বৃষ্টিতে বাড়ি ফেরার গল্প
ভোর পাঁচটা থেকে বৃষ্টি হচ্ছে। এ বৃষ্টি যেনো থামার নয়! অবিরাম বর্ষণ হচ্ছে। ক্যাম্পাস ছুটি হয়েছে অনেক আগেই। মাত্র তিন দিন বাকি ঈদের। আজ বাড়িতে যাচ্ছি আমি, সায়েম আর রাশেদ। বৃষ্টিতে ভিজে একদম কাকভেজা হয়ে গেছি আমরা। তবুও আজই বাড়ি যেতে হবে। নাড়ির বাঁধনে টান পড়েছে। বিস্ময়কর অদৃশ্য শক্তি এ বাঁধনের। বৃষ্টির কি সাধ্য আছে হার মানাবে? বাসের টিকেট সকাল ৮ টায়। বাস ছাড়ল সাড়ে ৮ টায়।
জানালার পাশের সিটটি আমার। বসে বসে বৃষ্টিভেজা ঝাঁপসা প্রকৃতি দেখতে দেখতে এগুচ্ছি। মাঝে মাঝে বৃষ্টির হালকা ঝাপটা এসে চশমার গ্লাসকে কুয়াশাচ্ছন্ন করে দিচ্ছে। মনে হচ্ছে সবুজাভ ঝাঁপসা প্রকৃতি আমাকে তার স্বর্গীয় রূপ দেখাচ্ছে। রাস্তার ধারে গাছপালা, দিগন্তজোড়া ধানের ক্ষেত আর মাঝে মাঝে দু’একটা বাড়ি কিছুদূর পর পর। আবার কখনও কখনও মনে হয় ক্লান্তিকর দৃশ্য বাসের জানালা দিয়ে দেখতে দেখতে চোখ পচে গেলো। কখন বাড়ি যাবো? মায়ের মুখটি দেখবো! চার মাস বারো দিন পর বাড়ি যাচ্ছি।
পাশাপাশি সিটে আমি আর সায়েম। সামনের সিটে রাশেদ। গল্প করতে করতে এগুচ্ছি আমরা। রাশেদের পাশের সিটটা একটা মেয়ের। মেয়েটার চুল বাতাসে একটু পর পর রাশেদের মুখে এসে পড়ছে। রাশেদ নিতান্তই ভদ্রতার সাথে বারবার সরিয়ে দিচ্ছে, আবার বিরক্তও হচ্ছে। আমরা রাশেদের এরুপ করুণ দৃশ্য দেখে আনন্দ নিতে কার্পণ্য করলাম না। এরুপ সুযোগ তো আর সবসময় পাওয়া যায় না। আনন্দের ও ক্লান্তি আছে। আমরা আনন্দের ইনজেকশন নিতে নিতে এগুচ্ছি।
গল্প করতে করতে আমরা কখন বঙ্গবন্ধু যমুনা সেতুর উপর এসে পড়েছি খেয়ালই করি নি। বৃষ্টির কারণে নদীর পানিকে ঘোলা ঘোলা মনে হচ্ছে। যতদূর দৃষ্টি যাচ্ছে শুধু পানি আর পানি। বিপরীত দিক থেকে আসা একটা ট্রেনকে দেখতে পেলাম সেতুতে। ট্রেনটি বেশ ধীর গতিতেই যাচ্ছে। তবে ট্রেনের ছাদের যাত্রীদের দেখে মনে মনে ভয় পাওয়ার প্রস্তুতি নিয়ে অপেক্ষা করছি। এই বুঝি পড়ে যাবে! এমন মনে হচ্ছে। এলেঙ্গা এসে নামলাম। এখন তিনজনের বাড়ির রাস্তা আলাদা আলাদা।
আমার যেতে হবে মধুপুর, সায়েমের মানিকগঞ্জ আর রাশেদের বাড়ি পাথাইলকান্দি। বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে বাসের জন্য অপেক্ষা করছি। দু’একটা বাস আসলেও তাতে সিট নেই। তাই সিএনজি তে করেই বাড়ির দিকে রওনা হলাম। মনের অজান্তেই বার বার চোখের সামনে ভেসে উঠছে দিগন্তজোড়া মাঠে থই থই করা অথৈ পানি, সেই মাঠে ফুটবল খেলছি আমি। যতই বাড়ির কাছাকাছি যাচ্ছি বাতাসটা ততই আপন মনে হচ্ছে। বাতাসে ভেজা মাটির সোঁদা গন্ধ পাচ্ছি। চল্লিশ মিনিট পর মধুপুর পৌছালাম। এখান থেকেও আরো ১০ কি.মি পথ পাড়ি দিতে হবে আমাকে। তারপর আরো ১ কি.মি রাস্তা হেঁটে যেতে হবে।
অটোতে পরিচিত আঙ্কেলের সাথে দেখা হয়ে গেলো। ক্যাম্পাসের গল্প, বাড়ির গল্প করতে করতে এগুচ্ছি। অবশেষে অটো থেকে নামলাম। এখন শুধু হাঁটার রাস্তা বাকি। এটুকু রাস্তাই যেনো ফুরাচ্ছে না। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি হচ্ছে এখনো। সেন্ডেল খুলে হাতে নিয়ে বৃষ্টিভেজা কাঁদামাটিতে হেঁটে যাচ্ছি। বর্ষায় জলধারায় শরীর ভিজলেও মন পুরুপুরি ফুরফুরে।
অবশেষে নিজের বাড়িতে পৌছালাম। আমিও বাড়িতে পৌছালাম, বৃষ্টিও থেমে গেলো। যেনো আমাকে বাড়িতে পৌছে দেওয়ার জন্যই বৃষ্টিটা হচ্ছিল। বাড়িতে ঢুকেই মার প্রথম প্রশ্ন কতদিন পর এলি এবার? এখন বৃষ্টি হচ্ছে মার চোখে। ভালোবাসা মাঝে মাঝে খুব কষ্টকর হয়। এ কষ্ট আনন্দের কষ্ট। অকৃত্রিম আনন্দের বর্হিপ্রকাশ।
ইয়াজিম ইসলাম পলাশ।গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ।রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়