সংসার সামলে ৩৯তম বিসিএসে প্রথম
সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজে চিকিৎসাশাস্ত্রে পড়ার সময় বিয়ে হয় নীলিমা ইয়াসমিনের। পড়াশোনার পাশাপাশি সংসারের চাপ। সেই চাপকে তিনি উতরে গিয়ে ফলাফলে হয়েছেন সবার সেরা। আবার সংসারে যখন সন্তানের বয়স চার মাস মাত্র, সে সময় কোলের শিশুকে সামলে দিয়েছেন বিসিএস পরীক্ষা। সেখানেও হয়েছেন প্রথম। যুক্তরাজ্য থেকেও পেয়েছেন বিশেষ স্বীকৃতি। তাঁর এই ফল এখন অনেকের কাছেই অনুপ্রেরণা। সংসার, সন্তান সবকিছু সামলে তিনি পড়াশোনা করেই এসব সফলতা অর্জন করেছেন। ফলে, সেরা হওয়ার পথটা মোটেও মসৃণ ছিল না নীলিমার।
চিকিৎসকদের জন্য ৩৯তম বিশেষ বিসিএসে দেশসেরা হন নীলিমা ইয়াসমিন। এই বিসিএসে ৪ হাজার ৭৯২ জন চিকিৎসক নেওয়া হয়। নীলিমা এখন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে আবাসিক চিকিৎসক হিসেবে কর্মরত।এত কিছু সামলে কীভাবে বারবার সেরা হন, সেই কথা জানতে হাজির হই নীলিমা ইয়াসমিনের সামনে। নীলিমা বলেন, ‘মেডিকেলে যখন তৃতীয় বর্ষে পড়ি, তখন বিয়ে হয়। বিয়ের পর সংসারের চাপ তো আছেই; তবে নিজের পড়াশোনাটা করে গেছি ঠিকমতো। আর তার ফলও পেয়েছি হাতেনাতে। প্রধানমন্ত্রীর হাত থেকে স্বর্ণপদক নিয়েছিলাম সেরা ফলের জন্য।’
নীলিমার জীবনে প্রথম বিসিএস পরীক্ষা ছিল ৩৮তম। এই পরীক্ষার তিন দিন পর এফসিপিএস পরীক্ষা। সন্তানের বয়সও চার মাস। সব মিলে দারুণ এক চাপে ছিলেন তিনি। ৩৮তম বিসিএসের প্রিলিমিনারি পরীক্ষায় পাস করে লিখিত পরীক্ষা দেন। সেখানেও পাস করেছেন তিনি। এফসিপিএসের মতো কঠিন পরীক্ষাতেও পেয়েছেন সফলতা।নীলিমা জানান, ৩৮তম বিসিএসে লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিলেন তিনি। যখন এফসিপিএসের জন্য চেষ্টা করেছিলেন, তখন তিনি অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন। দুটি পরীক্ষাই তখন পাশাপাশি। দুটিতেই উত্তীর্ণ হয়েছেন। যখন ৩৯তম বিসিএসের বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হলো, তখন দেখলেন, তাঁর ৩৮তম বিসিএসের লিখিত পরীক্ষার আগেই ৩৯তমর পরীক্ষা। এর মধ্যে প্রশিক্ষণ নেওয়া, পড়াশোনা, সন্তানকে সামলানো সব মিলিয়ে তাঁর অবস্থা খুব ভালো ছিল না। তাঁরপরও ইচ্ছাশক্তির কাছে দমে যায় সব প্রতিবন্ধকতা। নীলিমা বলেন, ‘৩৯তম বিসিএসের জন্য বেশি প্রস্তুতি নিতে পারিনি। ৩৮তমর জন্যই প্রস্তুতি নিয়েছিলাম। ওই প্রস্তুতি দিয়েই মূলত ৩৯তম বিসিএসে প্রথম হয়েছি।’
নীলিমার পড়াশোনায় ভালো করার অভ্যাস তৈরি হয়ে গিয়েছিল। ঢাকার মুন্সি আব্দুর রউফ স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে ২০০৮ সালে এসএসসি আর ২০১০ সালে ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে বিজ্ঞান বিভাগে পড়াশোনা শেষ করেন। দুটিতেই গোল্ডেন জিপিএ-৫ পান। এরপর ভর্তি হন সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজে।নীলিমার গ্রামের বাড়ি ফেনীতে হলেও বেড়ে ওঠা ঢাকাতেই। বাবা মোহাম্মাদ হানিফ ছিলেন আমেরিকাপ্রবাসী আর মা গৃহিণী। মা-বাবা সব সময় তাঁকে উৎসাহ দিয়েছেন। বাবা ২০১৩ সালে মারা যান। নীলিমার সন্তানের বয়স এখন দুই বছর।নীলিমা ভালো চিকিৎসক হতে চান। চিকিৎসকদের সম্পর্কে মানুষের নেতিবাচক মনোভাব বদলে মানুষ আর চিকিৎসকের মধ্যে ভালো সম্পর্ক তৈরি করতে চান তিনি।
মেডিকেলে ভালো ফলের জন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে স্বর্ণপদক পেয়ে নিজের প্রত্যাশা বেড়ে গিয়েছিল। ছেলে নাহিয়ান হকের বয়স যখন এক বছর, তখন ৩৯তম বিসিএসে অংশ নেন তিনি। পরীক্ষা ভালোই দিয়েছিলেন। বললেন, ‘যখন ৩৯তম বিসিএসের প্রিলিমিনারি পরীক্ষা দিয়ে বের হলাম, তখন মিলিয়ে দেখলাম যে ১৬৪/১৬৫ পাব। মৌখিক পরীক্ষাও দিলাম বেশ আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে। নিজের ফলাফল দেখে কিছুটা অবাক হলেও আবেগে ভাসিনি। ভালো পরীক্ষা দিয়েই তো এ ফল পেয়েছি।’
সম্প্রতি নীলিমার সফলতার পলকে যুক্ত হয়েছে বিশেষ অর্জন। তিনি যুক্তরাজ্যের লন্ডনের রয়েল কলেজ থেকে পড়াশোনার সুযোগ পেয়ে প্রসূতিবিদ্যা (এমআরসিওজি) প্রথম পার্ট শেষ করেছেন। এখন দ্বিতীয় পার্টের জন্য পড়ছেন। এটি পাস করলে সেখানে নিবন্ধিত চিকিৎসক হিসেবে পেশাগত সেবা দিতে পারবেন।নীলিমার স্বামী জিহাদুল হকও চিকিৎসক হিসেব কর্মরত। নীলিমা বললেন, ‘স্বামী চিকিৎসক হওয়ায় তিনি সবকিছুতে সহায়তা করেছেন। বিসিএসে আমার ভালো ফলের কৃতিত্ব তাঁরও।’