অন্ধ মেয়ে মান লিন চিনের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির গল্প
চীনে একটি পরীক্ষা আছে, তা চীনা শিক্ষার্থীদের জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা বলা হয়। আর তা হলো চীনের উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তির পরীক্ষা। অনেক শিক্ষার্থী এই পরীক্ষায় ভালো ফলাফল পাওয়া এবং নিজের প্রিয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির যোগ্যতা পাওয়ার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করে। সেই প্রচেষ্টা আপনারা কল্পনাও করতে পারবেন না। এজন্য তারা অনেক কঠোর পরিশ্রম করেন। কিন্তু আপনি কী জানেন, চীনের অন্ধরা শিক্ষার্থীরাও এই পরীক্ষায় অংশ নিতে পারে এবং লেখাপড়া করার স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে পারে! আজকের অনুষ্ঠানে আমরা এমন একজন মেয়ের গল্প আপনাদের শোনাবো।
দশ বছর আগে আমরা বিশ্বাস করতাম না, অন্ধরা স্বাভাবিক মানুষের মতো উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তির পরীক্ষায় অংশ নিতে পারবে, মাস্টার্স ডিগ্রির যোগ্যতা লাভ করতে পারবে। কিন্তু মান লিন চিন নামে একজন মেয়ে এই অসম্ভব ব্যাপারটিকে সম্ভব করে দেখিয়ে দিয়েছেন।
যদি আপনি জিজ্ঞেস করেন মান লিন চিন কেমন একজন মেয়ে, “শ্রেষ্ঠ’ শব্দটি সবসময় শোনা যায়। মান লিন চিনের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, চীনের লিয়াও নিং প্রদেশের লিয়াও নিং নর্মাল ইউনিভার্সিটির মিউজিক ইন্সটিটিউটের বাদ্যযন্ত্র বিভাগের প্রধান দুয়ান ইয়ান বলেন, মান লিন চিন কেমন একজন ছাত্রী জানতে চান? অনেক সুন্দর শব্দ দিয়ে আমি তার কথা বলতে চাই।’
লিয়াও নিং নর্মাল ইউনিভার্সিটি চীনের সমুদ্রতীরবর্তী শহর তা লিয়ান শহরে অবস্থিত। মান লিন চিনের রুম ছোট, তবে খুব সুন্দরভাবে রুমটি সাজিয়ে দিয়েছেন তার মা। তার টেবিলে ইংরেজি বই, কম্পিউটার, ব্রেইল লিপি টাইপার ও নোটবুক আছে। মান লি চিন ক্লাসরুমের প্রথম সারিতে বসতে পছন্দ করেন। যাতে ভালোভাবে শিক্ষকের কথা শোনা যায়। চীনের শিক্ষামন্ত্রণালয়ের অন্ধ শিক্ষার্থীদের চীনের সাধারণ উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তির পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার অনুমোদন দেয়ার পর লিয়াও নিং প্রদেশের এই পরীক্ষায় পাস করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া প্রথম অন্ধ ছাত্রী মান লিন চিন। ২০১৬ সালের উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভর্তি পরীক্ষায় সারা চীনে শুধু ৫জন অন্ধ শিক্ষার্থী অংশ নিয়েছিল। চীনের ঐতিহ্যবাহী বাদ্যযন্ত্র পিপা-বিষয়ক শিক্ষার্থীর মধ্যে মান লিন চিনের পরীক্ষার ফলাফল লিয়াও নিং প্রদেশের প্রথম দশ জনের মধ্যে ছিল। এই ভালো ফলাফল নিয়ে তিনি লিয়াও নিং প্রদেশের লিয়াও নিং নর্মাল ইউনিভার্সিটির মিউজিক ইন্সটিটিউটের মিউজিক পারফর্মেন্স বিভাগে ভর্তি হন। এখন তিনি আবারও একই বিশ্ববিদ্যালয়ে মিউজিক শিক্ষকের বিষয়ে মাস্টার্স কোর্সে অধ্যয়ন করছেন।
১৯৯৬ সালের ১৮ ডিসেম্বর মান লিন চিন বেইজিংয়ের একটি হাসপাতালে জন্মগ্রহণ করেন। জন্মের সময় তার ওজন ছিল মাত্র ১.৪ কেজি। এটা হলো অনেক কম ওজনের শিশু; তাই জন্মের পর পরই ইনকিউবেটরে রেখে অক্সিজেন দেওয়া হয়। আর এ কারণে তার অক্ষিপটে সমস্যা হয় ও তিনি অন্ধ হয়ে যান।
বিভিন্ন স্কুলে লেখাপড়া করা মান লিন চিনের কৈশোর জীবনের একটি সাধারণ ব্যাপার। প্রাথমিক স্কুলে ভর্তির আগে সে ও অন্য শিশুদের মধ্যে খুব বড় কোনো ব্যবধান ছিল না। মাত্র পাঁচ বছর বয়সে তার পিয়ানো শিখা শুরু হয়, অবশ্য কিছুটা বাধ্য হয়েই। পাঁচ বছর বয়সের শিশুরা খেলাধুলা করতে পছন্দ করে, কিন্তু সেই বয়সে পিয়ানো চর্চা করা অবশ্যই খুব কঠিন ও কষ্টের ব্যাপার। মান লিন চিন বলেন, ছোটবেলায় আমি পিয়ানো শিখতে চাইতাম না। প্রতিদিন বিভিন্ন অজুহাতে পিয়ানো থেকে পালিয়ে বাঁচতে চাইতাম। যেমন, টয়লেটে বেশিক্ষণ থাকা, বার বার পানি খেতে চাওয়া ইত্যাদি।
এরপর তারা লিয়াও নিং প্রদেশের আন মান শহর থেকে হাই ছেং শহরে স্থানান্তরিত হন; তারপর আবার হাই ছেং শহর থেকে শেন ইয়াং শহরে স্থানান্তরিত হন। এরপর তার পরিবার আবার তা লিয়ান শহরে ফিরে আসে।
মান লিন চিনের মা জানান, মাধ্যমিক স্কুলের সময় থেকেই সত্যিকার অর্থে মান লিন চিন সাধারণ শিশুদের থেকে আলাদা হতে শুরু করে। মাধ্যমিক স্কুলের সময়, সে সমবয়সীদের থেকে নিজের পার্থক্য বুঝতে পারে। যেমন, সাধারণ শিশুরা খেলাধুলা করছে, কিন্তু মান লিন চিন জানে না তারা কী খেলছে।
আসলে দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের মধ্যে শিক্ষা-গ্রহণ-করা মানুষ খুব কম। তাদের মধ্যে বেশির ভাগই অন্ধ স্কুলে লেখাপড়া করে। চীনের প্রতিবন্ধী কমিশনের প্রকাশিত পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১৮ সালে চীনে বিশেষ শিক্ষার উচ্চ বিদ্যালয়ের সংখ্যা ছিল ১০২টি, শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৭৬৬৬জন, তাদের মধ্যে ২০৫৬জনই অন্ধ। কয়েক বছর আগে, অন্ধ স্কুল সত্যিকার অর্থে উচ্চ শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে সংযুক্ত ছিল না। বিশেষ শিক্ষা এবং সাধারণ শিক্ষা ব্যবস্থাও আলাদা ছিল। ২০১৪ সালের আগে, চীনে অন্ধদের জন্য একটি কাজই ছিল, তা হলো মাসাজ করা।
২০১৪ সালকে ‘চীনের অন্ধদের উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তির পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার সূচনার বছর’ বলা যায়। সে বছরের জুন মাসে, ৪৬ বছর বয়সী লি চিন শেং দেশের প্রথম অন্ধ শিক্ষার্থী হিসেবে উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিয়েছেন। সেই পরীক্ষা কক্ষে শুধু তিনি একাই ছিলেন। তিনি ব্রেইল লিপি দিয়ে পরীক্ষা দিয়েছেন। আসলে অন্ধদের এমন পরীক্ষায় অংশ নেওয়া সম্বন্ধে সমাজে কিছু ভুল বোঝাবুঝি আছে: কেউ বলে, অন্ধরা কেন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবে, কী দরকার? যত তাড়াতাড়ি সম্ভব একটি চাকরি খুঁজে নাও, জীবন নিশ্চিত হবে।
কিন্তু লি চিন শেং উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভর্তি পরীক্ষায় ব্যর্থ হন। তবে, অন্ধ শিক্ষার্থী হিসেবে এ পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করা ভালো ফলাফল অর্জনের চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এভাবে অন্ধ শিক্ষার্থীরা সাধারণ শিক্ষাব্যবস্থায় যুক্ত হতে পারেন।
২০১৭ সালের ১ মে চীনের ‘প্রতিবন্ধী শিক্ষা নিয়োগবিধিতে’ বলা হয়: প্রতিবন্ধীরা দেশের উচ্চশিক্ষার পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার সময় যদি প্রয়োজনীয় সুবিধা চায়, তাহলে সে আবেদন করতে পারবে। উচ্চশিক্ষার পরীক্ষা সংস্থা ও স্কুল দেশের সংশ্লিষ্ট নিয়ম অনুযায়ী সুবিধা দিতে বাধ্য থাকবে। আরও বেশি অন্ধ শিক্ষার্থী উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভর্তি পরীক্ষা দিতে দাঁড়াচ্ছে, এই অসম্ভব স্বপ্ন এখন সম্ভবে পরিণত হয়েছে।
মান লিন চিন বলেন, যদি আমি অন্ধদের মাসাজ শিখি, তাহলে আমি নিশ্চয়ই খুব খারাপ করব। কারণ, আমি সত্যি মালিশ করতে পারি না, বুঝতেও পারি না। সাধারণত, অন্ধ স্কুলে বিশেষ শিক্ষা গ্রহণকারী শিক্ষার্থীরা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রথম বছর থেকে মালিশ শিখতে শুরু করে। তবে মান লিন চিন নিজের জীবনের জন্য এ কাজ পছন্দ করেন নি। এমন চাকরি না-করে নিজের জীবনের পথ বাছাই করার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। যদিও তখন তার ভবিষ্যত জীবন সম্পর্কে তার নিজের কোনো স্পষ্ট পরিকল্পনা ছিল না, তবে একটি বিষয় স্পষ্ট ছিল। তা হলো ভালোভাবে লেখাপড়া করা।
প্রাথমিক স্কুলের চতুর্থ বছর থেকে মান লিন চিন বড় ভাইয়ের সঙ্গে স্কুলের বাইরে ইংরেজি শিখতে শুরু করেন। ভাইয়ের চেয়ে মান লিন চিন আরও বেশি চেষ্টা করে এই পর্যায়ে পৌঁছেছেন। তবে, তিনি কখনই কঠিনতার কাছে নতি স্বীকার করেন নি।
পরিবারের সমর্থনের পাশাপাশি মান লিন চিন উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার জন্যও অনেক প্রস্তুতি নেন। তাঁর পরীক্ষার জন্য তা লিয়ান বিশেষ স্কুল তার জন্য বিশেষভাবে একজনের প্রস্তুতি ক্লাস চালু করে। চারজন শিক্ষক তাকে সাহায্য করতেন। খুব কম অন্ধ শিক্ষার্থী এমন পরীক্ষায় অংশ নেয়। তাই পরীক্ষার অনেক কাগজকে ব্রেইল লিপিতে অনুবাদ করে প্রিন্ট দিতে হয়। একটি পরীক্ষার কাগজ অনুবাদ থেকে প্রিন্ট পর্যন্ত অনেক সময় লাগে। আর উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি পরীক্ষার কাগজ সাধারণত ৪০ বা ৫০ পৃষ্ঠার হয়ে থাকে।
অন্ধ স্কুলের অন্যান্য শিক্ষার্থীর তুলনায় মান লিন চিনের লেখাপড়া খুব ভালো। তিনি শুধুই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন। তিনি বলেন, আমি এবং আমার পরিবার প্রস্তুতি নিয়েছি, আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে চাই।
মান লিন চিনের সঙ্গে আলাপের সময় তিনি বার বার ‘সাধারণ মানুষ’ এবং ‘সীমাবদ্ধ’ শব্দ দুটি উল্লেখ করেন।
তার কথায়, সাধারণ মানুষ এবং অন্ধ মানুষ সবসময় বিপরীত মেরুতে থাকে। তিনি বলেন, আসলে আমিও জানি না আমি কি করতে পারি। তবে আমার মনে হয়, বেশি শিখলে, সুযোগ বাড়বে। আমার মনে হয়, অন্ধ মানুষদের উচিত সাধারণ মানুষের চেয়ে আরও ভালো হওয়া। শুধু এভাবেই আমাদের সুন্দর ভবিষ্যত্ অর্জন সম্ভব হতে পারে।
বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়ার সময়, মান লিন চিন সাধারণ শিক্ষার্থীদের চেয়ে অনেক বেশি সময় ব্যয় করতেন। বিশেষ করে যদি শিক্ষক ব্ল্যাকবোর্ডে কিছু লিখতেন তা ‘অনুবাদের’ পর সে বুঝতে পারত।
বিভিন্ন ছবিতে দেখা যায়, মান লিন চিন সবসময় হাসেন। জীবনে এত অসুবিধা নিয়েও তিনি তা সমাধানের চেষ্টা করতেন। তিনি বলেন, মানুষ ধারণা করে, অন্ধ মানুষের অনেক সীমাবদ্ধতা আছে। আমার মনে হয় তা ঠিক না। দীর্ঘসময় ধরে, সবাই মনে করে যে ‘সীমাবদ্ধ’ শব্দটি শুধুই প্রতিবন্ধীদের জন্য। আসলে প্রত্যেক মানুষেরই সীমাবদ্ধতা আছে। তা ছাড়া, সাধারণ মানুষের চেয়ে আমার খুব বেশি একটা পার্থক্য নেই।
যুগের উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবন্ধী ও সাধারণ মানুষের পার্থক্য ধীরে ধীরে দূর হয়ে যাচ্ছে। ঠিক যেমন দশ বছর আগে, আমরা বিশ্বাস করতে পারতাম না যে, অন্ধ মানুষও উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিতে পারে। তবে মান লিন চিন তা বাস্তবায়ন করে দেখিয়েছেন।
সিআরআই অনলাইন এর সৌজন্যে