চাকচিক্যময় বিলাসী জীবন দুর্নীতি বৃদ্ধির সহায়ক

শাবিপ্রবি প্রতিনিধি।

চাকচিক্যময় বিলাসী জীবন উপভোগ করার জন্য কিছু মানুষ তার সেক্টরের নিজস্ব বৈধ আয়ের পাশাপাশি অবৈধভাবে অর্থ উপার্জন করছে। এর এই অবৈধ উপার্জনই দুর্নীতিকে ক্রমশ বৃদ্ধি করছে বলে মন্তব্য করেছেন সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি) লোক প্রশাসন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মোহাম্মদ সামিউল ইসলাম। আন্তর্জাতিক দুর্নীতিবিরোধী দিবস-২০১৯ উপলক্ষ্যে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি এসব কথা বলেন।

তিনি বলেন, এই মুহূর্তে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সবচাইতে বেশি দুর্নীতি হচ্ছে বড় বড় উন্নয়ন প্রকল্পগুলোতে, এর পরের অবস্থান প্রশাসনিক ক্ষেত্রে ভূমি প্রশাসনে। সরকার দেশের উন্নয়নের জন্য যেকোনো প্রকল্প গ্রহণ করতে পারে। আবার সেই প্রকল্প বাস্তবায়নে দুর্নীতি রোধে বিধিমালার যথেষ্ট ব্যবহার থাকতে হবে। কিন্তু প্রকল্প বাস্তবায়নকারী লোকেরাই যদি দুর্নীতিকে আশ্রয় দেয় তাহলে সরকারের কেন্দ্রে অবস্থান করে এই দুর্নীতি রোধ করা একদম কঠিন। আমাদের বড় শক্তি হচ্ছে আমাদের দেশের সাধারণ জনগণ। আর এই জনগণই পারে দুর্নীতি প্রতিরোধে সর্বাত্মক কাজ করতে। জনগণই যদি এই দুর্নীতি প্রতিরোধে কথা বলতে না পারে, নিজেদের মাঝে আত্মসচেতনতা তৈরি করতে না পারে তবে কোনোভাবেই দুর্নীতি রোধ করা সম্ভব হবেনা। সরকার এবং সরকারের প্রতিনিধিদের কাজ হচ্ছে উন্নয়ন প্রকল্প এনে দেওয়া। আর সাধারণ জনগণের উচিৎ এইসকল প্রকল্পগুলোর দায়িত্ব গ্রহণ করা। প্রকল্পগুলোতে দুর্নীতিরোধে সচেতন থাকা এবং আওয়াজ তোলার।

তিনি আরও বলেন, উন্নয়ন এবং শাসন এর মাঝে একটি নিবিড় সম্পর্ক আছে। আমি যদি বলি “টেকসই উন্নয়নমূলক কর্মকান্ড” উপহার দেবো, তবে এর আগে আমাকে সুন্দর একটি শাসনব্যবস্থা তৈরি করতে হবে। সেই শাসনব্যবস্থা যদি গণতাতান্ত্রিক হয়, সেখানে স্বচ্ছতার একটা জায়গা থাকে। কারণ গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় জনগণের উপস্থিত থাকে, আর জনগণের উপস্থিতিতে দুর্নীতির পথ এমনিতেই বন্ধ হয়। সেখানে জবাবদিহিতার পথ তৈরি হয়। আমরা যদি দুর্নীতি বন্ধ করে উন্নয়ন ধরে রাখতে চাই তবে অবশ্যই শাসন ব্যবস্থার পথ পরিবর্তন করতে হবে। বর্তমান সরকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে “ডিজিটাল পদ্ধতি” অনুসরণ করা। তথ্য প্রযুক্তিসহ সব প্রশাসনিক কাজে ডিজিটালাইজেশন দুর্নীতি হ্রাস করতে সহায়তা করবে। আমরা যদি লক্ষ্য করি দেখতে পাই যে অতীতে যেকোনো কাজের টেন্ডার বিষয় নিয়ে বড় ধরনের দুর্নীতির আশ্রয় গ্রহণ করা হতো। যা ই-টেন্ডার চালু হওয়ার পর এই টেন্ডার সংক্রান্ত দুর্নীতির বিষয় অনেক কমে গেছে। তবে তাই বলে দুর্নীতি পুরোপুরি হ্রাস পায় নি। প্রতিটা কাজের টেন্ডার হওয়ার পর এর রক্ষণের জন্য একজন বা একাধিক তত্ত্বাবধায়ক থাকতে হবে। সেই সাথে কাজের দায়িত্বগুলো যথাযথ পালন করা, রক্ষনাবেক্ষণ করার ক্ষেত্রে নীতি-নৈতিকতা ঠিক রাখতে হবে।

সহযোগী অধ্যাপক সামিউল ইসলাম বলেন, আমাদের দেশের দুর্নীতি বিষয়ে সচেতনতা তৈরিতে যে প্রতিষ্ঠানটি কাজ করছে তা হল ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। এই প্রতিষ্ঠানটি শুধু বাংলাদেশেই নয়, সারা বিশ্বে কাজ করছে। প্রতিষ্ঠানটি যেকোনো একটি ইস্যুকে কেন্দ্র করে গবেষণার মাধ্যমে দুর্নীতি বিষয়ে কাজ করে। তারা যে কাজটি করে তা হলো “তরুণদের সাথে নিয়ে কাজ করা”। তাদের একটি “ইয়েস গ্রুপ” রয়েছে, যেখানে তরুণদেরকে দুর্নীতির বিরুদ্ধে জাগরণ তৈরি করা হয়। মনে রাখতে হবে জনগণকে সচেতনতার জন্য সবার আগে যুবসমাজকে জাগাতে হবে। সকল বাধা-বিপত্তি, অনৈতিকতা, দূর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস রাখে কেবল এই যুবসমাজেরাই। বড় ধরনের পরিবর্তনের জন্য এই যুবসমাজের অংশগ্রহণ জরুরী। বর্তমানে আমাদের দেশের স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা স্বপ্ন দেখছে আমাদের ভবিষ্যৎ বাংলাদেশটা সম্পূর্ণ দুর্নীতি মুক্ত হবে।

Post MIddle

তিনি বলেন, একটা বিষয়কে প্রতিষ্ঠা করতে হলে যেটা দরকার হয় তা হচ্ছে জনমত, সাধারণ মানুষের সমর্থন। দুর্নীতি প্রতিরোধে আমাদের দেশের সাধারণ মানুষের জনমতই পারে দুর্নীতিকে চিরতরে না বলতে। আর জনমতগুলো তৈরিতে আমাদের দেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো অগ্রণী ভূমিকা পালন করবে। এই সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের অংশ্রহণে দুর্নীতি বিরোধী বিতর্ক প্রতিযোগিতা, সেমিনার, ওয়ার্কসপগুলো সমাজ এবং রাষ্ট্রের মানুষদের চিন্তা ভাবনাতে পরিবর্তন ঘটাতে যথার্থ ভূমিকা রাখবে। কারণ এইসব প্রোগ্রামগুলোতে যেবিষয়গুলো তুলে ধরা হয়, তা শোনার জন্য শ্রোতা তাকে। এছাড়া শ্রোতাব্যক্তিরা এসব প্রোগ্রামগুলোর মাধ্যমে একটি যুক্তিতে পৌছাতে সক্ষম হয়। আর যুক্তিবাদী মানুষ কখনোই অন্যায় এবং দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেয়না। আমাদের ভবিষ্যৎ রাষ্ট্রের মালিকানা আমাদের দেশের বিদ্যাপীঠগুলোর শিক্ষার্থীদের হাতে। তাই ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ রাষ্ট্রের মালিকদের হাতে সঠিক বীজ বপন করতে হলে প্রয়োজন তাদের সঠিক মূল্যবোধ শেখানো। আমি মনে করি বিদ্যাপীঠগুলোতে দুর্নীতি প্রতিরোধমূলক অনুষ্ঠানগুলো সঠিক মূল্যবোধ শেখাতে যথেষ্ট ভূমিকা রাখে।

অতীতের চাইতে বর্তমানে দুর্নীতি দমন কমিশন দুর্নীতি প্রতিরোধে অনেকাংশে অগ্রসর হয়েছে বলে জানিয়ে সামিউল ইসলাম বলেন, ভবিষ্যতের বাংলাদেশের বিনির্মাণে দুর্নীতি দমন কমিশনকে আরও বেশি গতিশীল হতে হবে। কারণ আমাদের সাধারণ মানুষের আশা এবং আকাঙ্ক্ষার জায়গায় দুর্নীতি দমন কমিশন পিছিয়ে আছে। দুর্নীতি দমন কমিশনের কাজের পরিধিকে প্রসারিত করতে হবে। কারণ বড় জনসংখ্যার এই দেশে দুর্নীতি দমন কমিশন কেবল রাজধানী কেন্দ্রিক কাজ করছে। দেশের যেকোনো প্রান্তে এই দুদকের কার্যক্রম দ্রুত পৌছে দিতে হবে। এইজন্য সরকারের উচিৎ এই প্রতিষ্ঠানের প্রতি আরও বেশি সুনজর দেওয়া।

তিনি বলেন, একজন ব্যক্তি নিজে যদি তার মানসিকতা থেকে ব্যক্তি এবং পরিবারকে দুর্নীতির জায়গায় দূরে রাখেন। তবেই কেবল সমাজ এবং রাষ্ট্র দুর্নীতির মতো কালো জায়গার ছায়া দেখার সুযোগ পাবেনা।

উল্লেখ্য, সহযোগী অধ্যাপক মোহাম্মদ সামিউল ইসলামের বাড়ী কিশোরগঞ্জের সদর উপজেলায়। তিনি শাবিপ্রবি হতে ১৯৯৯-২০০০ শিক্ষাবর্ষে পলিটিক্যাল স্টাডিজ এন্ড পাবলিক এডমিনিস্ট্রেশন বিভাগ হতে স্নাতক, ২০০৩-০৪ শিক্ষাবর্ষে পাবলিক এডমিনিস্ট্রেশন বিভাগ হতে স্নাতকোত্তর এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হতে ২০০৮-০৯ বর্ষে “স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা শক্তিশালীকরণে ক্ষমতায়ন, অংশগ্রহণ ও নেতৃত্ব” থিসিস শিরোনামে এম.ফিল করে ২০১৪ তে ডিগ্রি অর্জন করেন।

পছন্দের আরো পোস্ট