শাবিপ্রবির মঞ্চে একাত্তরের স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র

শাবিপ্রবি প্রতিনিধিঃ
বাহিরে কেবল সন্ধ্যা নেমেছে কিন্তু শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি) মিলনায়তনে ভিতরের পরিবেশটা যেন মধ্যরাত। আমাবস্যা রাতের মতো অন্ধকারাচ্ছন্ন নিঃশব্দ মিলনায়তনে মাঝে নিশ্চুপ দর্শক অধীর আগ্রহে তাকিয়ে আছে মঞ্চের দিকে।
এমন সময় মঞ্চে হালকা আলো পড়ায় সকলের চোখে পড়ে অপরাজেয় বাংলার ছবি এবং অন্য পাশে ” শব্দের ঝংকারে বারুদের গন্ধ ” লেখাটি। আর তখনই পাকিস্তানিদের উদ্দেশ্যে স্বাধীন বাংলা বেতারের অনুকরণে বঙ্গবন্ধুর সেই ঘোষণা পাঠ করে “এবারে তোমাদের বিদায় নিতে হবে, তবে অক্ষত অবস্থায় নয়। যে রক্ত এতোদিন তোমরা নিয়েছো সে রক্ত এবার আমরা নিবো।”
এভাবেই শনিবার সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টায় শাবিপ্রবির কেন্দ্রীয় মিলনায়তনে সাংস্কৃতিক সংগঠন শিকড়ের আয়োজনে অনুষ্ঠিত হয়েছিল এক ভিন্নধর্মী আয়োজন “শব্দের ঝংকারে বারুদের গন্ধ”। শিকড় মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণ করে এবং নতুন প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করে। তারই ধারাবাহিকতায় মুক্তিযুদ্ধের সময়কার স্বাধীন বাংলা বেতারের পরিবেশনা গুলোকে কেন্দ্র করে এ আয়োজন করে।
ময়দানে লড়ে যাওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের পাশাপাশি বলিষ্ঠ কন্ঠ দিয়ে যুদ্ধ করে গেছেন কণ্ঠশিল্পীরা, আবৃত্তিশিল্পীরা, সংবাদপাঠকরা। যা জনগণের মনে সাহসের জোগান দিয়েছে। ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলা বেতারে বঙ্গবন্ধুর কথা বাঙ্গালি কাছে পৌঁছে দিতো বেতারকর্মীরা কাজ করেছে। সেই চিত্র তুলে ধরতে মঞ্চে বেতারের অনুকরণে পাঠ করে ” বাঙ্গালি রেজিমেন্ট, ইপিআর, পুলিশ বাহিনী, মুক্তিসেনারা তোমরা এগিয়ে যাও, তোমাদের সাথে রয়েছে বাংলার বিপ্লবী বীর জনতা। এরা সবাই রক্ত দিতে প্রস্তুত আজ এরা রক্ত দেবেই এই প্রতিঙ্গা নিয়ে পাকিস্তানি হানাদারদের উপর এরা আক্রমণ চালাবে।” বঙ্গবন্ধু৷
Post MIddle
এর পরে মঞ্চে সমস্বরে বেজে ওঠে ১৯৭০ সালের মার্চে গাজী মাযহারুল ইসলামে রচিত দেশাত্মবোধক ও জাগরণমূলক সংগীত জয় বাংলা, বাংলার জয় গানটি। যা তৎকালীন স্বাধীন বাংলা বেতারে নিয়মিত গাওয়া হতো। আর এই গান সাড়ে সাত কোটি বাঙ্গালিকে মুক্তিযুদ্ধের সময় উদ্বুদ্ধ করেছিল। এর পরে স্বাধীন বাংলা বেতারে যেভাবে পরিবেশন করা হয়েছিল ঠিক সেভাবে একে একে সমস্বরে গেয়ে উঠে “মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি”,  “জনতার সংগ্রাম চলবেই”,  “গেরিলা, আমরা গেরিলা।” দেশাত্মবোধক গান গুলো।
এর পরেই মঞ্চে আলো নিভে যায়, চারদিকে অন্ধকার। সবাই যেন কল্পনায় একাত্তরে ফিরে গিয়েছে। রেডিও চালু করে আপামর জনতার মতো শোনার জন্য অপেক্ষা করছে কখন এম আর আখতার মুকুলের ঢাকাইয়া ভাষায় উপস্থাপিত হবে “চরমপত্র” পাঠ কিংবা কল্যাণ মিত্রের “জল্লাদের দরবার”। তার একটু পরেই শুরু চরমপত্র পাঠ।
মঞ্চে আবার অন্ধকার। সবার অপেক্ষা স্বাধীন বাংলা বেতারের। হঠাৎ উচ্চারিত হতে থাকে, ১০ ডিসেম্বর। বাংলার স্বাধীনতা এখন অবধারিত সাফল্যের পথে যাত্রা শুরু করেছে। খুলনা, বরিশাল, যশোর, দিনাজপুর রংপুর নোয়াখালী, ময়মনসিংহ, চট্টগ্রাম মুক্তিবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে চলে এসেছে এবং প্রতিটি রণাঙ্গন মুক্তিবাহিনীর উল্লাস ধ্বনিতে মুখরিত। এ খবর শেষ হওয়ার সাথে সাথে সমস্বরে গেয়ে উঠে “পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠছে, রক্ত লাল, রক্ত লাল, রক্ত লাল” গানটি।
সত্যিই স্বাধীনতা খুব কাছে চলে এসেছিল। ঐ ঘোষণার মাত্র ৬দিন পর ১৬ই ডিসেম্বরে দেশ স্বাধীনের খবরটি স্বাধীন বাংলা বেতার ছাড়াও বিবিসির মতো চ্যানেলে শোনানো হয়। আর তখনই স্বাধীন বাংলা বেতারের সুরে মঞ্চে বেজে ওঠে “সব ক’টা জানালা খুলে দাও না” গানটি। তখন মিলনায়তনের দর্শকের কাছে মনে হয়েছিল এ-যেন একাত্তরের সেই স্বাধীন বাংলা বেতার। ভিন্নধর্মী এই আয়োজনের শিল্পীরা বলেন, বাংলাদেশ আজ স্বীকৃত সত্য। বাংলাদেশ আজ প্রতিটি মানুষের হৃদয়ের আর্তে। বাংলাদেশ আজ সকলের হৃদপিণ্ডে বাজবে। বাংলাদেশকে ভালোবাসবো ঠিক যেমনটি আমরা একাত্তরের ভালোবেসে ছিলাম।
চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রে ২৬শে মার্চ ১৯৭১ সালে যাত্রা শুরু করেছিল স্বাধীন বাংলা বেতার। যাত্রা শুরুর পর থেকে নানান চড়াই-উতরাই পার করতে হয়েছিল। সেই চিত্র শিকড়ের আয়োজনে শাবিপ্রবির মঞ্চে তুলে ধরতে সত্যজিৎ পাল, সাজিদ আলম পাটোয়ারী নেতৃত্বে গানে কণ্ঠ দেয় অনিমেষ সাহা, ইনতেখাব আলী সন্দীপন, মোহাম্মদ জুনায়েদ, সাবরিনা শারমিন মৌটুসী, সৌরভ শাহা, আনিকা উর্মি, রাফায়েল কবির। আবৃত্তিতে মেহজাবিন সুলতানা আদরৃতা এবং
বাঁধন হালদারের নেতৃত্বে আবৃত্তি করেন আলকাতুজ জাকিয়া আখি, ফয়সাল সিদ্দিক, জুবায়ের রাফি, সুদীপ্ত সাকিব দুরন্ত, জাহেদুল ইসলাম অপূর্ব, রাফায়েল কবির, সায়েদা, তানজিনা নওসীন, তামান্না বিনতে হাফিজ, জান্নাতুল ফেরদৌস মুন্নী।
পছন্দের আরো পোস্ট