নিজ দায়িত্বে বাঁচান নিজেকে
মোঃ জাহিদুল ইসলাম শামীম।
করোনাভাইরাস এর মতো ক্ষুদ্র একটি ভাইরাসের কাছে মানুষের চরম অসহায়ত্ব দিন দিন আরও বেশি প্রকট হয়ে উঠছে। পুরো বিশ্ব নাজেহাল এই ক্ষুদ্র ভাইরাস এর কাছে। অথচ এই ক্ষুদ্র ভাইরাসটি খালি চোখে দেখা যায় না। পৃথিবীব্যাপী হানা দিয়ে কয়েক লক্ষ মানুষকে মৃত্যুর স্বাদ পাইয়ে দিয়েছে করোনাভাইরাস।
এখন পর্যন্ত করোনাভাইরাসের টিকা, ঔষধ বা প্রতিষেধক আবিষ্কার করতে সক্ষম হয়নি কোন দেশের বিজ্ঞানী। কবে নাগাদ টিকা আসবে তারও সঠিক তথ্য কেউ বলতে পারছে না। তবে চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে প্রতিটি দেশের বিজ্ঞানীগণ।
বর্তমানে করোনাভাইরাস থেকে নিরাপদ থাকতে বিশেষজ্ঞগণ পরামর্শ দিচ্ছেন- কিছুক্ষণ পরপর হাত ধুতে বা জীবানুনাশক স্যানিটাইজার ব্যবহার করতে এবং যেহেতু ভাইরাসটি মুখ দিয়ে ফুসফুসে প্রবেশ করতে পারে তাই মুখে মাস্ক ব্যবহার করে নিজেকে সুরক্ষিত রাখতে।
দীর্ঘ ৬৬ দিন লকডাউন চলার পর সরকার নিম্ন আয়ের মানুষদের কথা এবং সর্বোপরি বাংলাদেশের অর্থনীতির কথা চিন্তা করে ৩১ মে, ২০২০ তারিখে লকডাউন তুলে নেয়। যদিও লকডাউন তুলে নেয়াতে অনেক সমালোচনা সহ্য করতে হয়েছিল সরকারকে কিন্তু সরকার তাঁর সিদ্ধান্তে স্থির ছিল বাংলাদেশের মানুষ ও অর্থনীতির কথা বিবেচনা করে। বিশ্বের উন্নত দেশগুলো পর্যন্ত অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা ও জনগণের বেকারত্বের কথা চিন্তা করে লকডাউন তুলে দিয়েছে। মানুষ করোনাভাইরাস এর ভয়ে যেমন ভীত তেমনি আতঙ্কিত না খেয়ে থাকার ভয়ে।
২৬ মার্চ থেকে ৩০ মে পর্যন্ত চলা ছেষট্টি দিনের লকডাউনে চার লক্ষ কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতি হয়েছে বলে জানাচ্ছেন অর্থনৈতিক বিশ্লেষকগণ।
(তথ্যসূত্র: ৩১ মে, ২০২০, বাংলাদেশ প্রতিদিন)
বাংলাদেশের মতো নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশের জন্য চার লক্ষ কোটি টাকা একটি অনেক বড় অংক। যা বাজেটের প্রায় ৬০ শতাংশ। এই ক্ষতি পুষিয়ে নিতে সরকার বিভিন্ন কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। যদিও তা সময় সাপেক্ষ।
এসডিজি প্ল্যাটফর্ম এর তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে চাকরি হারানোর ঝুঁকিতে রয়েছেন ১ কোটি ৩০ লক্ষ মানুষ। অস্থায়ী কিংবা খন্ডকালীন কর্মসংস্থানের সঙ্গে নিয়োজিত নাগরিকরা এই ঝুঁকিতে বেশি রয়েছেন। (তথ্যসূত্রঃ ১৬ জুন, ২০২০, বাংলাদেশ প্রতিদিন)
করোনার এই সময়ে ইতোমধ্যে অনেক শ্রমজীবী কর্মহীন হয়ে পড়েছেন। চাকরি হারিয়েছেন অনেক চাকরিজীবী। যদিও সরকার এই দুঃসময়ে শ্রমিক ছাঁটাই না করার জন্য নির্দেশনা জারি করেছে কিন্তু তা অনেকেই মানছে না। তাই শ্রমিকদের ভোগান্তি আরো বাড়ছে।
করোনাভাইরাসের প্রভাবে সারা বিশ্বের প্রতিটি দেশের অর্থনীতিরই অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে। কোন কোন দেশ বিদেশি শ্রমিকদের দেশে পাঠানোর কথাও চিন্তা করছে। বাংলাদেশের আয়ের অন্যতম উৎস বিদেশি শ্রমিকদের পাঠানো রেমিটেন্স। তাই প্রবাসী শ্রমিকরা দেশে ফিরে আসলে অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে। চাকরি হারানোর কারণে অনেকের মধ্যে হতাশা বেড়েছে। বেড়েছে পারিবারিক কলহ ও সামাজিক অশান্তি। এমতাবস্থায় লকডাউন তুলে দেয়া কি ভুল বা অযৌক্তিক সিদ্ধান্ত ছিল?
জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস কয়েকদিন আগে বলেছেন, করোনাভাইরাসের কারণে আসন্ন অর্থনৈতিক মন্দায় দরিদ্ররা তাদের মৌলিক পুষ্টি চাহিদা থেকে বঞ্চিত হতে যাচ্ছে। অবিলম্বে ব্যবস্থা নেয়া না হলে বিশ্বের লাখ লাখ মানুষ ও শিশুকে এক ভয়াবহ খাদ্য সংকটের মুখে পড়তে হবে। (তথ্যসূত্রঃ ৯ জুন, ২০২০, দ্য গার্ডিয়ান)
জাতিসংঘের মহাসচিবের সতর্কবাণী নিশ্চয়ই গুরুত্বপূর্ণ। আর তাই কৃষি উৎপাদনসহ অন্যান্য উৎপাদনকে চালু রাখা হয়েছে। সকল উৎপাদন বন্ধ থাকলে দেশ দুর্ভিক্ষের মধ্যে পড়তে পারে বলেও বিশেষজ্ঞগণ মনে করেন। সরকার লকডাউন তুলে দিয়েছে অর্থনীতির স্বার্থে, জীবন-জীবিকার তাগিদে। কর্মজীবী মানুষেরা বাইরে যাবে কর্মের প্রয়োজনে স্বাস্থ্যবিধি মেনে, অন্যরা বাসায় থাকবে। মানুষ কোন প্রয়োজন ছাড়া বাইরে বের হবেনা এই ছিল সরকারের নির্দেশনা। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে, ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান বিকাল ৪ টা পর্যন্ত খোলা থাকবে। যার যার প্রয়োজনীয় কেনাকাটা করে সবাই বাসায় ফিরে বাসায় অবস্থান করবে। কিন্তু ক’জন মানছে সরকারের নির্দেশনা? ৪ টার পর ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান খোলা রেখে কেনা বেচা চলছে। কোন কোন শিক্ষক গোপনে ব্যাচে প্রাইভেট পড়াচ্ছে। যা স্পষ্টতই আইনের লঙ্ঘন।
লকডাউন তুলে নেয়ায় সরকারের সমালোচনা করে সবাই বাইরে বের হয়ে পড়লো। এ যেন মুক্তির আনন্দ! যার কাজ আছে তিনিও বাইরে, আর যার কাজ নেই তিনিও হাওয়া খেতে বের হয়েছেন বাইরে। বাসায় যেন সবার দম বন্ধ হয়ে আসছিল! দম ছাড়ার জন্য বাইরে বেরিয়ে পড়লেন সবাই। কেহ ছুটলেন বন্ধু বা আত্মীয়ের বাসায় বেড়াতে, আড্ডা দিতে, কেহ যাচ্ছেন বন্ধুদের সাথে ফুচকা খেতে, আর কেহ বা বাইরের কী হালচাল তা দেখার জন্য বাইরে বের হচ্ছেন।
লকডাউন এর মধ্যেও অনেককে দেখেছি বিভিন্ন অজুহাত দেখিয়েছেন বা মিথ্যা বলেছেন বাইরে বের হওয়া নিয়ে। লকডাউন তুলে দেয়ায় পুরো মওকা পেলেন তারা। কিন্তু এ যে আপন পায়ে কুড়াল মারার সমান!
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) ও চিকিৎসা বিজ্ঞানীগণ বারবার তাগিদ দিয়ে বলছেন মাস্ক ব্যবহার করতে। করোনাভাইরাস প্রতিরোধে মাস্ক খুবই উপকারী ভূমিকা পালন করে। এটি যেমন অন্যের থেকে নিজেকে আক্রান্ত হওয়া থেকে রক্ষা করে তেমনি কেউ আক্রান্ত হলে তার থেকেও অন্যের মাঝে সংক্রমিত হওয়া ঠেকায়। এটা জানার পরেও অনেকেই মাস্ক ব্যবহার করছেন না। যারা ব্যবহার করছেন তাদের অনেকেই মাস্কটি থুতনির নিচে নামিয়ে রাখেন, কারো কারো মাস্ক থাকে পকেটে, আর কারোরটা থাকে বাসায়। আবার কেহ বা কথা বলার সময় মাস্কটি হাতে নিয়ে কথা বলেন, যা স্বাস্থ্যসম্মত নয়। কেউ কেউ অনিচ্ছায় কেউবা আবার ইচ্ছে করেই মাস্ক ব্যবহার করেন না। এই চিত্র দেখে আসছি অনেকদিন ধরে। পুলিশ বা ম্যাজিস্ট্রেটকে দেখলে অনেকে মাস্ক পড়েন। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় মাস্ক পড়েন নিজের জন্য নয় আইনের ভয়ে। আগেও এমনটি ছিল তবে লকডাউন উঠে যাওয়ার পর এই প্রবণতা অনেক বেশি বেড়েছে। হিসাব করলে দেখা যাবে বর্তমানে ৫০ থেকে ৬০ ভাগ লোক মাস্ক পরিধান করে।
ধর্মীয় প্রার্থনাগৃহে অনেকে হয়তো ভাবেন যে ওখানে করোনাভাইরাস প্রবেশ করতে পারে না। তাই অনেকে মাস্ক ছাড়া চলে যান মসজিদে, মেনে চলেন না স্বাস্থ্যবিধি। কোন স্থানই করোনাভাইরাসের জন্য নিরাপদ নয়। হোক তা মসজিদ, মন্দির, গির্জা, প্যাগোডা, সিনাগগ বা গুরুদুয়ারা। তাই সকল স্থানে সচেতনতা ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা জরুরি।
আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চললেই করোনাভাইরাস থেকে মুক্তি মিলতে পারে। আমাদের অসচেতন আচরণ দিন দিন দেশকে ভয়াবহ পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দিচ্ছে। কয়েকটি পরিসংখ্যানের দিকে দৃষ্টি দিলে বিষয়টি সহজে বোধগম্য হবে।
বাংলাদেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত প্রথম রোগী শনাক্ত হয় ৮ মার্চ, ২০২০। ৮ মার্চ থেকে ৪ মে পর্যন্ত প্রথম ৫৮ দিনে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয় ১০ হাজার মানুষ। কিন্তু ১৬ থেকে ১৮ জুন পর্যন্ত মাত্র ৩ দিনে আক্রান্ত হয়েছে ১২ হাজার মানুষ। আক্রান্তের হার কত দ্রুত বাড়ছে দেখুন!
অন্যদিকে ৮ মার্চ থেকে ৩০ মে অর্থাৎ লকডাউন চলা পর্যন্ত এই ৮৪ দিনে আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ৪৪ হাজার ৬০৮ জন, মৃতের সংখ্যা ছিল ৬১০ জন। কিন্তু ৩১ মে থেকে ১৯ জুন পর্যন্ত মাত্র ২০ দিনে আক্রান্ত হয়েছে ৬০ হাজার ৯২৭ জন ও মৃত্যুবরণ করেছে ৭৮৮ জন। ১৯ জুন, ২০২০ পর্যন্ত করোনাভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা ১ লক্ষ ৫ হাজার ৫৩৫ জন এবং মৃত্যুবরণ করেছে ১৩৮৮ জন। (তথ্যসূত্রঃ ওয়ার্ল্ডোমিটার, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও বাংলাদেশ প্রতিদিন)
প্রতিদিন বাড়ছে আক্রান্ত ও মৃত মানুষের সংখ্যা। এগুলো শুধু সংখ্যা নয়- এক একটি পরিবার, একেকটি স্বপ্ন, একেকটি পৃথিবী। এমতাবস্থায় নিরাপদ থাকতে চাইলে নিজেকে সচেতন হয়ে, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলাফেরা করতে হবে। কোন কাজ ব্যতীত বাইরে বের না হয়ে ঘরেই অবস্থান করতে হবে, যতদিন না পরিস্থিতি সম্পূর্ণ স্বাভাবিক হয়। তা যতোই কষ্টের হোক। অহেতুক ঘোরাঘুরি, চায়ের দোকানে আড্ডা দেয়া আত্মঘাতী কাজ বলে পরিগণিত হবে; যা দেশকে আরো খারাপ পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দিতে পারে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে, সচেতন হয়ে চলাফেরা করাই নিরাপদ রাখতে পারে করোনাভাইরাস থেকে।
মোঃ জাহিদুল ইসলাম শামীম, সহকারী কমিশনার ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট, জেলা প্রশাসকের কার্যালয়, জামালপুর।