আঠারোর কোঠায় মন নিবন্ধন
মুনিরা প্রীতুঃ
আমেরিকান কবি রবার্ট ফ্রস্ট নাকি কোনো এক তুষারাচ্ছন্ন সন্ধ্যায় হঠাত থমকে দাঁড়িয়েছিলেন বিশাল কোনো এক বৃক্ষের সামনে! আমিও কোনো এক রৌদ্রজ্জ্বল শেষ বিকেলে অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম নাম না জানা এক বিশাল মহিরুহের সামনে। আচ্ছন্ন হয়ে ছিলাম এক আকাশ মিষ্টি রোদ আর এক পৃথিবী ভালোবাসা নিয়ে।
ফ্রস্টের নিউহ্যাম্পশায়ার আর আমার বাংলার মাঝে গুলিয়ে ফেললাম সহজেই! ইংরেজ প্রকৃতিপ্রেমিক ওয়ার্ডসওয়ার্থ আর আমার বিভুতিভুষণ,এই দুজনের ফারাক খুঁজে পেলাম না! ওয়ার্ডসওয়ার্থ সহজলভ্য হওয়ার অনেক আগেই প্রকৃতির প্রেমে পড়েছি আর আরণ্যক যে আমাকে প্রকৃতিপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করেছে তা স্বস্বীকার্য।
অহর্নিশ আমার মাথায় যে জিনিসটা কাজ করে সেটা হলো আমার ভালোবাসার জিনিসগুলোকে খুঁজে খুঁজে বের করা এবং সেগুলোকে স্পর্শ করে আমার ভেতরকার প্রাণপ্রাচুর্য বাড়িয়ে তোলা। কাজটা আমি সচেতনভাবেই করি। ভালোবাসার নাকি যত্ন নিতে হয়, চর্চা করতে হয় নাহলে সেটা হারিয়ে যায়। আগেই বলেছি স্বপ্নরা হারিয়ে গেলে নিজের অস্তিত্বে টান পড়ে আর কোনো কিছুর প্রতি ভালোবাসা, সেতো স্বপ্নেরই নামান্তর।
জহির রায়হানের শেষ বিকেলের মেয়েটার কথা ভাবছিলাম দিনশেষে যে নিজের ভালোবাসাকে খুঁজে নিয়েছিলো। একেক সময় লোকটার লেখনীতে বাধা পড়ে যেতাম। হাজার বছর ধরে উপন্যাসটা হাজার বার পড়া না হলেও অর্ধশতবার পড়েছি সিওর! ওর লেখার যাদুতে বন্দী হয়ে বরফ গলা নদীতে ভাসতেও পিছপা হইনি। একুশের গল্পের তপুর কথা মনে পড়ে গেলো ঠিক এই মুহুর্তে! ব্যাস, এই কয়টা হাতে গোনা বই আমি পেয়েছি ওর কাছ থেকে, সম্পদ হিসেবে। স্টপ জেনোসাইড এখনো দেখা হয়নি! কিন্তু থিমটা জানি।
জহির রায়হান একজন বাঙালি উত্তরসুরীকে অনেক কম সময়ে অনেক কিছু দিয়ে গেলেন, অনেকটা সুকান্তের মতো। সুকান্ত! কাল মার্ক্সের এই অনুসারী থেকে যা পেয়েছি তা বলে বোঝাতে যাওয়াটা বোকামি হবে। লিখে প্রকাশ করা অসম্ভব। ওর বই পড়ার দরকার নেই। নামগুলোই কাউকে অনুপ্রেরণা দিতে পারে! ঘুম নেই, মিঠেকড়া, পুর্বাভাস অথবা ছাড়পত্র। ‘আঠারো বছর বয়স’ কবিতাটা! আমাকে আক্ষরিক অর্থে এগিয়ে চলার অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে। সেই লাইনটা এখনো ভেবে অবাক হই, কতোটা শক্তি থাকতে পারে একটা কবিতার পঙতিতে!
‘আঠারো বছর বয়স জানেনা কাঁদা!’
এইখানে আঠারো বলতে চিরসবুজ প্রাণবন্ত মন বুঝানো হয়েছে। তাইতো আঠারো পেরিয়ে এসে আজও আঠারোর কোঠায় মন নিবন্ধন করে রেখেছি। যখনি ক্লেশ ক্লেদ আসবে জীবনে, আঠারোই হবে আমার ঢাল। সুকান্তের কথা বলে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়কে বাদ দেয়াটা অর্বাচীন পাঠক এর কাজ হবে! মানিকও কম্যুনিজমের প্রেতাত্মাকে তার আত্মা সমর্পণ করেছিলো! মৃত্যুর সময় যার অগোছালো ঘরে পাঁচটা টাকা ছিলোনা। তখনও কিন্তু তার বই প্রকাশ ও বিক্রি হয়েছিলো! গ্রন্থসত্বের টাকা সে নিজে নিতোনা। ওর বইয়ের কপিরাইট দেয়া ছিলো আপামর জনসাধারণ এর উপর! স্ত্রীর মুখে এক মুঠো ভাত তুলে দিতে না পারা ব্যাক্তির এইরকম মহত্ব কোন নীতি থেকে উদ্ভুত তা ভেবে বের করতে যাইনা।
ইংরেজ সাহিত্যিক স্যামুয়েল লেংগহর্ন ক্লেমেন্স যাকে আমরা মার্ক টোয়েন হিসেবে চিনি তার লেখা ছোটগল্পের একটা সংকলন পড়েছিলাম। যা লেখা ছিলো, খাটি হিন্দিতে তাকে বলবো বিলকুল বাকোয়াজ! শেক্সপিয়ার আমাকে নিরাশ করেছে বহু আগেই! হি এন্ড হিজ কো ইন্সিডেন্সেস! মধুসুদন এর মতো ইংরেজ ‘ক্যাপটিভ লেডী’তে আমার আগ্রহ নেই। ও ব্যাটা ভুল বুঝতে পেরেছে অনেক পরে, স্বীকারও করেছে এই বলে-
‘কেলিনু শৈবালে ভুলি কমল কানন’
আমি ভুল করার চান্স পাইনি। অনেক ছোটকালে ঠাকুরমার ঝুলি থেকে হাতেখড়ি নিয়েছি, ননসেন্স ভার্সগুলোকেও আপন করে নিয়েছি খুব ছোট্টবেলায় ইচিং বিচিং চিচিং ছা খেলতে গিয়ে! জেইন টেইলর এর টুইংকাল টুইংকাল লিটল স্টার মুখস্থ করেছি, আত্মস্থ করিনি সম্পুর্ণ অবচেতনতায়! ওসব নিয়েই মোহটা থাকতো যা আমি বুঝতাম,হোক না সেটা ব্যাঙমা ব্যাঙমীর গল্প অথবা কাজলরেখার পালা!
তাইতো ব্যা ব্যা কালো ভেড়ার কাছে লোম চাইতাম ক্লাসে বসে বসে, আর তারপরেই বাসায় ফিরে ডুবতাম ডালিমকুমারের চমৎকার প্রচ্ছদ আঁকা বইতে! পুরো ইংরেজি সাহিত্য হয়তো আমাকে অনেক কিছুই দিতে পারবেনা যা হয়তো আমি পেতে পারি আমার নিজ ভাষার প্রিয় কোনো একটি কবিতার লাইন থেকে! হতে পারে! হয়েছে বৈকি!