ওরাই পারবে নিরাপদ পৃথিবী গড়তে

। পলি শাহিনা ।

আমার জন্ম হয়েছিল ষড় ঋতুর দেশ বাংলাদেশে। বাবা-মা আর ভাই-বোনদের সান্নিধ্যে রুপকথার মত অনিন্দ্য সুন্দর ষড় ঋতুর রঙ, রুপ নিংড়ে নিংড়ে অনুভব করে বেড়ে উঠেছি আমি। যে গ্রামে আমি বেড়ে উঠেছি, যেখানে আমার শৈশব, কৈশোর কেটেছে, সে জায়গার সবগুলো ঋতুর ঘ্রাণ আমার নাকে লেগে আছে আজো। সেসব মধুর স্মৃতিরা মনের দেয়ালে লেপ্টে আছে। গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত, শীত ও বসন্তের দেশ বাংলাদেশের সবকটি ঋতু স্বতন্ত্র বৈশিষ্টের অধিকারী। একটার সংগে আরেকটার রঙ, রুপ, গন্ধের কোন তুলনা হয় না। তবে এক ঋতুর সংগে আরেক ঋতুর রয়েছে হৃদ্যিক সূত্র। যা দেখে ছোটবেলায় মনে হতো অপূর্ব সেতু বন্ধনে তৈরি আমার সোনার বাংলাদেশ। একেক ঋতু একেক রকম সৌন্দর্য নিয়ে হাজির হতো প্রকৃতিতে। কোন ঋতু স্নিগ্ধ তো আবার অন্য ঋতু উৎসবের বার্তা নিয়ে এসে দাঁড়াতো সামনে। প্রতিটি নতুন ঋতুতে পুরনো সব শোক গাঁথা ভুলে মানুষগুলো জেগে উঠতো নব উদ্যমে।

বৈশাখ ও জৈষ্ঠ এই দুই মাস গ্রীষ্মকাল। গ্রীষ্ম দিয়েই শুরু হয় বাংলা নতুন বছরের। শৈশবে মনে আছে, এই ঋতুতে ঝড়ের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতাম। গ্রীষ্মকাল ফলের ঋতু। ঝড়, বৃষ্টির মধ্যে ছুটে যেতাম আমতলায়। বৃষ্টিতে ভিজে আঁজলা ভরে আম নিয়ে জুবুথুবু হয়ে ঘরে ফিরতাম। ঝড়ের দিনে ঠুসঠাস আম পড়ার শব্দ এখনো কানে বাজে। গ্রীষ্মের প্রথম দিন পহেলা বৈশাখের সকাল বেলায়, মায়ের হাতে মাখানো চিড়ামুড়ি সংগে নারিকেল, চিনির স্বাদ এখনো খুঁজে বেড়াই।

বর্ষায় থৈ থৈ পানিতে নৌকা চালিয়ে শাপলা তোলার আনন্দ এখনো চোখ বন্ধ করলেই দেখতে পাই। এই সময় মাঠের মাঝখানে সমবয়সীদের খিলখিল হাসির শব্দ মনের দেয়াল বেয়ে শান্ত ঝর্ণার মত বয়ে যায়। বর্ষা ঋতু এলেই আজো চোখের সামনে ভেসে উঠে কৃষকদের সোনালী আঁশ ঘরে তোলার মনোমুগ্ধকর দৃশ্য। দাদীর হাতে শুকনো মরিচ দিয়ে হেলেঞ্চা শাকের স্বাদ জিভে লেগে আছে যেন এখনো। মূলত, বর্ষাই বাংলাদেশকে সুজলা-সুফলা ও শস্য -শ্যামলা করে তুলেছে।

শরৎকালে ঘরের আংগিনায় ভোরবেলায় ঘাসের ডগায় ফোটা ফোটা শিশির জমে থাকার দৃশ্য আমার চোখে দেখা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সৌন্দর্যের মধ্যে অন্যতম। ঘুম চোখ মেলেই খালি পায়ে শিশির ভেজা ঘাসের উপর প্রজাপতির মতন উড়ে উড়ে বেড়াতাম। মায়ের হাতে বানানো গাছ পাকা তালের পিঠার গন্ধে মৌ মৌ করতো পুরো বাড়ী।

হেমন্তে নবান্ন উৎসবের আনন্দ আজো বুকে বাজে। এই সময় বিকেলের দিকে দিনের তাপমাত্রা কমে যাওয়ায় ঘরের চালে টুপটাপ ছন্দে হিম পড়তো। আম্মা গরম দুধ খেতে দিতেন সন্ধ্যায় পড়তে বসার আগে।

শীতকাল ছিল ভীষণ আরাধ্য। শীতকাল মানেই তাড়াতাড়ি আম্মার বুকের ওমে ঘুমিয়ে পড়ার দিন। সকালের মিষ্টি রোদে পুরনো ভাতের সাথে ( আমরা বলতাম কড়া ভাত) শিম, কপি, মুলা তরকারি দিয়ে ভাত খাওয়ার জন্য উম্মুখ হয়ে থাকতাম। শীতকালে আরো প্রিয় ছিল খেজুরের রস। এই রস থেকে তৈরি হয় বিখ্যাত সুস্বাদু খেজুরের গুড়। আম্মা সে গুড় দিয়ে ভাপা, পাটিসাপটা সহ হরেক পদের পিঠা বানাতেন। পৃথিবীর অনেক শহর ঘুরেছি, অনেক খাবার খেয়েছি, কিন্তু মায়ের হাতে বানানো সেই পিঠার স্বাদ, অন্য কোন খাবার জিভ থেকে মুছে দিতে পারেনি।

বসন্তকাল বাংলা বর্ষপঞ্জির শেষ রিতু। এই রিতুতে প্রকৃতির সৌন্দর্য বেড়ে যায় অষ্টাদশী যুবতীর মতন। নতুন পত্র পল্লবে সুশোভিত হয়ে উঠে চারপাশ। গাছগাছালি থেকে সুমধুর কুহ স্বরে কোকিলের ডাক ভেসে আসে। যে ডাকে প্রাণ দুলে উঠতো নতুন জীবনি শক্তিতে। ঋতুরাজ বসন্তে রক্ত বর্ণের শিমুল, পলাশ, কৃষ্ণচূড়া ফুটতো।

Post MIddle

উপরোক্ত ঋতুগুলোর বর্ণনা আমার স্মৃতি থেকে নেয়া প্রায় ২৫/৩০ বছর আগের কথা। ২০০৯ সালের নভেম্বর মাসে আমেরিকা থেকে দেশে বেড়াতে যাবার আগে শীতকাল ভেবে কিছু গরম কাপড় সংগে নিয়ে যাই। দেশে যাবার পর একদিনের জন্যও গরম কাপড়গুলো ব্যবহার করার প্রয়োজন পড়েনি। এমন কি মাঝেমধ্যে দুপুরবেলায় কিংবা রাতের প্রথমার্ধে ঘরে ফ্যান চালাতে হতো। বিকেল বেলায় টাপুরটুপুর হিম পড়ার শব্দ কানে বাজে নি। আকাশে মেঘেদের এলোমেলো উড়তে দেখেছি। মাঝেমধ্যে বর্ষা কালের মত বৃষ্টি ঝরেছে। খেজুরের রস খুঁজে বের করতে বেশ কষ্ট হয়েছে।

২০০৪ সালের জুন মাসের কথা। দেশে গিয়ে প্রথমেই বাবার কাছে কাঁঠাল খাওয়ার কথা বলেছি। প্রথমে অনেকদিন পাকা কাঁঠাল পাওয়া যায় নি। পরে কাঁঠাল এনেছিলেন বাবা। কাঁঠালের ভেতরে বিছি গুলো ফেটে চারা গজিয়ে গেছে, কোয়াগুলো দেখতে কাঁচা ছিল, পরিপক্ব হয়নি। অথচ, বাবার মুখে শুনেছি, গাছ পাকা কাঁঠাল।

এইতো গেলো দেশের কথা। এবার আসি আমার বর্তমান ঠিকানা নিউইয়র্ক শহরে। প্রথমে নিউইয়র্কে এসে দেখেছি, অগাস্ট মাসের শেষের দিক থেকে শীত অনুভূত হতে। অথচ, এখন নভেম্বর মাসেও ঘরে ফ্যান চালাতে হয়। প্রথম যেবার আমেরিকায় এসেছিলাম, সেবার অগাস্টের শেষের দিকে দলবেঁধে সবাই আপেল বাগানে গিয়েছিলাম। মনে আছে, পাকা টসটসে ব্যাগভর্তি আপেল নিয়ে ঘরে ফিরেছিলাম। এখন সেপ্টেম্বর মাসে আপেল বাগানে গিয়ে কাঁচা-পাকা আপেল দেখতে হয়।

দেশে এন্ড্রু কিশোরের কন্ঠে ‘ ওগো বিদেশীনি তোমার চেরি ফুল দাও, আমার শিউলি নাও ‘ গান শুনে চেরি ফুলের কথা ভাবতাম। চেরি ফুল দেখিনি তখন। নিউইয়র্কে এসে চেরি ফুল দেখে মুগ্ধতায় ডুবে ছিলাম। নানা রঙ আর রুপ নিয়ে বসন্তকে রাংগিয়ে দিতে প্রতি বছর চেরি ফুল ফোটে এই শহরে। গুচ্ছ বদ্ধ গোলাপি, সাদা ও লাল রঙের চেরি ফুল দেখতে খুবি আকর্ষণীয়। নিউইয়র্কে আসার পর থেকে সময় পেলেই মার্চ, এপ্রিলে চেরি ফুলের স্বর্গ রাজ্যে ছুটে যাই। চেরি ফুলের সৌন্দর্য ভাষায় প্রকাশ করা দুরহ আমার কাছে। চেরি ফুলের সৌন্দর্য বর্ণনা করতে গিয়ে জাপানের বিখ্যাত কবি মাতসুও বাশো বলেছিলেন, ‘ মানুষের দুটো জীবনের মাঝখানে আরেকটি সময় আছে, আর সেটি হলো চেরি ফুল ফোটার সময়। ‘

গত বছর এপ্রিল মাসে রুজভেল্ট আইল্যান্ডের চেরি উৎসবে গিয়ে আশাহত হয়ে ফিরে এলাম ঘরে। অগাস্ট গিয়ে সেপ্টেম্বরেও যেমন শীত আসে না, তেমনি মার্চ গিয়ে এপ্রিলেও শীতের তীব্রতা কমে না। তাই চেরি উৎসবে ভালোভাবে চেরি ফুলের -ই দেখা মেলেনা। রুজভেল্ট আইল্যান্ডে গিয়ে মনে হয়েছে, পোয়াতি চেরি গাছগুলো ফুল ফোটাতে না পারার কষ্টে ছটফট করছে।

পৃথিবীজুড়ে প্রকৃতিতে কেন এমন ভারসাম্যহীন অবস্থা দেখা দিয়েছে? ইতিমধ্যে আমরা প্রায় সবাই কম বেশি বিষয়টি জেনে গেছি। জানলেও আমরা বেশীরভাগ মানুষগুলো অবস্থার পরিবর্তনে সচেতন হচ্ছি না। আমার দেখা বাংলাদেশ এবং আমেরিকা এই দুটো জায়গার কথা আমি তুলে ধরলেও, জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব গোটা বিশ্বে তীব্রভাবে পরিলক্ষিত হচ্ছে। বিশেষ করে গত ২০ বছরে এই প্রভাব ছড়িয়ে পড়েছে মারাত্মকভাবে। জলবায়ুর এই পরিবর্তন পৃথিবী তথা গোটা মানব জাতির জন্য অত্যন্ত বিপদজনক। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে কোন বিশেষ দেশ বা জনগোষ্ঠী নয়, বিশ্বব্যাপি ভারসাম্যহীনতা দেখা দিয়েছে সর্বত্র। যা সত্যিই আশংকার বিষয়।

গত ১৯ সেপ্টেম্বর রাতে, আমার একাদশ শ্রেণীতে পড়ুয়া মেয়েকে দেখলাম রঙিন কাগজ কেটে পোষ্টার বানাতে। যে পোষ্টারগুলোতে ইংরেজিতে লেখা ছিল, Save the Trees, Save our Future, Take action now, Save the planet, Stop denying our Earth is dying, Our planet our future, Be part of the solution etcআমার মেয়ে এবং বড় ছেলে দু’জন ব্রংক্স সায়েন্সের ছাত্র। কয়েকদিন ধরে ছেলেটা জ্বর, কাশিতে ভুগছে। একটু ভালো বোধ করায় ছেলে স্কুলে গিয়েছে। কিন্তু ২০ সেপ্টেম্বর শুক্রবার সকাল ৯ টার দিকে স্কুল থেকে নার্সের ফোন কল পেলাম। ছেলেটা শারীরিকভাবে ভালো বোধ করছে না। আমি অনুমতি দিলে ছেলেটা একাই বাসায় চলে আসতে পারতো, কিন্তু মন সায় দিলো না। নার্সকে বললাম, আমি না আসা পর্যন্ত যেন ছেলেকে তাঁর কাছে রাখে।

শরতের স্বচ্ছ নীলাকাশ। আকাশ থেকে রোদ যেন রুপার মত গলে গলে পড়ছে। এমন সময়ে ছেলেকে নার্সের কাছ থেকে তুলে এনে, তার হাত ধরে আমি দাঁড়িয়ে দেখছি, দ্যা ব্রক্সস হাইস্কুল অফ সায়েন্সের অসংখ্য ছাত্র-ছাত্রীরা দলবদ্ধ ভাবে স্কুলের মূল ফটক দিয়ে খোলা রাস্তায় নেমে পড়েছে। জলবায়ু পরিবর্তন প্রতিরোধে নানান রঙের প্রতিবাদ খচিত পোষ্টার হাতে ওরা দলবেঁধে ছুটে যাচ্ছে ম্যানহাটনের সিটি হলের দিকে। গভীর মনোযোগের সহিত আমি ওদের দূর্বার গতির দিকে চেয়ে থাকি অপলক। বাচ্চাগুলোর চোখেমুখে পৃথিবী নামক গ্রহটিকে বাঁচিয়ে রাখার স্বপ্ন চিকচিক করছে। ওরা নিজেরা বাঁচতে চায়, পরবর্তী প্রজন্মকে বাঁচাতে চায়, সর্বোপরি পুরো পৃথিবীকে নিরাপদ আবাসস্থল বানাতে চায়। উল্লেখ্য, গত ২০ সেপ্টেম্বর সুইডেনের ১৬ বছর বয়সী গ্রেটা থানবার্গ এর সংগে একাত্মতা জানিয়ে, ১৫০ টিরও বেশী দেশ জলবায়ু পরিবর্তন সংকট মোকাবেলায় প্রতিবাদ করেছে। জগতের সব দৃশ্য নয়, কিছু কিছু দৃশ্য মানুষকে আপ্লুত করে তোলে। ওদের বুকে খেলে যাওয়া আলোর কম্পন, আমার বুকে এসে লাগে।

সবার জন্য বসবাসযোগ্য নিরাপদ পৃথিবীর স্বপ্নে বিভোর, প্রজাপতির মত উড়তে থাকা বাচ্চাগুলোর দিকে তাকিয়ে আপনমনে বিড়বিড় করতে থাকি, ওরাই পারবে আগামী দিনের নিরাপদ পৃথিবী গড়তে। ওরাই পারবে আমাদেরকে একটি দূষণমুক্ত সজীব পৃথিবী উপহার দিতে।

পছন্দের আরো পোস্ট