বর,কণের একাল-সেকাল

কয়েকমাস আগে আমার স্বামীর পরিচিত এক আত্মীয়ের বিয়েতে গিয়ে পরিচিত কাউকে না পেয়ে পার্টি হলের এক কোণে একা টেবিলে বসে আছি। বর্তমান সময়ে মানুষ এখন অনেক ব্যস্ত। সবকিছুতেই সংক্ষিপ্ত পথ খোঁজে। মানুষের ধৈর্যও কমে গেছে। এখনকার দিনে সময় বাঁচাতে বর, কণে একসাথে বিয়ের অনুষ্ঠান করে বলে অতিথিদের অনেক সময়ে বিপাকে পড়তে হয়। বর পক্ষের কেউ পার্টি হলে ঢুকার সময় গেটে ছিলনা বলে ভুল করে আমি অনেক লোকের ভীড়ে কণে পক্ষের সব অচেনা মানুষদের ভীড়ে বসে ছিলাম। এদিকে বর পক্ষের কাউকে চোখেও পড়লোনা তাঁদের আমন্ত্রিত অতিথিদের দেখাশুনা করতে। সবাই যে যার মত ব্যস্ত ছবি, সেল্ফি তোলায়, আড্ডা,গল্প, ফোনের স্ক্রীন দেখে বারবার ফাউন্ডেশন, লিপিস্টক ঠিক করা ইত্যাদি। মনে হোল মানুষজন ইদানিং আয়নাও দেখে না তেমন। অবশ্য আয়না দেখার সময় কই! সারাদিন এতবেশী সেল্ফি তোলা হয় যে, ফোনের স্ক্রীনেই নিজেকে দেখা হয়ে যায়। অত্যাধুনিক ফোনের বিউটি ফেইস এপসগুলোতে নিজের এত সুন্দর কৃত্তিম মুখো শ্রী রেখে বেশীরভাগ মানুষগুলোই(সবাই নয়) এখন আর আয়নায় সত্যিকারের নিজের চেহারা দেখেন না।

খাওয়া -দাওয়া শেষে বাসায় ফেরার পথে আমার স্বামীকে বললাম কার ছেলের বিয়েতে এসেছি? বরের বাবা, মা কই? পরিচয় করিয়ে দাও। উত্তর দিল, অন্য একদিন পরিচয় করিয়ে দেব৷ আজ বরের মা পার্লার থেকে বিয়ের অনুষ্ঠানে আসতে অনেক দেরি হয়ে গেছে। এখন উনি কণে পক্ষের নতুন মেহমানদের নিয়ে ব্যস্ত আছেন। কথা শুনে অবাক হয়ে আমি তার মুখের দিকে তাকিয়ে আছি। বললাম আজ আমাদের সাপ্তাহিক ছুটির দিন। ঘরে মাংস, পোলাও, সালাদ করে সবাই মিলে একসাথে বসে খেলেইতো পারতাম। কি দরকার ছিল দুপুরের এই কড়া রোদের মধ্যে গাড়ীর জ্বালানী খরচ করে, টোলের টাকা দিয়ে এতদূরে পোলাও, মাংস খেতে আসবার? কোন উত্তর দিল না। ও চুপ করে হাইওয়েতে গাড়ী চালানোর দিকে মনোনিবেশ করলো।

গাড়ী সাঁই সাঁই করে সামনে ছুটছে আর আমি স্মৃতির সাঁকোতে উঠে অনেক বছর আগে ফেলে আসা অতীতের আমার শৈশব, কৈশোরের মধুমাখা সেই স্বর্গীয় বাড়ীটিতে চলে যাই। কোন ক্লাশে পড়তাম সঠিক মনে না পড়লেও তখনকার মধুর স্মৃতিগুলোর কথা স্পষ্ট মনে আছে আজো। মাঝরাত। বাড়ীর কারো চোখে ঘুম নেই। আগামীকাল বড় আপার বিয়ে। হাতের বানানো কারুকার্যময় হরেক রকমের পিঠা পুলিসহ নানাবিধ কাজে আম্মা, মামি,চাচি সবাই ব্যস্ত ঘরের কাজে। বড় ভাই, মামা সহ আত্মীয়-স্বজনরা ব্যস্ত বাহিরের কাজে। কেউ রান্না করছে। কেউ বাড়ী সাজাচ্ছে। কেউবা রঙ -বেরঙের কাগজ কেটে রঙিন সুতায় ভাতের আঠা দিয়ে সে কাগজ লাগিয়ে দিচ্ছে বাড়ীর গেটে। চারপাশে সাজ সাজ রব। আজকের সকালে সূর্য যেন তাড়াতাড়ি উঠে গেছে। উঠোনের দুইপাশে এবং বাড়ীর বাহিরের রাস্তার গাছগুলোকে সাজানো হয়েছে সাদা চুন রঙ দিয়ে। বাতাসে কেমন যেন অচেনা লাজুক ঘ্রাণ। আসমান, জমিনে যেন নতুন কণের মিষ্টি গন্ধ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। বেলা বাড়তেই কণের বান্ধুবীরা মিলে তাঁকে গোসল শেষে অপরুপ সাজে সাজিয়ে দিল। দাদী, নানীরা কণের চারপাশ ঘিরে বিয়ের গীত গাইছেন। ফোড়ন কাটছেন।

দেবদারু পাতার গেটে মিষ্টি শরবত খেয়ে কণে পক্ষের সবার রাজ্যের বিস্ময়ের অবসান ঘটিয়ে অবশেষে ঢাকঢোল পিটিয়ে বরের আগমন ঘটে। লোকে লোকারণ্য পুরো বিয়ে বাড়ী। কণে পক্ষের প্রতিটি মানুষ বর পক্ষের লোকজনদের তদারকিতে ব্যস্ত। বর, কণেকে ঘিরে আছে বাড়ীর প্রতিটি চোখ। লজ্জাবনত মস্তকে মাথা নিচু করে বর, কণে বসে আছে সবার মাঝখানে। বর রুমাল দিয়ে মুখ ঢেকে রেখেছেন, কণে ঘোমটা টেনে বসে আছেন। মন যতই উসখুস করুক প্রবল ইচ্ছে থাকা সত্বেও কেউ কারো মুখের দিকে তাকাতে পারছেন না। দুজনের চোখেমুখেই অচেনা ভালোলাগা, দুজনেই দুজনকে আবিষ্কারের ভালোবাসার নেশায় ডুবে আছেন। মৌলভী সাহেব কণের কাছে বিয়ের অনুমতি নিতে আসলে কবুল বলেই পাশের জনকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেংগে পড়তেন কণে এবং তার মা, বোন সহ আত্মীয়-স্বজনেরা।

Post MIddle

অতপর বর-কণের মালা বদল, আয়না দেখা, শুভ দৃষ্টি বিনিময়, একই গ্লাসে শরবত খাওয়া, বর-কণের শাড়ী, পাঞ্জাবি একসাথে বেঁধে দেওয়া, জুতা চুরিসহ এমন আরো কত কি। বর-কণে কেউ কারো দিকে সরাসরি না তাকালেও দুজনের মাঝেই বিরাজ করতো পৃথিবী সমান আবেগ, অনুভূতি। মানুষের ভীড়ে অনেকসময় বর, কণের ভালো কোন ছবিও তোলা হতো না৷

বিয়ে মানেই রঙ, বেরঙের আনন্দ। সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে সবকিছু পরিবর্তন হয়ে যায় জানি। মানুষ বৈচিত্র পিয়াসী। জীবনে যত বেশী বৈচিত্র আসে মানুষ জাতি তত বেশী আনন্দ পায়। বর্তমান প্রযুক্তির যুগে মানুষের রুচি, মনন, চাহিদা, জীবনবোধ সব কিছুই পাল্টে গেছে। এখনকার সময়ে বিয়ে বাড়ীতে বর,কণেকে ঘিরে তেমন একটা উৎসাহ দেখা যায়না৷ সবাই ব্যস্ত যে যার মত ছবি তোলায়, আড্ডা, গল্পে। আন্তরিকতা নেই। সবকিছু মেকি, কৃত্তিম মনে হয়। বর, কণের আবেগ, লজ্জাবনত সে মধুর চাহনি কিছুই চোখে পড়েনা। বর, কণে ব্যস্ত সারাক্ষণ ছবি তোলায়। হাজার হাজার ছবি তোলার পরেও বর, কণের ছবি তোলার তৃপ্তি মেটেনা। আরো ছবি তুলতে চায়। বিয়ের সময় ক্যামেরাম্যানের ফ্রেমে বন্ধী এখনকার বর, কণে সব আবেগ, উচ্ছ্বাস।

সময়ের পরিক্রমায় আগেকার দিনের বিয়ের মধুর সব আনন্দ উৎসবগুলো আজ শুধুই স্মৃতি। লাল, নীল সোডিয়ামের আলোয় সজ্জিত এখনকার বিয়ের অনুষ্ঠানগুলোতে যখন যাই তখন খুব মনে পড়ে আগেকার দিনের বিয়ের সমৃদ্ধ সব উৎসব, হিরন্ময় ঐতিহ্য, সংস্কৃতিগুলোর কথা। যা আজকের দিনের বিয়ের উৎসবগুলো থেকে নির্বাসিত হয়ে গেছে।

পছন্দের আরো পোস্ট