দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনে বন্ধ হবে ইভটিজিং

কামরুজ্জামান শানিল।

নারী। একজন নারীর হাতেই গড়ে ওঠে একজন মানুষ। একজন নারীই তৈরি করে পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র। কখনো একজন কন্যা, কখনও একজন বোন, কখনো একজন স্ত্রী, কখনো একজন মা। কখনো একজন গৃহিনী, কখনোবা একজন চাকরিজীবী। এই বিভিন্নে চরিত্রে আমাদের জীবনে জড়িয়ে আছে নারী, যাদেরকে ছাড়া চলা যাবে না এক মুহূর্তও। তবে কি আমরা নারীদেরকে সেই সম্মানটুকু দিতে পেরেছি? পুরুষতান্ত্রিক সমাজের সেই প্রথা হয়তো যৎসামান্য কাটিয়ে উঠতে পারলেও নারী কি আজও সমাজে একজন সাধারন মানুষের মত জীবন যাপন করতে পেরেছে? প্রতিনিয়ত হচ্ছে তাদের সম্মানহানি। আমরা একে সহজ ভাষায় বলি “ইভটিজিং”।

 

“ইভ” শব্দ দ্বারা আদিমাতা “হাওয়া” কে বুঝানো হয়েছে যা ভাবগত দিক দিয়ে সমগ্র নারী জাতিকে বুঝাচ্ছে। আর “টিজ” শব্দের অর্থ হলো জ্বালাতন করা। পথে-প্রান্তরে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, অফিস-আদালতে, যানবাহনে, সর্বোপরি সকল জায়গায় এমন জ্বালাতন কিংবা কটুক্তির শিকার হচ্ছে নারী। হয়ত তারা পারে না কোনো প্রতিবাদ করতে। হয়ত তাদের মধ্যে “অবলা নারী” নামক সেই দুর্বলতাটি কাজ করে। প্রতিনিয়ত রাস্তা-ঘাটে কটুক্তির শিকার হচ্ছে, যাতায়াত কালে পরিবহনেও উত্ত্যক্ত করা হয় নারীদেরকে। আর এসব উত্ত্যক্তকরনের ফলেই হীনমন্যতায় ভুগে নারীরা। এর জন্য মাঝেমধ্যে অনেকে আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে। এই ইভটিজিং এরই আরেকটু ম্যাচিউর্ড রূপ হচ্ছে ধর্ষন। আর তাই ইভটিজিং কে “প্রকাশ্যে যৌন হয়রানি” বলে অবিহিত করা হয়েছে। অবাক করা বিষয় হলো, যে সমাজ, যে রাষ্ট্র নারী ব্যাতিত কল্পনাও করা যায় না, সে সমাজে ইভটিজিং একটি ব্যাধিতে পরিনত হয়েছে।

 

২০০৯-১০ সালের দিকে ইভটিজিং এর ভয়াবহতা এতটাই প্রবল ছিল যে সরকার ইভটিজিং প্রতিরোধ দিবস পালন করার সিদ্ধান্ত নেয়। ১৩ই জুন পালিত হয় ইভটিজিং প্রতিরোধ দিবস। তবে এই দীর্ঘদিন যাবৎ আমরা কি আসলে এর প্রতিরোধ করতে পেরেছি? আমরা কি পেরেছি এ দেশের নারীদের নিরাপত্তা দিতে? কতটুকু পেরেছি?
ইভটিজিং প্রতিরোধ দিবসকে সামনে রেখে নিজেদের অভিমত জানিয়েছেন দেশের স্বনামধন্য চার বিশ্বিবদ্যালয়ের চারজন শিক্ষার্থী।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড বায়োটেকনোলজি বিভাগের ১ম বর্ষের মেধাবী ছাত্র আশিকুর রহমান বলেছেন, “ইভটিজিং শব্দটা আমাদের দেশের মেয়েদের জন্য খুবই পরিচিত একটি শব্দ। ইভটিজিং এর শিকার হয়নি এমন মেয়ের সংখ্যা প্রায় হাতে গোনা কয়েকজন। প্রশ্ন হলো আমাদের সুস্থ জীবনযাত্রার মাঝে ইভটিজিং নামক ব্যাধি টা কিভাবে প্রবেশ করলো? এর অনেক গুলো উওর আছে। আমার উত্তরটা একটু অন্যভাবে দেয়ার চেষ্টা করি।

 

আমাদের দৈনন্দিন জীবনে আমরা বিনোদনের আশ্রয় হিসেবে অবসর সময়ে নাটক সিনেমা দেখে কাটাই। একটু খেয়াল করে চিন্তা করলে দেখবেন বেশির ভাগ নাটক সিনেমার প্লট সাজানো হয় শুরুতে একটা ইভটিজিং এর সূচনা দিয়ে। হয়তো আমাদের সুশীল সমাজ সেটাকে রোমান্স বলে চালিয়ে দিতে প্রস্তুত। নাটক সিনেমার গল্পের একজন লেখক থাকেন, তিনি সুকৌশলে ওই ইভটিজিং কে পরবর্তী প্লটে প্রেমে পরিণত করেন। এখান থেকে আমাদের যুবসমাজ এটাই শিখে যে, কয়েকদিন একটা মেয়ের পেছনে হান্ড্রেড সিসি এর বাইক আর একটা ডিএসএলআর নিয়ে ঘুর ঘুর করে কয়েকটা কবিতা, গান আর পিক আপ লাইন ছুঁড়ে দিয়ে একটা মেয়েকে নিজের প্রতি আকৃষ্ট করতে হয়। কিন্তু ওই যে সিনেমার গল্পের লেখক থাকলেও এই গল্প লেখক বিহীন। তাই বাস্তবতা সিনেমার গল্পের মতো প্রেম আনে না, আনে একটা মেয়ের জীবনে মুখ লুকিয়ে অন্ধকারে বালিশ চাপা দেয়া কান্না। আজ যেই রাস্তার মোড়ে আপনি অন্যের বোন কিংবা মেয়েকে উত্যক্ত করছেন, কাল সেই মোড় দিয়ে আপনার বোনও চলাচল করবে। তখন তার কিছু হলে ধাক্কা টা সামলাতে পারবেন তো? দৃষ্টিভঙ্গি বদলান, সমাজটা বদলে যাবে।”

 

Post MIddle

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিন্যান্স বিভাগের ১ম বর্ষের ছাত্রী তানজিলা তাবাসসুম অন্তি বলেছেন, “সমাজে হাজার রকমের মানুষের বাস কিন্তু তাদের মধ্যে এমন কোনো নারী নেই যে বলবে সে কখনো কারোর দ্বারা ইভটিজিং এর শিকার হয়নি। প্রতিটি নারীকে প্রতিনিয়ত ইভটিজিং এর শিকার হতে হয়। আমাকেও এর মুখোমুখি হতে হয়। এই ইভটিজিং এর পিছনে আছে শক্তির খেলা, যে খেলাতে সমাজ পুরুষকে শক্তিশালী করে দেয় আর নারীদের করে দেয় দূর্বল। যুগ আধুনিক হলে কি হবে, মানুষের চিন্তাধারা আধুনিক হয়নি। এখনো কোনো মেয়ে ইভটিজিং এর শিকার হলে তাকেই প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়। তাকে দোষারোপ করে চুপ করিয়ে দেয়া হয়। কিন্তু কখনো কোনো ছেলেকে কিছু জিজ্ঞেস করা হয় না। আমাদের দেশে এর জন্য আইন রয়েছে, কিন্তু সমাজ যতদিন আধুনিক না হবে, নারীপুরুষ দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন না হবে, পরিবার তার মেয়েদের চুপ না করিয়ে প্রতিবাদের ভাষা শিখাবে, নারীরা প্রতিবাদের হাত তুলে এগিয়ে না আসবে, ততোদিন ইভটিজিং বন্ধ হবে না। আমার মতে সচেতনতা, দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন এবং আইনের সহযোগিতার মাধ্যমেই ইভটিজিং বন্ধ করা সম্ভব।”

 

চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইলেক্ট্রিক্যাল এন্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ১ম বর্ষের মেধাবী ছাত্র সাইমুন মাহামুদ সাগর মনে করেন আইনের কঠোর প্রয়োগ ব্যাতিত ইভটিজিং বন্ধ করা সম্ভব নয়। তিনি বলেছেন, “বর্তমান সময়ে বিশ্বে বাষ্পের মতো ইভটিজিং ছড়িয়ে পড়ছে কিশোরদের শিরায় শিরায়। দিন দিন ভয়াবহ আকার ধারন করছে। নৈতিকতা হারিয়ে ফেলা কিশোরাই এসব কাজে জড়িয়ে পড়ে। এদের কারনে মেয়েদের একা ছাড়তে বাবা মায়েরা। প্রচন্ড ভয় পায়, কখন তাদের মেয়ে ইভটিজিং এর শিকার হয়। ইভটিজিং এর কারনে মেয়েরা লেখাপড়া বন্ধ করা থেকে শুরু করে, আত্মহননের পথও বেছে নিচ্ছে। প্রকাশ্যে ইভটিজিং করলেও কেউ সাহস করে তা প্রতিহত করে না। আর কেউ করতে গেলে উল্টো তার উপর ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে ইভটিজাররা। সংবিধানে আইন আছে কিন্তু তার কঠোর প্রয়োগ নেই। আইন দিয়ে কিছু হবে না, যদি না তার কঠোর প্রয়োগ হয়। এখনো সময় আছে, শক্ত হাতে লাগাম ধরে এই সামাজিক ব্যাধি প্রতিরোধ করতে হবে। না হয় ভবিষ্যৎ এ এটি আরও মারাত্মক আকার ধারন করবে।”

 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গনিত বিভাগের ১ম বর্ষের ছাত্রী তাহনিয়া নুজাইফা মনে করেন ধর্মীয় অনুভূতি থাকলে কোনো পুরুষ ইভটিজিং করতে পারে না। তিনি বলেন, “ইভটিজিং মূলত প্রকাশ্যে যৌন হয়রানি, পথেঘাটে উত্ত্যক্ত করা কিংবা পুরুষ দ্বারা নারী নির্যাতনের নির্দেশক একটি শব্দ। বর্তমান বিশ্বে এটি অন্যতম একটি সমস্যা। একসময় সমাজের বখে যাওয়া একটি ক্ষুদ্র অংশ ইভটিজিং এর সাথে জড়িত থাকলেও এখন উঠতি বয়সী কিশোর-যুবকরা তো আছেই, অনেক মধ্যবয়সীরাও এর সাথে জড়িয়ে পড়েছে। বর্তমানে পুরুষ কর্তৃক নারীরা উত্ত্যক্ত হওয়ার পরও দোষ নারীর উপরই বর্তায়। কিছু বিশিষ্ট ব্যাক্তি বর্গ ইভটিজিং এর প্রধান কারন হিসেবে নারীর পোশাককে দায়ী করে। কিন্তু তাই বলে পুরুষরা তাদের অপরাধের কোনো শাস্তিই পাবে না? একটি কথা শিকার করতে বাধ্য, বর্তমানে অধিকাংশ মেয়েরাই তাদের পোশাকের ব্যাপারে সচেতন নন। একটি মুসলিম প্রধান দেশের নাগরিক হিসেবে বলছি, শতকরা ৭০ ভাগ মেয়েরাই তাদের পোশাক সম্পর্কে অনাবগত। কিন্তু তাই বলে কোনো ধর্ম বা সামাজিক রীতিনীতিতে বলা নেই যে পোশাকের কারনে নারীর প্রতি সহিংসতা প্রকাশ করতে হবে। অধিকাংশ পুরুষই ইভটিজিং এর মত অপরাধ করে শাস্তি থেকে রেহাই পেয়ে যায়, আবার অনেক পুরুষ একে তেমন কোনো অপরাধই মনে করেন না। তাদের জন্য কুরআন ও হাদীস থেকে কিছু বলি,যারা ইচ্ছা করে যে, মুসলমানদের মধ্যে নির্লজ্জতার প্রচার হোক, তাদের জন্য দুনিয়া ও আখিরাতে রয়েছে যন্ত্রনা দায়ক শাস্তি যা তোমরা জানো না। [সুরা নুর – ১৯]
বুরাইদা (রাঃ) হতে বর্নিত, তিনি বলেন রাসুলুল্লাহ (সাঃ) আলী (রাঃ) কে লক্ষ্য করে বলেন, হে আলী, কোনো অপরিচিতা মহিলার ওপর দৃষ্টি পড়ে গেলে তা ফিরিয়ে নিবে এবং দ্বিতীয়বার তার দিকে দৃষ্টিপাত করবে না। কেননা প্রথম দৃষ্টিটা তোমার আর দ্বিতীয়টা তোমার নয় (বরং শয়তানের)। [আবু দাউদ]

রাসুল (সাঃ) বলেন, যে ব্যাক্তি কোনো অপরিচিত নারীর প্রতি যৌন লোলুপ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে, কিয়ামতের দিন তার চোখে উত্তপ্ত গলিত লোহা ঢেলে দেওয়া হবে। [ফাতহুল কাদীর]
নারী বা পুরুষ আমাদের সবার উচিত শালীনতা বজায় রেখে চলাফেরা করা, বিকৃত চিন্তাভাবনা দূর করা। আমরা সবাই সুস্থ মানসিকতা নিয়ে এগিয়ে গেলে সমাজ থেকে ইভটিজিং সহ অন্যান্য ব্যাধি দূর হবে ইনশাআল্লাহ।”

 

চারজন শিক্ষার্থীর চার রকমের ধারনা থেকে স্পষ্ট যে সমাজকে আজও ইভটিজিং নামক মহামারী গ্রাস করে নিচ্ছে। যে দেশে প্রতি ৬ ঘন্টায় একজন নারী ধর্ষিত হয়, যে দেশে নবজাতক থেকে শুরু করে ৮০ বছরের বৃদ্ধা ধর্ষিত হয় সে দেশ, সে জাতি কীভাবে উন্নতি করবে! সত্যি কথা হলো ইভটিজিং এর জন্য নারীদেরকে যেসব দোষ দেয়া হয় তার কোনোটাই দোষ না, দোষী আমরা, দোষী আমাদের মানসিকতা, দোষী এ সমাজ। যারা ইভটিজিং এর সাথে জড়িত না, তারাও কিন্তু নির্দোষ নন। কারন একটি সামাজিক অপরাধের দায় পুরো সমাজকে নিতে হয়। এই অপরাধের দায় আমার-আপনার। তাই আসুন সবাই সচেতন হই। যেখানেই অপরাধ সেখানেই প্রতিবাদ। ইভটিজিং প্রতিরোধ দিবসে সবার প্রত্যয় হোক এটাই।

কামরুজ্জামান শানিল: শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।

পছন্দের আরো পোস্ট