মহাশূন্য

। শেহনাজ হেনা  ।

প্রিয় আকাশ ,
গতকাল রাতে আকাশে কোনো তারা ছিলনা । তাই আকাশ ছিল জ্যোতীহীন নিস্প্রভ । বাতাস ছিল থমথমে , যেন ঝিরঝিরি মৃদুমন্দ ছন্দে বয়ে যেতে তার ছিল একরাশ অনীহা রাতপাখীরাও বিশেষ কোন শব্দ তোলেনি প্রহরে প্রহরে , ওদের মাঝেও বিদ্যমান ছিল নৈরাশ্য । সব দেখে মনে হল প্রকৃতির কোথাও শোক চলছে – সবকিছুতে কেমন যেন বিষন্নতা ।

মানুষও যেন প্রকৃতিরই আরেকটা রুপ । কখনো হাসে কখনো মন খারাপ করে বসে থাকে কখনো কাঁদে । তুমি যদি জিজ্ঞেস কর “ কী হয়েছে তোমার ?” বলবে “ নাতো , কিছুই হয়নি আমার !” আসলেই তাই । আমারও মনে হয় কিছুই হয়না , তবুও মানুষের মন থেকেই থেকেই বিষন্ন হয়ে যায় । আবার কখনো অকারনেই খুশিতে মনটা ভরে উঠে , বুঁদ হয়ে থাকে ভাল লাগার আবেশে ।

কত বয়েসের মানুষ দেখি — কত রকম তাদের প্রকৃতি । আমি চোখ মেলে দেখি যতটুকু আমার চোখে পড়ে । অনেক সময় অনেক কিছুর হিসাব মিলাতে পারি না । হিসাব মিলানো আমার কাজও নয় । আমি অনেকের কথায় , চলায় , ভাবে তাদের এক রকম দেখি কিন্তু বাস্তবে ব্যবহারিক জীবনে অন্যরকম দেখি । তার যা আমাকে স্পর্শ করে যায় তখন আমি চিন্তা তরি কেন এমন বিচিত্র সবকিছু ? ফের ভাবি , কী আসে যায় তাতে ? চলুক যে যার মত ভেতরে এক বাইরে আরেক — আসলে দুনিয়াটার নেকাবটাই এমন ! দুনিয়ার সৃষ্টিটাই তো এক ছলনাময় কর্মেরই ফসল ।

আচ্ছা , তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করতে চাই , প্রায়ই দেখি আমার বাসার সামনে একটা পাখি একলা বসে থাকে । কেন সে একা ? তার কি কোন সঙ্গী নেই ? সে কি তার নিজের জীবনকে আনন্দময় করে তোলার জন্য কোন সঙ্গী খুঁজে নিতে পারেনা ? না কি সে-ও বিষাদগ্রস্ত ? তারও কি আছে কোন দুখমঅতীত , তাই নূতন করে আর সঙ্গী খোঁজেনা ?
এরকম তো প্রায় দেখি পাখিরা জোড়ায় জোড়ায় উড়ছে , দলে দলে উড়ছে আবার একটু অনতিদূরেই একটা পাখি একা একা উড়ছে , উড়ে উড়ে একটা তারে এসে একাই বসছে ।অনেকক্ষণ বসে থাকে । তারপর একা একা উড়ে আবার দূর কোথাও চলে যায় । আকাশে একেবারে মিলিয়ে না যাওয়া পর্যন্ত আমি তার পথের দিকে চেয়ে থাকি । আমি তার একাকীত্বের অভিপ্রায় বুঝার চেষ্টা করি , পারি না , বড়ই বৈচিত্র্যময় এই জগত!

Post MIddle

মানুষের দিকে তাকিয়ে দেখো, একই রকম দেখতে পাবে । গ্রুপে গ্রুপে আবার জোড়ায় জোড়ায় বিভিন্ন বয়সীরা ঘুরছে ফিরছে আড্ডা দিচ্ছে , মজা করছে তার আশে পাশেই দেখা যাচ্ছে দলহীন , জোড়াহীন কিছু একাকী মানুষ । নিজের মত করে ঘুরছে , ফিরছে । তাদের মধ্যে সবাই লোনলী না হলেও কিছু তো অবশ্যই একাকীত্বে ভোগে । আমার জানতে ইচ্ছে করে উৎসবের দিনগুলোতে তাদের কেমন লাগে যখন দেখে পরিবার মিলে সবাই আনন্দ করছে । মা সন্তানকে কাপড় কিনে দিচ্ছে , আদর করে খাইয়ে দিচ্ছে , স্বামী -স্ত্রী আনন্দঘন মুহুর্তে হাসিতে ভেংগে পড়ছে , একে অপরকে খাবার তুলে দিচ্ছে , অজান্তেই একজন আরেকজনকে ছুঁয়ে যাচ্ছে- এরকম দৃশ্য দেখে তাদের মনে কি ইচ্ছা জাগেনা এমনই একটি জীবন পাওয়ার জন্য ? বুকে হাহাকার কি জেগে উঠেনা ? অজান্তে বের হয়ে আসেনা একটি দীর্ঘশ্বাস ? তাই যদি হয় তবে কেন এই একা মানুষগুলো তাদের স্ব স্ব অবস্হান অনুসারে জীবন সঙ্গী বেছে নেয়না ? তারা কি পছন্দসই কাউকে খুঁজে পায়না না কি নিজেরাই একাকী জীবন পছন্দ করে ? সে যাই হোক আমার এত ভেবে কী কাজ , বল !!

আকাশ , আমি ভাবছিলাম বিভাবরির কথা । ওর একটা মেইল পেলাম । সহসাই দেশে ফিরবে । বলল, হিমেলের সাথে কোন যোগাযোগ নেই । জানে না হিমেল কোথায় আছে , কেমন আছে! অথচ এতগুলো বছর পার করে আজ হিমেলের জন্যই দেশে ফিরছে । আমি ফোন করলাম সরাসরি কথা বলার জন্য । দেখলাম সে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ , ফিরবেই । আমি জিজ্ঞেস করলাম ,কী ভাবে খুঁজে পাবে হিমেলকে ? আর যদি খুঁজে পাও এবং দেখো হিমেল এতদিনে বিয়ে করে ফেলেছে তাহলে কী করবে ? জানো আকাশ , বিভা আমার কথা শুনে
হেসে ফেলল , খুব রিলাক্সড গলায় বলল, “ হিমেল আমাকে ছাড়া কোনদিন কাউকে ভালবাসবেনা ! কোনদিন কাউকে আমার জায়গাটা দেবেনা! হয়ত তাকে খুঁজে পেতে আমার সময় লাগবে । অপেক্ষা করতে করতে একদিন যখন মিলব পরস্পরে দেখব সেও বুড়ো হয়ে গেছে আমিও বুড়ো হয়ে গেছি তখন দু’ বুড়োবুড়িতো জীবন কাটিয়ে দেব । জীবনের শুরুতে হয়ত পেলামনা অন্তত আমারদের জীবনের শেষটাতে যেন একে অপরকে পাই! এবং আমি জানি হিমেলকে আমি পাবই !!”

আকাশ শোন , আমি মন থেকে চাই স্রষ্টা যেন ওদের মিলিয়ে দেন । অনেক তো কস্ট করল , আর কত , তাইনা ? আচ্ছা তোমার কি অমিতের সাথে দেখা হয়েছিল ? লাবণীর চিঠিটাকি দিতে পেরেছিলে ও’কে ? আমাকে তো আর জানালেনা কিছু ! লাবণী জিজ্ঞেস করেছিল , আমি বলেছি খবরের জন্য আরো কয়েকদিন অপেক্ষা করতে । বেচারার মুখটা ব্যথায় সে যে কি রকম ম্লান হয়ে গিয়েছিল ! আচ্ছা তোমরা পুরুষরা কি অপেক্ষার গুরুত্বটা কিছুতেই বুঝতে পারবেনা ? তিথিকে
দেখলাম রাগে গনগন করছে , নীলকে কাছে ফেলে হাড্ডি-মাংস চিবিয়ে খাবে । একটু ঠান্ডা হতে বলাতে বলল, “বুবু আর কথা বলো না , এই করে করেই তো আকাশ ভাইয়াকে দুষ্টু বানিয়ে দিলে !” মনে মনে কিছুটা একমত না হয়ে পারলাম না তার সাথে । তোমাকে তো আমি আসলেই দুষ্টুই বানিয়ে ফেলেছি , তাই না !?

কেমন আছ তুমি বলতো ? দুপুর অবধি কেবলই ঘুমাও , টের পাই আমি ! তারপর সারাটা দিন কী করো , কোথায় যাও? কী খাও না খাও জানি না । মাঝে মাঝে ভারী চিন্তা হয় আমার ! মরলে কার কী ক্ষতি হবে জানিনা , কিন্তু আমার যে সবই যাবে ! চিঠি লিখবো কাকে আমি , বলতো !?

আকাশ, ভাল থেকো । আনন্দে থেকো , পারলে সময় করে উত্তর দিও। তোমার সব খবর জানিও। অপেক্ষায় রইলাম ।
মৃত্তিকা।

পছন্দের আরো পোস্ট