করোনাজয়ী জবিয়ানদের গল্প!

জবি প্রতিনিধি।

বর্তমান সময়ে এক আতঙ্কের নাম করোনা। করোনার কারণে পৃথিবীজুড়ে মানুষের প্রাণহানি ঘটছে সববয়সী মানুষের। প্রতিদিনই বাড়ছে আক্রান্তের সংখ্যা, মৃত্যুর মিছিলে যুক্ত হচ্ছেন অনেকেই। কিন্তু করোনার সাথে যুদ্ধ করে বেঁচে থাকা মানুষের সংখ্যাও নেহাত কম নয়। আজ শুনবো তেমনই করোনাজয়ী জবিয়ানদের গল্প।

 

করোনার ভয়াল থাবা এবং তা থেকে সুস্থ হওয়ার অভিজ্ঞতাঃ জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগের ১৫ ব্যাচের শিক্ষার্থী শরীফ ইবনে ফুয়াদ জানান, রোজার প্রথম দিন। আম্মুর কিছুটা জ্বর আসে ৯৯ ডিগ্রির মতো। এরকম ২ দিন যায় জ্বর ৯৯ থেকে ১০১ এর ভিতরেই থাকে। তার পরের দিন আমার জর আসে ১০৪ এর মত। প্রথমে ভাবছিলাম সিজন্যাল জ্বর কিন্তু জ্বর আর যায় না আর বারে। এর সাথে গলা বেথা শরীর ব্যথা এবং শরীর দুরবল হয়ে পরে।কোন কিছুর গন্ধ পাই না, আর অনেক সমসসা দেখা দেয়। পরে চিন্তিত হয়ে আইইডিসিআর এ ফোন দেই। কিন্তু অরা আসার কথা বলেও আসে না। পরে সিনিয়র ভাই এর সহযোগিতায় ১ তারিখ বাসায় আইইডিসিআর থেকে লোক আসে এবং সাম্পল নিয়ে যায়। ৬ তারিখ বিকাল ৪ টার সময় রিপোর্ট আসে। আমার এবং আমার মায়ের পজিটিভ এবং বাবার নেগেটিভ।আত্তিয়স্বজন সবাই চিন্তিত হয়ে পরে। সেই মুহুর্তে কিছুটা ঘাবড়ে যাই। কিন্তু মনোবল টা ধরে রাখি। পরে আমার বড় ভাই তার কর্মস্থল থেকে ঢাকায় এসে আব্বুকে ঢাকা সিএমএইস এ ভর্তি করিয়ে দেন। কিছুদিন পর তারও পজিটিভ আসে। এই সময়কালে প্রক্টর সার ও ডিপার্টমেন্টের শিক্ষকরা ও সিনিয়র ভাইরা সহপাঠীরা সব সময় খোঁজখবর নেন। প্রথমে হসপিটাল এ ভর্তি হব ভাবসিলাম কিন্তু বিভিন্ন যায়গায় গিয়ে বুজতে পারলাম বাসায় চিকিৎসা নেওয়াই ভাল হবে। পরে আমি আর আম্মু বাসায় থেকে ডক্টর এর কথা অনুযায়ী চলতে থাকি। বিভিন্ন ধরনের মসলা মিস্রিত গরম পানি খেতে থাকি। ভিটামিন সি ও ডি যুক্ত খাবার খেতে থাকি। গরম পানির ভাপ নিতে থাকি।এভাবেই অনেক দিন চলতে থাকি। ১৮ তারিখ রাত ৯ টার সময় ২য় টেস্ট এর রিপোর্ট আসে। সকলের দোয়ায় আমার ও আম্মুর নেগেটিভ আসে। এই খবর শুনে পরিবারের সবাই খুশি হয়। এর কিছদিন পর আব্বুরও নেগেটিভ আসে।

 

এখন আমার পরিবারের সবাই সুস্থ। যার জন্য আল্লাহর কাসে অনেক শুক্রিয়া আদায় করি।
যাদের করোনা হয়েছে তাদের উদ্দেশ্যে কিছু কথাঃ এই রোগ টা হওয়ার পর মনোবল টা ধরে রাখা অনেক জরুরি। তাহলে এই রোগ থেকে সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়।
ডাক্তার এর সব নিরদেসনা মেনে চলতে হবে খুব ই ভাল ভাবে। গরম পানি, গরম মসল্লা দিয়ে চা, গরম পানওর ভাপ, ভিটামিন সি ও ডি যুক্ত খাবার বেশি বেশি খেতে হবে।

Post MIddle

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সদ্য গ্রেজুয়েট রাকিব তালুকদার জানিয়েছেন তাঁর করোনা জয়ের গল্প। তিনি জানান, হটাৎ করেই তিনি খাবারে স্বাদ-গন্ধ পাচ্ছিলেন না। সন্দেহ থেকে ২৭ মে টেস্ট করান তিনি। তখন ও উনার শারীরিক কোনো সমস্যা হচ্ছিলো না। টেস্ট না করালে হয়তো বুজতেনই না। ২রা জুন রিপোর্ট পজিটিভ আসে। কিন্তু তিনি দিশেহারা হন নি। পরিবারের সকলের ভালোবাসায় ১৭ দিন পর ১১ জুন তার রিপোর্ট নেগেটিভ আসে। এরপর ১৫ জুন দ্বিতীয় বারের মতো করোনা নেগেটিভ আসে তাঁর। এর আগে অবশ্য ২৭ রমজানে ১ দিন জ্বর ছিলো যা নাপা খাওয়ার পর কমে যায়। করোনা যুদ্ধে জয়ী হয়ে ফেইসবুক স্ট্যাটাসের মাধ্যমে সকলের কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে জানিয়েছেন কিভাবে কাটিয়েছেন করোনায় আক্রান্ত দিনগুলি এবং এর থেকে পরিত্রানের উপায় ও বলেছেন সচেতনতার কথা। ফেইসবুক স্ট্যাটাসটি ছিলো অনেকটা এমনঃ আল্লাহর অশেষ কৃপায় করোনামুক্ত হয়েছি। মা-বাবা, ভাই-ভাবী, বোন-ভগ্নীপতি এবং মেহাজাবিন জোতি সহ সকলের প্রতি কৃতজ্ঞতা রইল। ময়মনসিংহের এডিশনাল ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট আয়েশা হক আপু, বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি ডিরেক্টর মজুমদা জাফর রুবেল ভাই, সিরাজগঞ্জের ডিসি কিরণ ভাই, এবং গফরগাঁওয়ের ইউএনও স্যার সহ সকলের প্রতি কৃতজ্ঞতা রইলো। সার্বক্ষণিক সহযোগিতা করেছেন সৈকত শাহরিয়া ভাই, রনি আকন্দ ভাই, আকরামুল আশরাফ হিমেল ভাই, রিফাত মোড়ল, একরামুল, সাগর,আমির ভাই,মামা-মামী, খালা-খালু। তিনি বলেছেন, বাদল ভাই আপনি গাড়িচালক হয়ে মানবতার যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন তার জন্য আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ। মানসিকভাবে সবসময় সাপোর্ট দিয়েছেন এস আই হিরণ দাদা, নাট্য অভিনেতা শহীদুল্লাহ সবুজ ভাই, ডাঃ সজীব ভাই, মুন্নী, সায়ন্ত, খালিদ, সম্রাট ভাই, তাসমিদ, সোয়েব, জিহাদ, পিয়ার, রানা ভাই, মনোজ, জেরী, আল মামুন, আনোয়ার তালুকদার। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বড় ভাই-বোন, ছোট ভাই-বোন, বন্ধু-বান্ধবী ও স্যার-ম্যাডামদের প্রতি কৃতজ্ঞতা রইলো পাশে থাকার জন্য। এলাকার যারা আমার জন্য আমার পরিবারের পাশে ছিলেন তাদের কেউ কৃতজ্ঞতা জানাই, আর যারা গুজব ছড়িয়েছেন তাদেরকে আল্লাহ হেদায়েত দান করুক।
করোনা হওয়ার পর আমি যা করেছিঃ

★নিয়মিত ৫ ওয়াক্ত নামাজ পড়েছি এবং ধর্মীয় বই পড়েছি।
★দিনে ৪ বার গরম পানির ভাপ নিয়েছি ১০ মিনিট করে।
★গরম পানি পান করেছি, গরম পানি দিয়ে গড়গড় করেছি নিয়মিত।
★দৈনিক ৪-৫ কাপ লাল চা পান করেছি।
★ভিটামিন-সি সমৃদ্ধ খাবার খেয়েছি।
★গরম পানিতে স্যাভলন মিশিয়ে তা দিয়ে গোসল করেছি।
★গায়ে রৌদ্র লাগিয়েছি ২০ মিনিট করে।
★নিয়মিত ব্যায়াম করেছি।
যারা আপনাকে সাহস দিবে অবশ্যই তাদের ফোন রিসিভ করবেন। তবে অনেকেই হতাশার গল্প শুনাতে আসবে তাদের ইগ্নোর করুন। সর্বোপরি নিজ নিজ ধর্ম অনুযায়ী সৃষ্টিকর্তাকে ডাকুন তিনি অবশ্যই আপনাকে রক্ষা করবেন।

করোনাজয়ী আরেক জবিয়ান বলেন, ১১ তারিখ ইফতারের সময় আব্বা বলল উনার নাকি জ্বর জ্বর লাগতাসে ইফতার খাওয়ার পর রাত ১০ টার দিকে খিচুনি দিয়ে প্রচন্ড জ্বর চলে আসে। খিচুনি এত বেড়ে যায় যে আম্মা আর আমি কাথা কম্বল দিয়ে চেপে ধরেও খিচুনি কমানো যাচ্ছিলো না। এর পর খিচুনি ও জ্বর ধীরে ধীরে কমে আসে। সেহরির সময় আবার আব্বার জ্বর আসে । তারপর যখন ২ দিনেও জ্বর ভালো হচ্ছিলো না তখন আব্বাকে বাসায় আইসোলেশনে রাখার কথা চিন্তা করি কিন্তু আম্মা তাতে রাজি হয় নাই, আম্মা ও আমি আব্বার সেবা যত্ন করতে থাকি। ৩ দিনের মাথায় আম্মারও জ্বর আসে আমি মানুষিক ভাবে একদম ভেঙ্গে পরি। তখনও মনকে বুঝ দিচ্ছিলাম যে এটা হয়তো সিজনাল জ্বর হবে। আব্বা আম্মা দুইজনই বিছানায় পরে গেলো আমি ও আমার ছোট ভাইকেই আব্বা আম্মার সেবা যত্ন সহ বাসার সব কাজ করতে হচ্ছিলো। এই পরিস্থিতিতে করোনা টেস্ট করা জরুরি হয়ে পরলো কিন্তু তখন করোনা টেস্ট করানো ছিলো যুদ্ধ জয় করার মত, মুগদা হসপিটালে দুইদিন লাইনে দাড়িয়ে থেকেও করোনা টেস্টের টিকেট পেলাম না। আস্তে আস্তে মানসিক ভাবে আমি আরো ভেঙে পরি। এরপর ১৮ ঘন্টা মুগদা হাস্পাতালে লাইনে দাড়িয়ে আব্বা আম্মার জন্য টেস্টের টিকেট পাই। টেস্টে আব্বা আম্মার করোনা পজিটিভ আসে। আমি কিছুতেই আমার মনোবল ধরে রাখতে পারছিলাম না। তাও মনে সাহস রাখতে হয়েছিলো যেভাবেই হোক আব্বা আম্মাকে সেবা যত্ন করে সুস্থ করে তুলতে হবে। আব্বা আম্মার পজিটিভ ধরা পরার পরও আমি আর আমার ভাই আলাদা বা আইসোলেশনে যাই নাই সবসময় উনাদের কাছে থেকেই সাহস জুগিয়েছি এর মধ্যে আমার ও আমার ছোট ভাইয়েরও করোনা মৃদু উপসর্গ দেখা দিয়েছে কিন্তু বাবা মার কথা ভেবে ভেঙে পরি নাই সব সময় আল্লাহর কাছে দোয়া করতাম যাতে এই পরিস্থিতিতে আমাকেও যাতে বিছানায় পরে যেতে না হয়। আব্বার জ্বর ২ সপ্তাহ পর কমতে থাকে আম্মার কাশি ও শরীর ব্যাথা সাথে বমি তখনও কমছিলো না। জ্বর, কাশির ও কিছু ভিটামিনের ওষুধ খাওয়াচ্ছিলাম। ৩ সপ্তাহ পর সব কিছু ভালো হতে থাকে। আব্বা আম্মা দুইজনেই সুস্থ হতে থাকে এবং খাওয়া দাওয়া করতে শুরু করে প্রথম দিকে আম্মা কিছুই খাইতে পারত না মুখে কোন স্বাদ ছিলো না যা খেতো বমি করে দিত। জুনের ৮ তারিখে সবাই টেস্ট করাই অবশেষে আল্লাহর অশেষ রহমতে আমার ও আমার মায়ের নেগেটিভ চলে আসে কিন্তু আব্বার ও ছোট ভাইয়ের কোন রিপোর্ট পাই নাই তাই ১৭ তারিখ তাদের আবার টেস্ট করাই সেখানে ওদের দুইজনেরও নেগেটিভ চলে আসে।
সর্বোপরি বাসায় থাকুন, সুস্থ থাকুন, নিরাপদে থাকুন।

পছন্দের আরো পোস্ট