জাফলং ভ্যালি বোর্ডিং স্কুল

প্রকৃতিকন্যা জাফলং। সিলেটের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এক স্বপ্নিল লীলাভূমি। ওপারে খাসিয়া জৈন্তা পাহাড়, এপারে পিয়াইন নদী। সবুজ পাহাড়ের বুক চিরে বয়ে চলেছে শীতল ঝর্ণা, আর নদীর বুকে স্তরে স্তরে সাজানো নানা রঙের নুড়ি পাথর। আকাশের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে পাহাড়। পাহাড়ের গায়ে নরম তুলার মতো ভেসে বেড়াচ্ছে সাদা সাদা মেঘরাশি। দৃষ্টিনন্দন এমন প্রকৃতির কোলে গড়ে উঠেছে দেশের এক অপূর্ব বিদ্যানিকেতন। নাম তার ‘জাফলং ভ্যালি বোর্ডিং স্কুল।’

শিক্ষক ও শিক্ষার্থী সবার জন্য শতভাগ আবাসিক সুবিধা নিয়ে গড়ে ওঠা দেশের প্রথম এই বিদ্যাপীঠ মাত্র এক বছর আগে যাত্রা শুরু করেছে। শিক্ষার মান আর সহপাঠমূলক কার্যক্রমের মাধ্যমে এরই মধ্যে দেশবাসীর দৃষ্টি কাড়তে সক্ষম হয়েছে ভিন্নধর্মী এই শিক্ষালয়টি। খ্যাতনামা শিক্ষানুরাগী কয়েকজন ব্যবসায়ীর সার্বিক প্রচেষ্টায় হাঁটি হাঁটি পা পা করে চলতে শুরু করা জাফলং ভ্যালি বোর্ডিং স্কুল পরিচালিত হচ্ছে দেশি শিক্ষাক্রমে। এখানে বাংলার পাশাপাশি ইংরেজি ভার্সনেও শিক্ষার্থীদের পাঠদান করা হয়। মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করতে রয়েছেন এক ঝাঁক নিবেদিতপ্রাণ দেশি-বিদেশি শিক্ষক।

এখন পর্যন্ত বিদ্যালয়টিতে কেবল ছাত্রদের ভর্তি করা হচ্ছে। ভবিষ্যতে ছাত্রীদের অন্তর্ভুক্ত করার পরিকল্পনাও রয়েছে। ভারতের মেঘালয় রাজ্যের সীমান্ত ঘেঁষে এ বিদ্যালয় গড়ে উঠেছে দার্জিলিংয়ের বোর্ডিং স্কুলগুলোর আদলে। পাহাড়, টিলা আর সবুজের সমারোহে ১৫০ একর জায়গাজুড়ে গড়ে উঠেছে এ স্কুল। এখানে রয়েছে ৬৫টি ক্লাসরুম, ৪টি অত্যাধুনিক ল্যাবরেটরি, ৬টি খেলার মাঠ, ৩টি হোস্টেল ব্লক, ইনডোর গেমসের ব্যবস্থা, স্টাফ কোয়ার্টার, মসজিদসহ নানা স্থাপনা।

সিলেট জেলার জৈন্তাপুর উপজেলার শ্রীপুরে সিলেট-তামাবিল মহাসড়কের পাশেই সম্পূর্ণ আবাসিক এ স্কুলের অবস্থান। সম্প্রতি স্কুলটিতে গিয়ে প্রবেশ ফটক  পেরিয়ে একটু এগোলেই চোখে পড়ল একেক পাহাড়ের চূড়ায় একেক ভবন। কোথাও একাডেমিক ভবন, আবার কোথাও ছাত্রদের হোস্টেল। টিলা অবিকল রেখে গড়ে তোলা হয়েছে স্কুলের একাডেমিক ভবন, হোস্টেল ও ডরমিটরি। আবার স্কুল ক্যাম্পাসেই টিলার ফাঁকে ফাঁকে রয়েছে চা বাগান। প্রকৃতির এমন অপরূপ রূপে পরিপূর্ণ শিক্ষা পাচ্ছে স্কুলের শিক্ষার্থীরা।

জাফলং ভ্যালি বোর্ডিং স্কুলের প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে রয়েছেন সিলেট-৫ আসনের সংসদ সদস্য আইনজীবী হাফিজ আহমেদ মজুমদার, প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী ইমরান আহমেদ, স্কয়ার গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তপন চৌধুরী, হা-মীম গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ. কে. আজাদ, প্যারাগন গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মশিউর রহমান, ওপেক্স গ্রুপের চেয়ারম্যান এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ. আর. সিনহা, নিট এশিয়ার ব্যবস্থাপনা পরিচালক মতিন চৌধুরী, শারমিন গ্রুপের চেয়ারম্যান এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইসমাইল হোসেন, মাহিন গ্রুপ অব কোম্পানিজের চেয়ারম্যান এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুল্লাহ আল মাহমুদ, রেশানুর চৌধুরী (ঢাকা ব্যাংক), জনসংখ্যা কাউন্সিলের কান্ট্রি ডিরেক্টর ড. উবায়দুর রব, সাফওয়ান চৌধুরী (এম. আহমেদ গ্রুপ), কবির ইয়াকুব (পূবালী ব্যাংক), জকিগঞ্জ উপজেলা চেয়ারম্যান লুকমানুদ্দিন চৌধুরী এবং শিক্ষাবিদ ড. কবির চৌধুরী।

স্কুলের চেয়ারম্যান হাফিজ আহমেদ মজুমদার এমপি জানান, আগামী চার থেকে পাঁচ বছরের মধ্যে এই স্কুলটি সুপরিচিত হয়ে উঠবে। এ স্কুল থেকে এমন শিক্ষার্থীদের বের করতে চাই, যারা ভবিষ্যতে দেশকে ও পৃথিবীকে নেতৃত্ব দেবে। তাদের চাওয়া, দেশের শিক্ষার্থীদের আর কষ্ট করে বিদেশে পড়তে যেতে হবে না। দেশেই যেন তারা আন্তর্জাতিক মানের শিক্ষা পায়।

Post MIddle

সাধারণ বোর্ডিং স্কুলগুলোতে পড়ালেখা হয় ইংলিশ মিডিয়ামে। কিন্তু এই স্কুলটি ব্যতিক্রম। ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত জাতীয় কারিকুলামের অধীনে ইংলিশ ভার্সনে পড়ালেখার সুযোগ রয়েছে এখানে। বিদেশি শিক্ষকরাও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে এ দেশের জাতীয় কারিকুলামে অভ্যস্ত হয়ে গেছেন।

২০১৮ শিক্ষাবর্ষ থেকে যাত্রা শুরু করা এ স্কুলের অধ্যক্ষের দায়িত্ব নিয়েছেন ভারতের খ্যাতিমান শিক্ষক বিরাজ কিশোর ভরদ্বাজ। তিনি জানান, ‘প্রতি বছর বাংলাদেশ থেকে প্রায় তিন হাজার শিক্ষার্থী দেশের বাইরে বিভিন্ন বোর্ডিং স্কুলে পড়তে যায়। বিশেষ করে দার্জিলিংয়েই বেশি যায়। আমাদের লক্ষ্য এদের এদেশেই ধরে রাখা। আমার বিশ্বাস, কোনো অভিভাবক যদি একবার এ স্কুল পরিদর্শন করেন, তা হলে তিনি আর অন্য কোথায়ও যাবেন না। এখানে ন্যাশনাল কারিকুলামে পড়ার সুযোগ পাচ্ছে শিক্ষার্থীরা। সন্তান দেশেই থাকায় অভিভাবকরাও নিশ্চিন্তে থাকতে পারেন।’

অধ্যক্ষ বলেন, ‘এ স্কুলে মানসম্মত শিক্ষা দেওয়ার পাশাপাশি পড়ালেখার খরচটাও মধ্যবিত্তের নাগালে রাখা হয়েছে। টিউশন ফি, স্পেশাল ক্লাস, হোস্টেল, লন্ড্রিসহ সব খরচ মিলিয়ে একজন শিক্ষার্থীর মাসে খরচ মাত্র ২০ হাজার টাকা। সেশন ফি ৬০ হাজার টাকা। এখানে ক্যাডেট কলেজের মতোই নিয়ম-কানুন মেনে চলতে হয়। স্বাস্থ্যসম্মত খাবার ও নাশতা পায় শিক্ষার্থীরা। ছয়টি খেলার মাঠে পর্যাপ্ত খেলাধুলার সুযোগ রয়েছে। সকালে ঘুম থেকে উঠে জগিং করতে হয়। ক্লাসের পাশাপাশি স্পেশাল ক্লাস, কোচিং ও সাংস্কৃতিক চর্চার ব্যবস্থা রয়েছে। সব সময় শিক্ষকদের সাহায্য পায় শিক্ষার্থীরা।’

বর্তমানে স্কুলটিতে ১২০ জন আবাসিক ছাত্র ও ২১ জন শিক্ষক রয়েছেন। প্রিন্সিপালসহ তিনজন ভারতীয় শিক্ষক রয়েছেন। যদিও এখানে প্রায় ৯৫০ জন শিক্ষার্থীর আবাসন সুবিধা রয়েছে। শিক্ষকদের দক্ষতা বাড়াতে হাফিজ মজুমদার ট্রাস্টের রিসোর্স সেন্টারে তাদের নিয়মিত প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।

এক দিন ও এক রাত অবস্থানকালে এ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের পড়ালেখা, থাকা, খাওয়া, খেলাধুলাসহ সবকিছুই প্রত্যক্ষ করার সুযোগ মিলল। শিক্ষার্থীদের ১ নম্বর ডরমিটরি ভবনের ১০৩ নম্বর রুমে গিয়ে কথা হলো অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী শাহীদুল ইসলাম মাহবুবের সঙ্গে। সে জানাল, ‘এখানে প্রথমত প্রকৃতির সান্নিধ্যে লেখাপড়া করছি, বসবাস করছি। দ্বিতীয়ত, আগে একটি বিষয় বুঝতে না পারলে পরের দিনের কোচিংয়ের জন্য ফেলে রাখতে হতো। কিন্তু এখন স্কুল ও স্পেশাল কোচিংয়ের বাইরেও সব সময়ের জন্য শিক্ষক পাচ্ছি। বন্ধুদের সঙ্গে খেলাধুলাও করতে পারছি।’

১ নম্বর ডরমিটরি আবার পদ্মা, মেঘনা, সুরমা ও কুশিয়ারা- এই চার ভাগে বিভক্ত। কথা হয় কুশিয়ারার হাউস মাস্টার এমরান হোসেনের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিলাম। ইসলামিক স্টাডিজে ফ্লার্স্টক্লাস থার্ড হয়েছি। এখন এই স্কুলে শিক্ষকতা করছি। অন্য শিক্ষকরাও মেধাবী ও দক্ষ। শিক্ষার্থীদের যে কোনো সমস্যায় সঙ্গে সঙ্গে সাড়া দিই। ৩০ জন শিক্ষার্থীর পুরো দায়িত্ব আমার। আর স্কুলটির নিয়ম-কানুন ও ব্যবস্থাগত পদ্ধতি এতটাই উন্নত যে, শিক্ষার্থীদের পড়ালেখা নিয়ে নিজেকে ভাবতে হয় না। নিয়মের মধ্য থেকেই সে প্রস্তুত হয়ে ওঠে।’

পছন্দের আরো পোস্ট