প্রয়োজন স্বাস্থ্য খাতের সংস্কার ও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা
ড. মোঃ তাজউদ্দিন সিকদার
করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ এবং মৃত্যুর দিক থেকে চীনকে ছাড়িয়ে গেছে ইতালি এবং স্পেন। বাংলাদেশে স্থানীয় সংক্রমণ পরিলক্ষিত হচ্ছে এবং সংক্রমণের দিক থেকে বাংলাদেশ দ্বিতীয় স্তরে প্রবেশ করেছে এবং তৃতীয় স্তরের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। করোনা মোকাবেলায় এই মুহূর্তে মূল সংকট পর্যাপ্ত নিরাপত্তা সরঞ্জাম না থাকা এবং রোগ নির্ণয়ের সক্ষমতা না থাকা। যা করোনা মোকাবেলায় গত দু’মাসে আমাদের পর্যাপ্ত পদক্ষেপের অভাবকে বারবার সামনে নিয়ে আসছে।
তবে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস উপলক্ষে জাতির উদ্দেশ্যে দেওয়া ভাষণে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নাগরিকদের রক্ষা করার অঙ্গীকার আমাদের ভেতর আশার সঞ্চার করে, আমাদেরকে সংকল্পবদ্ধ করে। তিনি অর্থনৈতিক প্রণোদনার ঘোষণা দিয়েছেন। করোনা মোকাবেলায় পর্যাপ্ত আইসোলেশন সেল, স্বাস্থ্যকর্মীদের সুরক্ষা সরঞ্জামসহ সরকারের অন্যান্য প্রস্তুতির কথা দৃঢ়তার সাথে বলেছেন। এমনকি বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষেও স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস ভিন্নভাবে পালনের আবেগ বিবর্জিত বাস্তব সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
আমি আশাবাদী ভাইরাসটির বিরুদ্ধে এই সর্বাত্মক যুদ্ধে আমরা জয়ী হবোই। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের আগের পরিস্থিতির বিশ্লেষণে আমি বলব সরকার দুটি জায়গায় সফল।
প্রথমত ১৬ কোটি মানুষের এই দেশে প্রত্যেকের মজ্জার ভেতর একটি বার্তা পৌঁছে গেছে যে সাবধান ও সতর্ক থাকতে হবে। হোম আইসোলেশন, প্রয়োজন ছাড়া বাসা থেকে না বের হওয়াসহ জনসমাগমে মানুষ নিরুৎসাহিত হয়েছে। মানুষের মুখে মাস্ক দেখতে পাচ্ছি, বডি ল্যাঙ্গুয়েজ এর ভেতর সচেতনতা অনুভব করছি।
দ্বিতীয়তঃ সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ৩১ মার্চ এবং পরবর্তীতে ৯ এপ্রিল তারিখ পর্যন্ত বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। সকল অফিস-আদালতে ৪ এপ্রিল পর্যন্ত সাধারণ ছুটি হয়েছে। মানুষ স্বস্তি পেয়েছে। কেন্দ্রীয় কোয়ারেন্টাইন সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে দেওয়ায় তদারকি, শুশ্রূষা ও চিকিৎসায় শৃঙ্খলা আসবে বলে আশা করছি। আইইডিসিআর এর কর্তাব্যক্তিরা যথাসম্ভব কাজ করে যাচ্ছেন, করোনা পরিস্থিতির ওপর নজর রেখে চলছেন।
সরকারের পাশাপাশি কিছু স্থানীয় সংগঠন, প্রতিষ্ঠান এবং অন্যান্যরা তাদের সাধ্যমতো সতর্কতামূলক প্রচারপত্র, হ্যান্ড স্যানিটাইজার ও মাস্কসহ মানুষের পাশে দাঁড়াচ্ছে। কিছুদিন আগ পর্যন্ত আমাদের মূল সংকট ছিল যে ভাইরাসটি সম্পর্কে আমরা তেমন বেশি কিছু জানতাম না। বেশকিছু মিথ প্রচলিত ছিল। এর মধ্যে একটি ছিল উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে কিংবা দূর্ঘটনাবশত ভাইরাসটি কোন ল্যাব থেকে ছড়ানো হয়েছিল।
কিন্তু বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা খুব দৃঢ়তার সাথে এটি নাকচ করে দিয়েছে। এখন বিজ্ঞানীরা মোটামুটি নিশ্চিত যে কোন একটি প্রাণি থেকে এর উৎপত্তি এবং সংক্রমণ হয়েছে। কোভিড-১৯ ভাইরাসটি মূলত একটি আরএনএ ভাইরাস যা অন্যান্য করোনাভাইরাস যেমন সার্স ও মার্স গোত্রের সাথে অনেকাংশে মিলে যায়। পার্থক্য শুধু এক জায়গায় যে এই ভাইরাসটির জীনগত বিবর্তনের কারণে মানুষের শরীরের রিসিপটর সাইট গুলোর সাথে ইফেক্টিভলি বাইন্ড করার ক্ষমতা রাখে যা অন্যান্য করোনা গোত্রের ভাইরাসগুলো রাখত না। যে কারণে এটিকে নোবেল করোনা ভাইরাস বলে। এ
টি অত্যন্ত সংক্রামক এবং প্রতি ১০০ সংক্রমণ আরো ২৫০ জনকে সংক্রমিত করে। ভাইরাসটির জিনোম সিকোয়েন্স আমরা জানি এবং এর প্রতিষেধক টিকার কার্যকারিতা যাচাইয়ে প্রাথমিক পরীক্ষা শুরু হয়েছে। বাংলার জনগণের কাছে ভাইরাস একটি পরিচিত শব্দ।
প্রতি বছরই দেশের সিংহভাগ মানুষ বিভিন্ন ভাইরাসজনিত অসুখ বিসুখে ভোগে যা অতি সামান্য চিকিৎসাতেই নিরাময়যোগ্য। কোভিড-১৯ কেও আমরা স্বাভাবিকভাবে নিয়েছিলাম। ঝামেলা বাধালো উন্নত বিশ্ব এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এটিকে বৈশ্বিক মহামারী আখ্যান দিয়ে। প্রতিবছর অন্যান্য ফ্লু, নন-কমিউনিকেবল ডিজিজ এমনকি রোড এক্সিডেন্টে অনেক মানুষ মারা যায় যা কোভিড- ১৯ এর মৃত্যু হারের চেয়ে অনেক বেশি।
সুতরাং উদ্ভূত পরিস্থিতি আমার ভেতর একটি পরিবর্তনের আশার সঞ্চার করে। অন্ততপক্ষে ১৬ কোটি মানুষ একটি ভাইরাস এবং তার ক্ষমতা সম্পর্কে একটি ধারণা পেল। জনস্বাস্থ্যের শিক্ষক হিসেবে আমি অত্যন্ত আশাবাদী যে অতি দ্রুত হয়তো আমরা এই দুর্যোগ থেকে বেরিয়ে আসবো।
জনস্বাস্থ্য শিক্ষার মূল নীতিগুলির একটি হলো- ‘রোগের প্রতিরোধ করা চিকিৎসার চাইতে ভাল এবং কার্যকরী’। এই নীতির আলোকে জনস্বাস্থ্যগত দিক থেকে কয়েকটি বিষয় উল্লেখ করছি যা ভবিষ্যতে এই ধরনের রোগ প্রতিরোধে অনন্য ভূমিকা রাখতে পারে।
(১)একবিংশ শতাব্দীকে বলা হয় নন-কমিউনিকেবল ডিজিজ যেমন ডায়াবেটিস, স্ট্রোক, ক্যান্সার ইত্যাদি রোগের শতাব্দী। পাশাপাশি ভেক্টর-বর্ন ডিজিজ, কমিউনিকেবল ডিজিজ ও অন্যান্য ট্রপিক্যাল ডিজিজের কর্তৃত্ব ও মৃত্যু আমরা বিশ্বব্যাপী প্রতিবছর দেখতে পাই। নন কমিউনিকেবল ডিজিজ প্রতিরোধে আমাদের সাফল্য প্রশংসনীয়। কিন্তু ভেক্টর-বর্ন ডিজিজ ও অন্যান্য ভাইরোলজিকাল ডিজিজ প্রতিরোধে এখনো আমাদের অনেক কিছু করণীয় আছে।
আইইডিসিআর এর সূত্র মতে গত বছর ডেঙ্গুতে প্রায় ২০০ জন মৃত্যুবরণ করেছেন। এই করোনাভাইরাসের দুর্যোগের ভেতর আরেকটি ডেঙ্গু সময় উপস্থিত। আমাদের প্রস্তুতি কতটুকু? তাছাড়া প্রতিবছর জলবায়ু পরিবর্তন বা অন্য যেকোনো প্রাকৃতিক কিংবা অপ্রাকৃতিক মাধ্যমে ভাইরাস এবং ব্যাকটেরিওলজিক্যাল ডিজিজ গুলো আমাদের কে নিয়মিতভাবে মোকাবেলা করতে হবে।
প্রয়োজন একটি দীর্ঘমেয়াদী প্রস্তুতি এবং পরিকল্পনা। শুধু আইইডিসিআর দিয়ে কাজ হবে না। দেশের স্বনামধন্য হাসপাতালসহ ইউনিয়ন পর্যায়ের স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলো ঢেলে সাজাতে হবে। বাধ্যতামূলকভাবে কোয়ারেন্টাইন এর ব্যবস্থা রাখা এবং প্রয়োজনীয় ট্রেনিং এর ব্যবস্থা করতে হবে।
আইইডিসিআর এর তত্ত্বাবধানে সমগ্র দেশকে একটি নেটওয়ার্কের মধ্যে আনতে হবে যেখানে রোগ নির্ণয়, প্রকৃতি, উৎপত্তিস্থল, প্রতিষেধক, কোয়ারেন্টাইন, যোগাযোগ, জরুরী সেবা, গবেষণা ও আপদকালীন সময় মোকাবেলার জন্য আলাদা আলাদা টিম থাকবে। এই টিমগুলি সারাবছর সক্রিয় থাকবে এবং আপদকালীন সময়ের প্রস্তুতি আগেই নিবে।
আমাদের জনগোষ্ঠীর অধিকাংশই গ্রামকেন্দ্রিক এবং দারিদ্র্যপীড়িত। তাদেরকে সুরক্ষিত না করে, পুনর্বাসনের ব্যবস্থা না করে, রোগ নির্ণয় না করে প্রচলিত আইসোলেশনে সামগ্রিক স্বাস্থ্য রক্ষা হবে না। পাশাপাশি চিকিৎসক-নার্স, জনস্বাস্থ্য কর্মী সহ সংশ্লিষ্ট সকলের পার্সোনাল প্রটেকশন ইকুইপমেন্ট এবং বায়োসেফটি নিশ্চিত করতে হবে। এজন্য প্রয়োজন গোটা স্বাস্থ্য খাতের সংস্কার ও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা।
(২) চারিদিকে একটি সুন্দর কর্ম তৎপরতা শুরু হয়েছে মাস্ক পরিধান, হাত ধোয়া এবং পরিষ্কার পরিছন্নতাকে ঘিরে। এটি সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য। কিন্তু রাতারাতি ১৬ কোটি মানুষকে এই অভ্যাস এর ভিতরে নিয়ে আসাটা কঠিন। মূল চ্যালেঞ্জ হলো করোনার প্রকোপ কমে গেলে এই অভ্যাসটি ধরে রাখা। এই চ্যালেঞ্জটা আমাদের জন্য একটি সুযোগও তৈরি করে দিয়েছে যে মানুষের মস্তিষ্কে চিরদিনের জন্য পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার গুরুত্ব পাকাপাকিভাবে ঢুকিয়ে দেওয়ার জন্য। সুতরাং, চলমান প্রচার প্রচারণা অব্যাহত রাখতে হবে এবং পুরো প্রক্রিয়াটি কে একটি সিস্টেমের মধ্যে নিয়ে আসতে হবে। সবচাইতে গ্রহণযোগ্য সমাধান হলো একটি প্রজন্মকে টার্গেট করা। শিক্ষা কারিকুলামে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার বিষয়গুলোকে আরও উর্বর করা যাতে এই প্রজন্মের হাতে ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ নিরাপদ থাকে।
(৩) এই মুহূর্তে আমাদের একমাত্র ভরসার কেন্দ্র আইইডিসিআর। শুধুমাত্র এই প্রতিষ্ঠানটিকে দিয়ে ১৬ কোটি মানুষকে সেবা দেয়া প্রায় অসম্ভব। এই মুহূর্তে মূল চ্যালেঞ্জ রোগ নির্ণয় করা। এই ক্ষেত্রে আইইডিসিআরের বিশ্বস্ত সহযোগী হতে পারে অনেক প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠান গুলির সক্ষমতা বৃদ্ধিতে আগ্রহী হতে হবে। সরকারি-বেসরকারিভাবে বাংলাদেশ একশটিরও বেশি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে যেখানে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, জিনবিজ্ঞানী, মাইক্রোবায়োলজিস্ট, ভাইরোলজিস্ট রসায়নবিদ, ফার্মাসিস্ট সহ শত শত শিক্ষক এবং গবেষক রয়েছে।
আমি প্রায় নিশ্চিত ভাবে জানি প্রথম সারির বিশ্ববিদ্যালয়গুলির প্রায় প্রত্যেকটি তে এমন গবেষণাগার ও গবেষক রয়েছে যেখানে এবং যারা এই ভাইরাসটি শনাক্ত করনে সমর্থ। আরটি- পিসিআর প্রায় সব গবেষণাগারে আছে। কিছু প্রাইমার, প্রব এবং গবেষণাগারের বায়োসেফটি লেবেল ৩ হলে এখানে রোগ নির্ণয় সম্ভব। তা সম্ভব না হলেও এই বিশাল জনশক্তি আইইডিসিআর কে রোগ নির্ণয়ে সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী সহযোগিতা করতে পারে। সরকারকে আন্তরিক হতে হবে এবং এই সংক্রান্ত গবেষণায় পারদর্শী গবেষকদের একটি তালিকা করতে হবে। দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলি কে কাজে লাগাতে হবে।
আমাদের অভ্যাস এবং চর্চা হলো যেকোনো প্রয়োজনে উন্নত বিশ্বের দিকে তাকিয়ে থাকা। জানতে পেরেছি কোভিড-১৯ শনাক্তকরণের কিট খুবই সাশ্রয়ী মূল্যে স্থানীয়ভাবে তৈরি করা হয়েছে। এই ধরনের তৎপরতা কে উৎসাহ দিতে হবে, পৃষ্ঠপোষকতা করতে হবে। পাশাপাশি ঔষধ, ভ্যাকসিন ও অন্যান্য এনজাইম/প্রোটিন কোম্পানিগুলোকে বাধ্যতামূলক এগিয়ে আসতে হবে। আমি নিশ্চিত, বিদ্যমান পরিস্থিতিতে সারাদেশে এখন সর্বসাধারণের মানসিকতায় আতঙ্কের পাশাপাশি একটা মানসিক দৃঢ়তাও কাজ করছে। যে আমরা ভুল করেছি। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকার অভ্যাস আমাদের ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে আমরা চর্চা করি নাই। এই বোধটুকু কে সর্বদা নাড়াচাড়া করতে হবে, করাতে হবে, যাতে ইহা আমাদের অস্তিত্বের অংশ হয়ে যায়।
আমাদের রাষ্ট্রকেও বুঝতে হবে যে সবকিছু হালকাভাবে নিতে হয় না। দুর্যোগ মোকাবেলায় আমাদের সার্বজনীন এবং দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা রাখতে হবে। করোনা এবং ডেঙ্গুর শিক্ষা, পর্যালোচনা এবং অভিজ্ঞতাই হোক আমাদের ভবিষ্যৎ স্বাস্থ্য পরিকল্পনার মূল অংশ এবং জীবাণু দমন যুদ্ধের হাতিয়ার।
ড. মোঃ তাজউদ্দিন সিকদার।
সভাপতি ও সহযোগী অধ্যাপক পাবলিক হেলথ অ্যান্ড ইনফরমেটিক্স বিভাগ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।