‘বাবার জন্য ভালবাসা সারাজীবন’

মেহেরাবুল ইসলাম সৌদিপ

বাবা শুধু একজন মানুষ নন, স্রেফ একটি সম্পর্কের নাম নয়। বাবার মাঝে জড়িয়ে আছে বিশালত্বের এক অদ্ভুত মায়াবি প্রকাশ। বাবা নামটা উচ্চারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যে কোন বয়সী সন্তানের হৃদয়ে শ্রদ্ধা কৃতজ্ঞতা আর ভালবাসার এক অনুভব জাগে মানুষটি কতভাবে অবদান রেখে যান সন্তানের জন্য, যার চুলচেরা হিসাব করে কেউ বের করতে পারবেন না। বাবার কাঁধটা কি অন্য সবার চেয়ে বেশি চওড়া? তা না হলে কি করে সমাজ সংসারের এত দায়ভার অবলীলায় বয়ে বেড়ান বাবা। বাবার পা কি অন্য সবার চেয়ে অনে বেশি দ্রুত চলে? নইলে এতটা পথ এত অল্প সময়ে কি করে এত শক্ত করে সব কিছু আগলে রাখেন বাবা। আর বাবার ছায়া…?সেটাও শেষ বিকেলের বটগাছের ছায়ার চেয়েও বড়। বড় যদি না হবে তবে জীবনের এত উত্তাপ থেকে কি করে সন্তানকে সামলে রাখেন বাবা আর বাবার চোখ? সেটাও কি দেখতে পায় কল্পনার অতীত কোন দূরত্ব। তা না হলে কি করে সন্তানের ভবিষ্যত ভাবনায় শঙ্কিত হন বাবা।

 

বাবা নিয়ে সব সন্তানের অনুভূতিটা সমান হয় না। আবার জীবনের নানা বাঁকে সব বাবাও হয়ত পারেন না সন্তানের প্রতি তাদের আরেকটু একইভাবে প্রকাশ করতে। তাই কখনও কখনও বাবা নামের সম্পর্কটার বিশালত্ব ভুলে যাই আমরা। আমাদের জনক হয়ে যান জন্মদাতা। ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যের ভাবনায় বাবার ভূমিকাকেও খাটো মনে হয়। তবুও বাবা কিন্তু সন্তানের জন্য মঙ্গল কামনা করে যান তার জীবনের শেষ দিনটি পর্যন্ত। প্রকাশভঙ্গি যাই হোক সন্তানের জন্য পৃথিবীটাকে বাসযোগ্যকরে তুলতে চেষ্টার কোন কমতি থাকে না তার। তাই বাবা যাদের বন্ধু তারাই জানে কি করে নিজের সব ভাবনাকে বাবার হাতে সঁপে দিয়ে হাল্কাহতে হয়। কি করে বাবার নির্ভরতার ছায়ায় থেকে, তার চোখে দেখা সুন্দর ভবিষ্যতটাকে নিজের করে নিতে হয়। অন্যদিকে বাবা যাদের কাছেদূরতম গ্রহের বাসিন্দা, তারা শত অর্জনের মাঝেও নিশ্চিতভাবেই বঞ্চিত হন অমোঘ এক প্রাপ্তি থেকে। বাবার সঙ্গে সন্তানের যে সহজ স্বাভাবিক সম্পর্ক তাতে দু’জনেরই কিছু না কিছু করার ব্যাপার রয়েছে। বাবা হয়ত সারাদিনের ব্যস্ততা শেষে ক্লান্ত শরীর আর মন নিয়ে বাড়ি ফিরলেন। সে ক্ষেত্রে ভালবাসার বারতা নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে সন্তানকেই। আবার সন্তান যখন মনের মাঝে ঘরবসতি গড়ে দিনে দিনে নিভৃতচারী হয়ে উঠছে তখন তার ভাবনাগুলো ভাগাভাগি করতে সামনে এগোতেহবে বাবাকে। মনে রাখবেন, সন্তান যত বড়ই হোক না কেন তার অভিমান আরঅবহেলার পরিমাণ যত বিশালই হোক বাবার স্নেহ সব সময় তার জন্য এক পরম আশ্রয়। বেঁচে থাকার আনন্দে, কষ্টের তীব্রতায়, কঠিন সমস্যায় বাবাই হয়ে ওঠেন বিপদের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য বন্ধু বা সহায়।

অন্যদিকে সন্তান হিসেবে আপনাকে ভাবতে হবে বাবার কথা। তার আবেগ অনুভূতি আর পরিণত বয়সের চাওয়া পাওয়াগুলোর দিকে বাড়তি নজর দিতে হবে। যে বয়সে স্কুল-কলেজে নতুন নতুন বন্ধু বান্ধবের সঙ্গে সময়গুলো বেশ জমে উঠেছে সে সময়টাতে ভুলে যাওয়া চলবে না পুরনো বন্ধুকে। বরং পুরনো দিনের কথা মনে রেখে নিজের জীবনের এই খোলস ছাড়াবার মুহূর্তে যদি বাবাকেও সঙ্গী হিসেবে নেয়া যায় তাহলে বরং চেনা বন্ধুরাও নতুন রঙে রঙিন হয়ে ওঠে। সেই সঙ্গে জীবনের কঠিন পথেহোঁচট খাওয়ার ঝুঁকিটা কমে। আবার যারা পড়াশোনার পাঠ চুকিয়ে দিব্যি কর্মজীবনে প্রবেশ করেছেন আয় উপার্জন শুরু করেছেন তাদেরও সময় করে ভাবতে হবে বাবার কথা।

Post MIddle

অফিসের ব্যস্ততা আর নানা ঝামেলার মাত্রাটা যতই সীমা ছাড়িয়ে যাক না কেন বাড়িতে ফিরে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কয়েক মিনিটের জন্য হলেও তার পাশে বসতে হবে গল্পের ঝুড়ি নিয়ে।তাহলেই দেখবেন কোথায় যেন দিব্যি মিলিয়ে যাবে তার মাথায় চেপে বসা যত চিন্তা আর টেনশনের বোঝা। মনে রাখবেন আপনার, আমার বাবা কিন্তু আমাদের কাছে বড় কোন উপহার চান না। বরং ব্যস্ততার মাঝে বের করে নেয়া একটু সময় বাবাকে দিয়েই দেখুন না নিশ্চিত করে বলে দেয়া যায়, এমন কোন বাবা নেই যিনি সন্তানের এই সান্নিধ্যটুকু উপভোগ করেন না।অন্যদিকে জীবনের অমোঘ নিয়মে যারা বহুদিন আগেই হারিয়েছেন তাদের সন্তানরাও কিন্তু বাবাকে ভালবেসে করতে পারেন অনেক কিছু। এটা হতে পারে বাবার জন্য মহান সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করা কিংবা বাবার অপূর্ণ ইচ্ছে আর বাবার আদর্শের বাস্তবায়ন। পিতার সহায় সম্পত্তির ওয়ারিশ বা উত্তরাধিকার হিসেবে মানুষ যেভাবে সচেষ্ট হয় নানা তৎপরতা চালায় বাবার আদর্শ ও মূল্যবোধের ধারক-বাহক হতে মানুষ কেন তৎপর হয় না সেটাই প্রশ্ন। এটা দুঃখজনক ব্যাপার সন্দেহ নেই। সারাজীবনের সাধনায় বাবা আপনাকে যেখানে দেখতে চেয়েছিলেন বাবার মৃত্যুর পর সে জায়গায় যদি নিজেকে নিয়ে যেতে পারেন এবং উজ্জ্বল একটি অবস্থানে প্রতিষ্ঠিত করতে পারেন, তবে সেটা বাবার প্রতি ভালবাসা ও যথার্থ সম্মান দেখানো হবে বৈকি। ব্যস্ততার সাগরেডুবে থাকা নাগরিক জীবনে আমাদের সব আবেগ অনুভূতিই ইদানীং বড্ড বেশি যান্ত্রিক হয়ে পড়ছে। কিন্তু তাই বলে বাবাকেও কি মনে করতে হবে বছরের নির্দিষ্ট একটি দিনে? বছরের একটি নির্দিষ্ট দিনেই শুধু নয়, বছরজুড়ে নানা কাজে কর্মে, আদর্শ বাস্তবায়নে তাকে স্মরণ করতে হবে শ্রদ্ধা ও ভালবাসায়। আমাদের নিত্য ব্যস্ততা আর অসতর্কতাযখন বাবার সঙ্গে তৈরি করে অদৃশ্য দূরত্ব তখন আমাদের জীবনটা ক্রমেই অর্থহীন হয়ে যেতে থাকে। এক্ষেত্রে আমাদের সবাইকে গভীরভাবেচিন্তাভাবনা করতে হবে বৈকি।সন্তান ধ্বংসের পথে ধাবিত হচ্ছে। বাবা-মাকে এ জন্য শক্ত হাতে সংসারের হাল ধরতে হবে। সন্তানের প্রতি বাবা হিসেবে যথাযথ দায়িত্বপালন করতে হবে। যার ঔরসে সন্তানের পৃথিবীতে আগমন সেই বাবা সন্তানের জন্য যেন এক নিবিড় ছায়া। যার কাজ দুঃখ-কষ্ট থেকে দূরে সরিয়ে রেখে সন্তানকে ভালবাসার আর্দ্রতা উপহার দেয়া। রক্তের বাঁধনে বাধা চমৎকার সম্পর্ক বাবা ও সন্তানের। সন্তান ও বাবার সম্পর্কের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি হচ্ছে শ্রদ্ধা। বাবার কাছেই তার যত আবদার, যেন বাবাই তার আশ্রয়। তাই বেশিরভাগ সন্তানের চোখে বাবাই শ্রেষ্ঠ মানুষ। পুত্র জীবনযুদ্ধে বাবাকে মূলত সেনাপতি হিসেবে দেখে, যার শাসনাধীনেই চালিত হয় তা যাপিত জীবন। শৈশব-কৈশোরে পিতাই হন পুত্রের ফ্রেন্ড, ফিলোসফার এ্যান্ড গাইড। অন্যদিকে পুত্রের মাঝে সাধারণত পিতা নিজের ছায়া দেখতে পান কিংবা দেখতে চান নিজের প্রাপ্তি অপ্রাপ্তির হিসাব মেলাতে না পারা বাবা তার সন্তানের মাধ্যমে সেই আশা স্বপ্ন পূরণের নতুন স্বপ্ন বুনতে থাকেন। ব্যর্থ স্বপ্ন ও সাধ পূরণ করতে চান বাবা সন্তানের মাধ্যমেই। আর সন্তানও বেশিরভাগ সময় প্রভাবিত হয়ে বাবার ব্যক্তিত্বের ছায়ায়।আধুনিক জীবনযাপনে বাবা ও সন্তানের সম্পর্কের সমীকরণ অনেকটা ওলটপালট হয়ে গেছে। এখন বাবার কাছে আপন সন্তানকে অনেক সময় বড্ড অচেনা মনে হয় আজকাল বাবা ও ছেলে সম্পর্কে ক্ষেত্রে অনেক অবনতি ঘটেছে। কমিউনিকেশন গ্যাপটা দিনে দিনে প্রকট হয়ে উঠছে।

 

ব্যক্তিত্বের সংঘাত পারিবারিক জীবনে অস্বস্তি, বিশৃঙ্খলা, অবিশ্বাস, দুঃখ-যন্ত্রণা বাড়িয়ে তুলছে কেবলই। সন্তানের কোনভাবেইভুলে যাওয়া উচিত নয়, তাকে বড় করে তুলতে যোগ্য মানুষ হিসেবে এই পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠিত হতে এবং পথ চলতে বাবা তার জন্য কত ত্যাগ করেছেন, জীবনের সুখ স্বাচ্ছন্দ্য আনন্দ বিসর্জন দিয়েছেন। এ জন্য বাবাকে কতটা পথ পাড়ি দিতে হয়েছে। আবার অন্যদিকে সন্তানেরও উপলব্ধি করা উচিত বাবা বিনিময়ে কিছু পাবার উদ্দেশ্যে তার জন্য এতকিছু করেননি। পিতারও বোঝা উচিত সন্তানকে যুগের দাবি মেটাতে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে একটি মেয়ের জীবনে প্রথম পুরুষই হচ্ছেতার বাবা।প্রতিবছর জুনের তৃতীয় রবিবার বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাবা দিবস পালিত হয়। আমাদের দেশেও আজকাল বেশ ঘটা করেই বাবা দিবস পালিত হয়ে থাকে। বাবার প্রতি সন্তানের ভালবাসা প্রকাশের জন্য দিনটি বিশেষভাবে উৎসর্গ করা হয়ে থাকে। যদিও বাবার প্রতি সন্তানের ভালবাসা প্রকাশের জন্য দিনটি বিশেষভাবে উদযাপনের প্রয়োজন হয় না। তার পরেও পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মতো বাংলাদেশে এখন বাবা দিবস পালন করা হয়। তাই বলে এ ধরনের দিবসগুলো যে একেবারেই অপ্রয়োজনীয় তা কিন্তু বলা যাবে না। সন্তানের জন্য বাবার ভালবাসা সীমাহীন। নিজের সন্তানের জন্য মুঘল সম্রাট বাবরের ভালবাসার উদাহরণ ইতিহাস হয়ে আছে। সম্রাট বাবার নিজের সন্তান হুমায়ূনের জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করতে প্রস্তুত ছিলেন। এমন স্বার্থহীন যার ভালবাসা সেই বাবাকে সন্তানের খুশির জন্য জীবনের অনেক কিছুই ত্যাগ করতে হয়। বাবা দিবসের প্রাক্কালে সন্তানের সামনে সুযোগ আসে বাবাকে অন্তরেরগভীর থেকে কৃতজ্ঞতা জানানোর। আমাদের সবার উচিত বাবা-মায়ের প্রতিদায়িত্বশীল হওয়া। তারা বৃদ্ধ বয়সে যাতে কোনভাবে অবহেলার শিকার নাহন সেদিকে সজাগ দৃষ্টি দিতে হবে।

অনেক সন্তান রয়েছে, যারা মা-বাবার দেখাশোনার প্রতি খুব একটা মনোযোগী নয়। মা দিবস বা বাবাদিবস তাদের চোখের সামনের পর্দাটি খুলে ফেলে বাবা-মায়ের প্রতি তার দায়িত্বের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। এ ক্ষেত্রে বলতে পারিবারিক বন্ধনকে আরও অনেক সুদৃঢ় করতে বাবা দিবসের বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। আমাদের পারিবারিক জীবনে এবং সমাজে বাবার যে গুরুত্ব তা আলাদাভাবেতুলে ধরতেই বাবা দিবস পালনের মূল উদ্দেশ্য।

পছন্দের আরো পোস্ট