি। আমি তার কারণেই আজকে ডাক্তার হতে পেরেছি।’
সিনিয়রের মৃত্যুর পর ফারজানা এক হাতে প্রজেক্টের সব সামলান। তার প্রজেক্টের রোগীরা ব্রিটেনের অন্য হাসপাতালের চেয়ে বেশি সন্তুষ্ট ছিলেন।
ফারজানা নিজের এই অর্জনকে এভাবে দেখেন, ‘মানুষের সেবা করছি এটাই বড় কথা। মহামারীর সময়ে কাজে যেতে পারি শুধু একটা কথাই ভেবে-যারা বেডে পড়ে আছেন, তাদের ভালো লাগাতে হবে।’