প্রতিক্ষা সমাবর্তনের

শাবি প্রতিনিধিঃ

বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া প্রত্যেক শিক্ষার্থী স্নাতক পড়া শেষে গাউন গায়ে চাপিয়ে কালো টুপিটি আকাশে ছুড়ে দেওয়ার স্বপ্ন দেখেন। শিক্ষা জীবন শেষ করা হাজারো শিক্ষার্থীরা আরো স্বপ্ন দেখেন রাষ্ট্রপতির হাত থেকে মূল সনদপত্র সংগ্রহ করার। শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবি) শিক্ষার্থীরা দেশ-বিদেশ জয় করে ফিরলেও ১২ বছর ধরে সমাবর্তন ‘জয় করা’ যেন অধরাই থেকে যাচ্ছে প্রতিবছর।

২০০৭ সালে শেষবার যখন সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হয় তখন স্বপন আহমেদ সপ্তম শ্রেণীতে পড়তেন। মাস ছয়েক আগে তিনি শাবির অর্থনীতি বিভাগ থেকে স্নাতক শেষ করে স্নাতকোত্তরে ভর্তি হয়েছেন। একরাশ হতাশা নিয়েই স্বপন বলেন, শাবির সর্বশেষ সমাবর্তনের বছরে ক্লাস সেভেনে পড়া আমি গত বছর স্নাতক শেষ করেছি। অথচ এতো সময়ের মাঝে শাবিতে আর কোন সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হয়নি।

অথচ অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধুরা সমাবর্তন পেয়ে যখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনুভূতি প্রকাশ করে তখন খুব খারাপ লাগে। শাবির সমাবর্তন নিয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পাশ করা প্রত্যেক শিক্ষার্থীদের কন্ঠে একই হতাশার সুর প্রতিধ্বনিত হয়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শাবির শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন গ্রুপে প্রতিনিয়ত ট্রল তৈরি হচ্ছে সমাবর্তন নিয়ে।

১৯৮৬ সালে প্রতিষ্ঠিত শাবিতে একাডেমিক কার্যক্রম শুরু হয় ১৯৯১ সালে। একাডেমিক কার্যক্রম শুরু হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত ক্যাম্পাসে ২৯টি ব্যাচ এসেছে। এর মধ্যে স্নাতক সম্পন্ন করে বেরিয়ে গেছে ২৪টি ব্যাচ। নিয়ম অনুযায়ী এ সময়ের মাঝে ২৪ বার সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা থাকলেও এপর্যন্ত শাবিতে সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হয়েছে মাত্র দু’বার। অন্য অনেক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনেক পরে প্রতিষ্ঠিত হলেও শাবি খুব অল্প সময়ের মাঝে অর্জনের ব্যাপ্তিতে অন্যান্য অনেক বিশ্ববিদ্যালয়কে ছাড়িয়ে গেছে।

অন্যদিকে একই সময়ে এবং পরবর্তীতে প্রতিষ্ঠিত অন্যান্য সরকারি এবং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সাথে সমাবর্তন আয়োজনের দিকটি তুলনা করে দেখা যায় ২৮ বছরে মাত্র দু’বার সমাবর্তন আয়োজন করতে পারা শাবির ব্যর্থতা গুলোর মধ্যে অন্যতম একটি।

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক সূত্রে জানা যায়, শাবিতে প্রথম সমাবর্তন বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক এম হাবিবুর রহমানের মেয়াদে ১৯৯৮ সালের ২৯ এপ্রিল এবং ২য় সমাবর্তন তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক ড. আমিনুল ইসলামের মেয়াদে ২০০৭ সালের ৬ ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত হয়েছিল।

Post MIddle

১ম সমাবর্তনে ১৯৯১-৯২ সেশন থেকে শুরু করে ১৯৯৪-৯৫ সেশনের মোট চারটি ব্যাচের শিক্ষার্থীদের এবং ২য় সমাবর্তনে ১৯৯৫-৯৬ সেশন থেকে শুরু করে ২০০০-০১ সেশনের মোট ৬টি ব্যাচের শিক্ষার্থীদের সমাবর্তন দেওয়া হয়েছিল। এরপর দীর্ঘ ১২ বছর পার হয়ে গেলেও সমাবর্তন হয়নি আর।

সর্বশেষ সমাবর্তনের পর এ পর্যন্ত ১৩টি সেশনের শিক্ষার্থীরা স্নাতকোত্তর এবং ১৪টি সেশনের শিক্ষার্থীরা স্নাতক সম্পন্ন করেছে। মূল সনদ না পাওয়ায় তারা সবাই সাময়িক সনদ নিয়ে ক্যাম্পাস থেকে বিদায় নিয়ে কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করছেন। মূল সনদ না থাকায় চাকরিতে প্রবেশের পর বিভিন্ন ক্ষেত্রে সমস্যায় পড়েন বলে নিয়মিত অভিযোগ করেন সাবেক শিক্ষার্থীরা।

শাবির সমসাময়িক সময়ে প্রতিষ্ঠিত বেশকিছু বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইট থেকে জানা যায়, ১৯৯১ সালে প্রতিষ্ঠিত খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় ৫ বার, ১৯৮০ সালে প্রতিষ্ঠিত ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় ৪বার, ১৯৭০ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়া জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ৫বার এবং ১৯৫৩ সালে প্রতিষ্ঠিত রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ১০ বার সমাবর্তন আয়োজন করেছে। দেশের উল্লেখযোগ্য বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে ২০০১ সালে প্রতিষ্ঠিত ব্র‍্যাক বিশ্ববিদ্যালয় ১২ বার, ১৯৯২ সালে প্রতিষ্ঠিত নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় ২২ বার ও ২০০২ সালে প্রতিষ্ঠিত ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়ে এ পর্যন্ত ৭ বার সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হয়েছে।

এমনকি ২০১৮ সালের প্রথম থেকে এপর্যন্ত চারটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হয়েছে। তারমধ্যে ২০১৮ সালের ৭ জানুয়ারীতে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে ৪র্থ সমাবর্তন, ২৯ সেপ্টেম্বরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ১০ম সমাবর্তন, ৬ অক্টোবরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ৫১তম সমাবর্তন এবং সর্বশেষ ২০১৯ সালের ১৯ মার্চ বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হয়েছে।

শাবির সমাবর্তন এখন সময়ের দাবিতে পরিণত হয়েছে। যেকোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হওয়ার পরে শাবির সাবেক এবং বর্তমান শিক্ষার্থীরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ক্ষোভ ও দুঃখ প্রকাশ করেন। শাবির সমাবর্তন নিয়ে শাবির সমাজকর্ম বিভাগের ২০০৩-০৪ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী মোহাম্মদ মুকিত-উল হাফিজ বলেন, ক্যাম্পাসে না ফেরার অভিমান পুষেই খুব করে চাইছি যে, এইতো সামনের বছরে সমাবর্তন হবে, তখন তো যাবো।

হায় প্রতীক্ষা! ২৯ বছরের ইতিহাসে মাত্র দু’বার সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হয়েছে। ২০০৭ সালের শেষবার সমাবর্তন যখন হয় তখন আমি স্নাতক তৃতীয় বর্ষের ছাত্র হিসেবে বাইরে থেকে দেখে উপভোগ করেছি তাই হয়তো আক্ষেপটা একটু বেশি। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের এত অসাধারণ অর্জনের মাঝে সমাবর্তন একটা অপূর্ণতা। অপেক্ষার এক যুগ পেরিয়ে গেল, জানিনা এই প্রতীক্ষার শেষ কোথায়?

এ নিয়ে শাবি উপাচার্য অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিনের সাথে কথা বললে তিনি সমাবর্তন আয়োজনের আশ্বাস দিয়ে বলেন, আমরা সমাবর্তন করবো৷ কিন্তু এই মুহূর্তে তারিখ বলতে পারছি না। মহামান্য রাষ্ট্রপতির সাথে আলোচনা করে, উনি যখন আমাদের সময় দেবেন আমরা তখন আয়োজন করবো৷ সেটা চলতি বছরের শেষের দিকে অথবা আগামী বছরের প্রথমের দিকে হতে পারে৷ আমরা আশাবাদী তিনি আমাদের সময় দিবেন।

শাবি উপাচার্য আরো বলেন, আমাদের এখানে প্রায় ৩০ হাজার শিক্ষার্থীরা সমাবর্তন পায়নি। এতগুলো শিক্ষার্থীদের তো একসাথে দেওয়া সম্ভব না, তাই আমরা দু’ভাগে সমাবর্তন দেবো। প্রথমে কিছু ব্যাচ এবং পরবর্তীতে বাকি ব্যাচগুলোর সমাবর্তন হবে। সবগুলো ব্যাচকে দু’বারে সমাবর্তন দেওয়া হয়ে গেলে আমরা আমরা চেষ্টা করবো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মত প্রতি বছর সমাবর্তন আয়োজনের।

পছন্দের আরো পোস্ট