বাংলা ভাষার জন্ম ও বেড়ে ওঠা

ত্রয়োদশ শতকের পূর্বে কারো কল্পনাতেও এটা ছিল না যে বাংলা একসময় কোনো অঞ্চলের প্রধান ভাষা তথা রাষ্ট্রীয় ভাষার মর্যাদা লাভ করবে। বাংলা ভাষাভাষী প্রধান অঞ্চলসমূহ তথা পূর্ববাংলা, আসাম, মিজোরাম,ত্রিপুরা, কলকাতা ও পশ্চিম বাংলা থেকে শুরু করে ভারতীয় উপমহাদেশের বিরাট এলাকাজুড়ে তখন সংস্কৃত ভাষার ব্যাপক চর্চা হতো। বাংলা তখন একেবারেই হাতে গোনা কিছু নিম্ন শ্রেনীর মানুষের স্থানীয় ভাষা বৈই আর কিছুই ছিলো না। কিন্তু সেই ভাষাই এককালে এতো আলোচিত হবে, সেই ভাষার জন্য রক্তাক্ত সংগ্রাম হবে এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সেই ভাষা ব্যাপক স্বীকৃতি লাভ করবে তা সেই সময়ের অলীক কল্পনা হলেও এটাই আজকের বাস্তবতা, এটাই আজকের ইতিহাস।

সংস্কৃতি চর্চার মূলে অনেকটা কুঠারাঘাত করেই বাংলা ভাষার বিকাশের দ্বার উন্মোচিত হয়েছিল ১২০৩ খ্রিস্টাব্দে তুর্কিবীর ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মাদ বিন বখতিয়ার খলজির বাংলা বিজয়ের মধ্য দিয়ে। এই মুসলিম বীর লখনৌতে হিন্দু রাজা লক্ষণ সেনকে বিতাড়িত করার মধ্য দিয়ে এই অঞ্চলে মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠার পর থেকেই এখানে ব্যাপকভাবে বাংলা চর্চা শুরু হয় এবং সংস্কৃতি চর্চা লোপ পেতে থাকে।

১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর প্রান্তরে মীরজাফরের নেতৃত্বে কতিপয় বিশ্বাসঘাতকের চক্রান্তের ফলে ইংরেজদের হাতে বাংলার শেষ নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার পতনের মধ্য দিয়ে শুরু হয় ব্রিটিশ শোষণের যুগ। ১২০৩ থেকে ১৭৫৭ সাল পর্যন্ত ওই সাড়ে ৫শ বছরকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের সোনালি যুগ বলেও অভিহিত করেছেন অনেক ইতিহাসবিদ। কিন্তু কুটকৌশলি ব্রিটিশদের ক্ষমতা দখলের পর তাদের সাথে এই উপমহাদেশের হিন্দুদের হীন যোগসাজশের ফলে এখানে এক ত্রাসের রাজত্ব কায়েম হয়। মুসলমানদের জীবনে নেমে আসে এক নিকষ কালো রাত। ফের ব্যাপকভাবে শুরু হয় ইংরেজি ও সংস্কৃতি চর্চা। মন্থর হয়ে পড়ে বাংলা চর্চার গতি।

ইতিহাসের পরম্পরায় বয়ে চলে ক্ষণ, ক্রমেই অভিভাবকহীন হয়ে পড়ে বাংলা ভাষা। এমনই এক প্রেক্ষাপটে ১৮০১ সালে কলকাতায় প্রতিষ্ঠা করা হয় ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ। আর ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ গ্রন্থমালা প্রকাশের মধ্য দিয়ে ইংরেজ এবং ইংরেজ মদদপুষ্ট শিক্ষিত হিন্দু থেকে শুরু করে ব্রাক্ষণ্যবাদী সংস্কৃত পণ্ডিতদের হাতে জিম্মি হয়ে পড়ে বাংলা ভাষা। সেই সাথে যুক্ত হয়েছিল সুযোগসন্ধানী খ্রিস্টান মিশনারিরা। একের পর এক চলতে থাকে বহুমুখী ষড়যন্ত্র ও অপকৌশল। হিন্দু ব্রাক্ষণ এবং খ্রিস্টানরা মুসলমানদের সযত্মে লালিত বাংলা ভাষার শরীর থেকে তাদের ঐতিহ্যাশ্রিত শব্দকে ছুড়ে ফেলে সংস্কৃতনির্ভর এক ব্রাক্ষণ্য ভাষার জন্ম দিলো। এই ভাষায় রচিত হতে থাকে তাদের যাবতীয় গ্রন্থ এবং ইংরেজদের পৃষ্ঠপোষকতায় তা প্রকাশিত হয় এবং সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। ফের গল্প, কবিতা, নাটক, উপন্যাস, অভিধান, ব্যাকরণসহ পাঠ্যপুস্তকের ভাষাও হয়ে পড়ে সংস্কৃতিনির্ভর। সত্যি কথা বলতে, এই ব্রাক্ষণ্যভাষার নাগপাশ থেকে আজও আমরা সম্পূর্ণ মুক্ত হতে পারিনি।[1]

বাংলা ভাষার উষালগ্নের ইতিহাস

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে “ডি-লিট“ উপাধিতে ভূষিত প্রখ্যাত সাহিত্য বিশারদ শ্রী দীনেশচন্দ্র সেন বাংলা ভাষার উষালগ্নের ইতিহাস চর্চা করতে গিয়ে স্বত:স্ফ‍ূর্তভাবে মুসলমানদের অবদানকে স্বীকৃতি দিয়েছেন। ঐতিহাসিক “সওগাত“ পত্রিকায় বাংলা ১৩৩৫ সালের চৈত্র সংখ্যায় “বঙ্গ-ভাষার উপর মুসলমানদের প্রভাব“- শীর্ষক এক নিবন্ধে বিষয়টি উঠে আসে। এই নিবন্ধের খানিকটা তুলে ধরছি:

“মুসলমানদের আগমনের পূর্বে বঙ্গভাষা কোনো কৃষক রমণীর ন্যায় দীনহীন বেশে পল্লী কুটিরে বাস করিতেছিল। এই ভাষাকে এ্যাণ্ডারসন, স্ক্রাইন, কেরী প্রভৃতি সাহেবেরা অতি উচ্চকণ্ঠে প্রশংসা করিয়াছেন। কেরী বলিয়াছেন, এই ভাষার শব্দ সম্পদ ও কথার গাঁথুনি এরুপ অপূর্ব যে, ইহা জগতের সর্বপ্রধান ভাষাগুলির পার্শ্বে দাঁড়াইতে পারে। যখন কেরী এই মন্তব্য প্রকাশ করেন, তখন বঙ্গীয় গদ্য সাহিত্যের অপোগণ্ডত্ব ঘোচে নাই; সে আজ ১২৫ বৎসর হইল। ইউরোপীয় পণ্ডিতেরা বলিয়াছেন, এমন কোন ভাব নাই, যাহা অতি সহজে, অতি সুন্দর ভঙ্গিতে বাঙ্গলা ভাষায় প্রকাশ না করা যায় এবং এই গুনেই ইহা জগতের সর্বশ্রেষ্ঠ ভাষাগুলির সমকক্ষ। স্ক্রাইন বলিয়াছেন, ইটালী ভাষার কোমলতা এবং জার্মান ভাষার অদ্ভ‍ুত ভাব প্রকাশ করিবার শক্তি এই মাধুরাক্ষরা এবং স্বচ্ছন্দগতি বাঙ্গালা ভাষায় দৃষ্ট হয়।

এই সকল অপূর্ব গুণ লইয়া বাঙ্গলা ভাষা মুসলমান প্রভাবের পূর্বে অতীব অনাদর ও উপেক্ষায় বঙ্গীয় চাষার গানে কথঞ্চিত আত্মপ্রকাশ করিতেছিল। পণ্ডিতেরা নস্যাধার হইতে নস্য গ্রহণ করিয়া শিখা দোলাইয়া সংস্কৃত শ্লোকের আবৃত্তি করিতেছিলেন এবং ‘তৈলাধার পাত্র‘ কিংবা ‘পাত্রাধার তৈল‘ এই লইয়া ঘোর বিচারে প্রবৃত্ত ছিলেন। তাঁহারা হর্ষচরিত হইতে ‘হারং দেহি মে হরিণি‘ প্রভৃতি অনুপ্রাসের দৃষ্টান্ত আবিস্কার করিয়া আত্মপ্রসাদ লাভ করিতেছিলেন এবং কাদম্বরী, দশকুমারচরিত প্রভৃতি পদ্য- রসাত্মক গদ্যের অপূর্ব সমাসবদ্ধ পদের গৌরবে আত্মহারা হইতেছিলেন। রাজসভায় নর্তকী ও মন্দিরে দেবদেবীরা তখন হস্তের অদ্ভ‍ুত ভঙ্গী করিয়া এবং কঙ্কন ঝঙ্কারে অলি গুঞ্জনের ভ্রম জন্মাইয়া ‘প্রিয়ে, মূঞ্চময়ি মানমনিদানং ‘ কিংবা ‘মুখর মধীরম, ত্যজ মঞ্জীরম‘ প্রভৃতি জয়দেবের গান গাহিয়া শ্রোতৃবর্গকে মুগ্ধ করিতেছিল। সেখানে বঙ্গভাষার স্থান কোথায়? ইতরের ভাষা বলিয়া বঙ্গভাষাকে পণ্ডিতমণ্ডলী ‘দূর দূর‘ করিয়া তাড়াইয়া দিতেন, হাড়ি-ডোমের স্পর্শ হইতে ব্রাক্ষণেরা যেরুপ দূরে থাকেন বঙ্গভাষা তেমনই সুধী সমাজের অপাংক্তেয় ছিল- তেমনি ঘৃণা, অনাদর ও উপেক্ষার পাত্র ছিল।

কিন্তু হীরা কয়লার খনির মধ্যে থাকিয়া যেমন জহুরীর আগমনের প্রতীক্ষা করে, শুক্তির ভিতর মুক্তা লুকাইয়া থাকিয়া যেরুপ ডুবুরীর অপেক্ষা করিয়া থাকে, বঙ্গভাষা তেমনই কোন শুভদিন, শুভক্ষণের জন্য প্রতীক্ষা করিতেছিল।

মুসলমান বিজয় বাঙ্গলা ভাষার সেই শুভদিন, শুভক্ষণের সুযোগ আনয়ন করিল। গৌড়দেশ মুসলমানগণের অধিকৃত হইয়া গেল। তাঁহারা ইরান-তুরান যে দেশ হইতেই আসুন না কেন, বঙ্গদেশ বিজয় করিয়া বাঙ্গালী সাজিলেন। আজ হিন্দুর নিকট বাঙ্গলাদেশ যেমন মাতৃভূমি, সেদিন হইতে মুসলমানের নিকট বাঙ্গলাদেশ তেমনই মাতৃভূমি হইল। তাঁহারা এদেশে আসিয়া দস্তুরমত এদেশবাসী হইয়া পড়িলেন। হিন্দুর নিকট বাঙ্গলা ভাষা যেমন আপনার, মুসলানদের নিকট উহা তদপেক্ষা বেশী আপনার হইয়া পড়িল।“

বাংলা ভাষার জন্মের ইতিহাস বর্ণনা করতে গিয়ে প্রখ্যাত সাহিত্যিক গোলাম মোস্তফা তার “বাংলা ভাষার নূতন পরিচয়“ প্রবন্ধে লিখেছেন: “খ্রীষ্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দীর পূর্ব হইতে এদেশেআর্যদিগের বসতি আরম্ভ হয় গঙ্গাপথ ধরিয়া এবং খ্রীষ্টীয় পঞ্চম শতাব্দীর মধ্যেই বাংলাদেশের প্রায় সর্বত্র আর্যভাষার একচ্ছত্রতা প্রতিষ্ঠিত হয়। আর্যদিগের পোষাকী ভাষা অর্থাৎ শিক্ষার, বিদ্যাচর্চার ও সামাজিক অনুষ্ঠানের ভাষা ছিল সংস্কৃত, আটপহুরিয়া অর্থাৎ ঘরোয়া ভাষা ছিল সংস্কৃত ভাষা হইতে উদ্ভ‍ুত প্রাকৃত। কালক্রমে সংস্কৃত ভাষা বদলাইয়া প্রাকৃত ভাষা রুপ নিল। এই প্রাকৃত ভাষা ভাঙ্গিয়া আবার বিভিন্ন প্রদেশে আঞ্চলিক ভাষায়- যেমন বাঙ্গালা, আসামী, উড়িষ্যা, মৈথিলী, গুজরাটী, মারাঠি ইত্যাদি – পরিণত হইল। বাংলাদেশে যে আর্যভাষা প্রবর্তিত হইল, তাহা এই পূর্বী প্রাকৃতেরই প্রকারভেদ।“

আবেগের ভাষা বাংলা

ভারতীয় উপমহাদেশের বাংলা ভাষাভাষী সব মানুষ বিশেষ করে মুসলমানদের সাথে বাংলা ভাষার রয়েছে এক গভীর আবেগের সম্পর্ক। কেননা এই উপমহাদেশের মুসলমানরা দখলদার ইংরেজদের সাথে আপোষ না করে নিজেদের ভাষা ধরে রাখতে গিয়ে যে অসামান্য ত্যাগ স্বীকার করেছিলেন তা তাদেরকে ভাষার ব্যাপারে ক্রমান্বয়ে এক আবেগি জাতিতে পরিণত করেছিল।

ইতিহাস পাঠে জানা যায় হিন্দু মহাজন ও জমিদারদের অত্যাচারে বাংলার মুসলমানরা অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল। তাই মুসলমানরা ইংরেজদের সাথে অসহযোগ করেছিল। তাদের ভাষা শিখবে না, তাদের চাকরি নেবে না, এই সকল করেই মুসলমানরা পিছিয়ে পড়েছিল। আর হিন্দুরা ইংরেজি শিক্ষা গ্রহণ করে ইংরেজকে তোষামোদ করে অনেকটা উন্নতির দিকে অগ্রসর হয়েছিল। আর এভাবেই দুইশো বছরের ইংরেজ শোষণের সময়ে মুসলমানরা এক চরম মানবেতর জীবনযাপন করেন।

অবশ্য ধূর্ত ও ঠগবাজ ইংরেজদের ব্যাপারে এক সময় হিন্দুদেরও মোহভঙ্গ হয়। আর এরই পটভূমিতে মহাত্মা গান্ধী, মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ও শের ই বাংলা একে ফজলুল হকসহ এই উপমহাদেশের হিন্দু-মুসলমানদের যৌথ সংগ্রামের এক পর্যায়ে ইংরেজরা এই দেশ ত্যাগে বাধ্য হয়। অবসান ঘটে ২শ বছরের জুলুম-নির্যাতন পর্বের। কিন্তু ইতিহাসের পাতায় রক্তে লেখা হয়ে যায় নীল বিদ্রোহ, ফরায়েজী আন্দোলন, সিপাহী বিদ্রোহ ও ওহাবি আন্দোলনের মতো  বহু ঘটনার যার প্রতিটি রক্তপিপাসু ব্রিটিশ বেনিয়াদের নির্মমতার কাহিনীতে ভরপুর।

এতকিছুর পর যখন ১৯৪৭ সালে ভারত উপমহাদেশ ভেঙ্গে হিন্দু অধ্যুষিত ভারত এবং মুসলিম অধ্যুষিত পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম হয় তখন বাংলাদেশ পাকিস্তানের অংশ হিসেবেস্বীকৃতি লাভ করে এবংএর নাম দেয়া হয় পূর্ব পাকিস্তান। ইংরেজ ও হিন্দুদের অত্যারের ক্ষত থেকে তখনো বলতে গেলে রক্তক্ষরণ থামেনি, ঠিক সেই মুহুর্তে বাংলা ভাষা নিয়ে যখন পশ্চিম পাকিস্তানের মুসলিম শাসকরা টালবাহানা শুরু করলো সত্যিই সেটা বাংলাদেশের মানুষ বিশেষ করে বাংলাদেশের মুসলমানদেরকে অত্যন্ত ক্ষুব্ধ করে তুলেছিল। কারণ এই আবেগের ভাষাকে শেষমেষ পশ্চিম পাকিস্তানের মুসলমান শাসকরা অবদমিত করে রাখবে এটা মেনে নেয়া এদেশের মানুষের পক্ষে কিছুতেই সহজসাধ্য বিষয় ছিল না।

ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপট

Post MIddle

বাংলা ভাষী বিশাল বাংলাদেশী জনগোষ্ঠী বিশেষ করে ৯০ শতাংশ মুসলিম জনগোষ্ঠী যখনই দেখলো বাংলাকে বাদ দিয়ে শুধুমাত্র উর্দুকেই পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার জন্য পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী মরিয়া হয়ে উঠেছে, তখন দলমত নির্বিশেষে পূর্ব পাকিস্তানের সবাই এর হঠকারী সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠে। বঙ্গবন্ধ‍ু শেখ মুজিবুর রহমান তার অসমাপ্ত আত্মজীবনী গ্রন্থে ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপট বর্ণনা করতে গিয়ে লিখেছেন:

“ফেব্রুয়ারি ৮ই হবে, ১৯৪৮ সাল। করাচিতে পাকিস্তানের সংবিধান সভার (কন্সটিটিউয়েন্ট এ্যাসেম্বলি) বৈঠক হচ্ছিল। সেখানে রাষ্ট্রভাষা কি হবে সেই বিষয়ও আলোচনা চলছিল। মুসলিম লীগ নেতারা উর্দুকেই রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষপাতী। পূর্ব পাকিস্তানের অধিকাংশ লীগ সদস্যেরও সেই মত। কুমিল্লার কংগ্রেস সদস্য বাবু ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত দাবি করলেন বাংলা ভাষাকেও রাষ্ট্রভাষা করা হোক। কারণ, পাকিস্তানের সংখ্যাগুরুর ভাষা হল বাংলা। (ক্ষমতাসীন) মুসলিম লীগ সদস্যরা কিছুতেই রাজি হচ্ছিলেন না। আমরা দেখলাম, বিরাট ষড়যন্ত্র চলছে বাংলাকে বাদ দিয়ে রাষ্ট্রভাষা উর্দু করার। পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ ও তমদ্দুন মজলিস এর প্রতিবাদ করল এবং দাবি করল, বাংলা ও উর্দু দুই ভাষাকেই রাষ্ট্রভাষা করতে হবে। আমরা সভা করে প্রতিবাদ শুরু করলাম। এই সময় পূর্ব পাকিস্তান মুসলীম ছাত্রলীগ ও তমদ্দুন মজলিস যুক্তভাবে সর্বদলীয় সভা আহবান করে একটা ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা সংগ্রাম পরিষদ‘ গঠন করল।… সভায় ১৯৪৮ সালের ১১ই মার্চকে ‘বাংলা ভাষা দাবি‘ দিবস ঘোষণা করা হয়।“[2]

পাক-ভারতের প্রখ্যাত সাংবাদিক, সাহিত্যিক ও রাজনীতিবিদ আবুল মনসুর আহমদ তাঁর “আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর“ গ্রন্থে লিখেছেন: “১৯৪৮ সালের মার্চ মাসে কায়েদে- আযম (মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ) পাকিস্তানের গভর্নর-জেনারেল হিসাবে পূর্ব- বাংলায় সর্বপ্রথম সফরেই বলিয়া বসেন: ‘কেবল একমাত্র উর্দুই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হইবে।‘ এতেই ব্যাপারটা জটিল আকার ধারণ করে। পূর্ব-বাংলার প্রধানমন্ত্রী খাজা নাযিমুদ্দিন একটা আপোস করেন। কিন্তু কায়েদে আযমের মৃত্যুর পর তিনিই গভর্নর-জেনারেল হইয়া উল্টা মারেন। এটা না ঘটিলে কি  হইত? বাংলাকে পূর্ব- বাংলার [3]সরকারী ভাষা ও শিক্ষার মাধ্যম করিলে এবং সম্ভব- মত উর্দুকেও পশ্চিম পাকিস্তানে ঐ স্থান দেওয়ার চেষ্টা করিলে ইংরাজী যথাস্থানে বর্তমানের মতই আসল রাষ্ট্র ভাষা এবং দুই পাকিস্তানের যোগাযোগের ভাষা থাকিয়া যাইত। বাংলা ও উর্দু ভাষা দুই অঞ্চলের সরকারী ভাষা ও শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে প্রভূত উন্নতি করিয়া জাতীয় ভাষায় পরিণত হইত। ‘রাষ্ট্রভাষা‘ কথাটা চাপাই পড়িয়া থাকিত। রাষ্ট্র-নায়কদের ভুলে অকালে রাষ্ট্র-ভাষার কথাটা উঠিয়া না হক মারামারি খুনাখুনি হইয়াছে। এটাও অবশ্য একদিকে ভালই হইয়াছে। রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নটা চিরকালের জন্য ফয়সালা হইয়া গিয়াছে।“

শেখ মুজিব তার বইয়ে আরো লিখেছেন: “জিন্নাহ পূর্ব পাকিস্তানে এসে ঘোড় দৌড় মাঠে বিরাট সভায় ঘোষণা করলেন, উর্দুই পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হবে।আমরা প্রায় চার পাঁচ শত ছাত্র এক জায়গায় ছিলাম সেই সভায়। অনেকে হাত তুলে দাঁড়িয়ে জানিয়ে দিল, ‘মানি না‘। তারপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কনভোকেশনে বক্তৃতা করতে উঠে তিনি যখন আবার বললেন, উর্দুই একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হবে তখন ছাত্ররা তাঁর সামনেই বসে চিৎকার করে বলল, ‘না, না, না‘। জিন্নাহ প্রায় পাঁচ মিনিট চুপ করেছিলেন, তারপর বক্তৃতা করেছিলেন। আমার মনে হয়, এই প্রথম তাঁর মুখের উপরে তাঁর কথার প্রতিবাদ করল বাংলার ছাত্ররা। এরপর জিন্নাহ যতদিন বেঁচেছিলেন আর কোনোদিন বলেন নাই, উর্দুই একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হবে।“[4]

ভাষা আন্দোলনের বিজয়

বাংলাদেশের গণমানুষের দাবিকে উপেক্ষা করে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী উর্দুকেই যখন পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষার সিদ্ধান্তে অনঢ় থাকে তখন পূর্ব পাকিস্তানেও আন্দোলন দানা বাঁধতে থাকে। সেই আন্দোলন দমনে পুলিশ ১৪৪ ধারা জারি করে ঢাকা শহরে সব ধরনের সভা-সমাবেশ ও রাজনৈতিক কর্মসূচী নিষিদ্ধ ও বেআইনি ঘোষণা করে। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি (৮ ফালগুন ১৩৫৮) এ আদেশ অমান্য করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কিছু ছাত্র মিছিল শুরু করে। মিছিলটি ঢাকা মেডিকেল কলেজের কাছাকাছি এলে ১৪৪ ধারা অবমাননার অজুহাতে আন্দোলনকারীদের ওপর গুলিবর্ষণ করে পুলিশ। এতে নিহত হন সালাম, বরকত, রফিক ও জব্বারসহ অনেকে। শহীদদের রক্তে রঞ্জিত হয় বাংলাদেশের রাজপথ।

পাকিস্তান সরকারের এমন কঠোর পদক্ষেপের ‍ফলে আন্দোলন দমনতো হয়ইনি; বরং ভাষার আন্দোলন আরো বেগবান হয়। ক্রমবর্ধমান গণ-আন্দোলনের মুখে পাকিস্তানের কেন্দ্রিয় সরকার শেষ পর্যন্ত নতি স্বীকার করতে বাধ্য হয় এবং ১৯৫৬ সালের সংবিধান পরিবর্তনের মাধ্যমে বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি প্রদান করে। ১৯৯৯ সালে ইউনেস্কো বাংলা ভাষা আন্দোলন, মানুষের ভাষা ও কৃষ্টির অধিকারের প্রতি সম্মান জানিয়ে ২১ ফেব্রুয়ারিকে “আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস“ হিসেবে ঘোষণা করে – যা বৈশ্বিক পর্যায়ে প্রতিবছর গভীর শ্রদ্ধা ও যথাযোগ্য মর্যাদার সাথে পালন করা হয়।

অপ্রিয় বাস্তবতা

এবার সামান্য কিছু অপ্রিয় বাস্তবতার কথা তুলে ধরতে চাই। বাংলাদেশীরাই পৃথিবীর একমাত্র জাতি যারা ভাষার জন্য জীবন দিয়েছেন। কিন্তু নির্মম বাস্তবতা হলো আজ সেই মাতৃভাষা, মায়ের ভাষা বড়ই অবহেলিত। সারাবছর হিন্দি সিরিয়াল দেখা, হিন্দি ও ইংরেজি গান শোনা, কোমলমতি শিশু ও বাচ্চাদের হিন্দি কার্টুন দেখানো বাংলাদেশের কোটি কোটি মানুষের জীবনের দৈনন্দিন রুটিনে পরিণত হয়েছে। বর্তমানে দেশের লাখ লাখ ঘরে ভারতের তৈরি এক ধরনের পারিবারিক ডিস ব্যবহার করা হয় যেখানে শুধুমাত্র হিন্দি চ্যানেল দেখানো হয়, কোন বাংলা চ্যানেল নয়। এর মানে হলো বর্তমানে লাখ লাখ বাংলাদেশী ঘণ্টার পর ঘণ্টা টিভিতে শুধু হিন্দি কথা শুনে ও হিন্দি সংস্কৃতি উপভোগ করছেন এবং বাংলা মাধ্যমে বিনোদনের কোন সুযোগই নেই। শুধুমাত্র ২১ ফেব্রুয়ারি আসলেই তাদের ভাষার জন্য আবেগ উথলে উঠে। এছাড়া ইংরেজি শেখানোর নামে বাচ্চাদের ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ানো হচ্ছে যেখানে বাংলাদেশের মানুষের সংস্কৃতির কোনো ধারণাই নেই। এমনকি লাখ লাখ শিশু বেড়ে উঠছে যারা ঠিকমতো বাংলায় কথা বলতে, লিখতে কিংবা পড়তে পারে না। কিন্তু তারা অনায়াসে হিন্দি ও ইংরেজি ভাষায় ভাব প্রকাশ করতে পারছে।

উত্তরণের পথ

কবি রবিন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায় বলা যায়, আগে চাই বাংলা ভাষার গাঁথুনি, তারপর ইংরেজি শেখার পত্তন। বাংলা ভাষার ইতিহাস-ঐতিহ্য ও সমৃদ্ধিকে সবার সামনে তুলে ধরতে হবে। নতুন প্রজন্মকে গড়ে তুলতে হবে সচেতন জনগোষ্ঠী হিসেবে যারা নিজ ভাষা ও সংস্কৃতি সম্পর্কে থাকবে পরিপূর্ণভাবে সচেতন। শতকরা নব্বইভাগ মুসলমানের এই ছোট্ট ভূখন্ডের প্রতিটি মুসলিম সদস্যের মাঝে এই আত্ম-বিশ্বাস ফিরিয়ে দিতে হবে যে শুধু ধর্মই নয় বাংলা ভাষার ক্ষেত্রেও তাদের রয়েছে সোনালী ইতিহাস। বিশেষ করে বাংলা ভাষার উৎকর্ষসাধনের গোড়াপত্তন যে মুসলমানদের হাতেই সম্পন্ন হয়েছিল সেই তথ্যও সবার কাছে পৌঁছে দিতে হবে, ঝেড়ে ফেলতে হবে সব হীনম্মন্যতা।

লেখক: সাংবাদিক

ইমেইল: mkzbablu@gmail.com

[1]মোশাররফ হোসেন খান, বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে মুসলিম অবদান, বাংলাদেশ ইসলামিক সেন্টার, পৃষ্ঠা-৪।

[2]শেখ মুজিবুর রহমান, অসমাপ্ত আত্মজীবনী, দি ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটে, পৃষ্ঠা-৯১-৯২।

[3]আবুল মনসুর আহমদ, আমার-দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর, খোশরোজ কিতাব মহল, পৃষ্ঠা-২৪০।

[4]শেখ মুজিবুর রহমান, অসমাপ্ত আত্মজীবনী, দি ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটে, পৃষ্ঠা-৯৯।

পছন্দের আরো পোস্ট