এইউবিতে আন্তঃধর্মীয় সংলাপ
এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ-এর আয়েশা অডিটরিয়ামে এইউবি ও Rotary Club of Dhaka Scholars এর যৌথ উদ্যোগে গত (২১ মে ২০১৮) সোমবার অনুষ্ঠিত হয়েছে আন্ত:ধর্মীয় সংলাপ। সংলাপের মূল উদ্দেশ্য ছিল: ভিন্ন ভিন্ন ধর্মীয় দৃষ্টিকোন থেকে মানব সেবার গুরুত্ব ও তাৎপর্য উপস্থাপন। এইউবির রেজিস্ট্রার ড.মোঃ শাহ আলমের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সংলাপে ৫টি স্বতন্ত্র ধর্মের পন্ডিতগণ উপস্থিত ছিলেন এবং তারা তাদের ধর্মীয় গ্রন্থের আলোকে মানব সেবার গুরুত্ব ও তাৎপর্য তুলে ধরেন।
এতে প্রধান অতিথি ছিলেন, এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা, উপাচার্য ও RC Dhaka Scholars Gi এর চার্টার প্রেসিডেন্ট প্রফেসর ড. আবুল হাসান এম. সাদেক।
ইসলাম ধর্মের পক্ষে বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ,মিডিয়া ব্যক্তিত্ব প্রফেসর ড. মীর মনজুর মাহমুদ, সনাতন হিন্দু ধর্মের পক্ষে প্রফেসর হিরেন্দ্র নাথ বিশ্বাস, খ্রীষ্টান ধর্মের পক্ষে রেভারেন্ট মার্টিন অধিকারী, বৌদ্ধ ধর্মের পক্ষে অশিন জিনা রাক্ষিতা এবং শিখ ধর্মে র পক্ষে আজাদ উইন্ডার সিং প্রমুখ প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন।স্বাগত বক্তব্য রাখেন, Rotary Club of Dhaka Scholars সেক্রেটারি অধ্যাপক জাকির হোসাইন।
ইসলাম ধর্মের পক্ষে ‘প্রফেসর ড. মীর মনজুর মাহমুদ’ কোরআন ও হাদীসের আলোকে বিশদ আলোচনা পেশ করেন, তিনি বলেন সমগ্র কোরআন এবং হযরত মুহাম্মদ (সা:) এর জীবনী জুড়ে মানব সেবার যেসব উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত পাওয়া যায় তা বলে শেষ করার মত নয়। তিনি সুরা বাকারার ১৭৭ নং আয়াত, সুরা দাহরের ৮ নং আয়াত, সুরা নিসা, সুরা আসর, সুরা আয্ যারিয়াত এবং সহীহ বুখারী, মুসলিম সহ ৬টি বিশুদ্ধ হাদীস গ্রন্থ থেকে রেফারেন্স উত্থাপন করেন। তিনি বলেন- ‘মানব সেবার জন্য বিত্তবান হতে হয় না; প্রয়োজন বিশুদ্ধ মানসিকতা এবং মানুষের প্রতি অগাধ ভালবাসা’। তাছাড়া ও ধনীদের ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, ধনীর সম্পদের মধ্যে দারিদ্রের অধিকার রয়েছে; এ অধিকার আদায় করা না হলে দুনিয়া ও আখেরাতে অবশ্যই শাস্তি ভোগ করতে হবে। এছাড়া ও তিনি মদিনা রাষ্ট্রের কথা উল্লেখ করে বলেন- রাসুল (সা:) মদিনার মানুষের অর্থনৈতিক সংকট দূরীকরণে ২ ধরনের কাজ করেছেন যার দরুন ২য় খলিফা হযরত ওমর (রা:) এর শাসনামলে যাকাত নেওয়ার মত কোন লোক পাওয়া যায়নি। তাহল- ১. মানসিক দারিদ্র্য দূরীকরণ এবং ২. আর্থিক দারিদ্র্য দূরীকরণ। মানসিক ব্যাপারটা এরকম যে, মানুষকে রাসুল (সা:) বুঝাতে সক্ষম হন যে, (ইয়াদুল উলয়া খায়রুম মিন ইয়াদিস সুফলা) অর্থাৎ,‘দান গ্রহীতার হাতের চেয়ে দাতার হাত উত্তম’। আর আর্থিক দারিদ্র দূরীকরণের জন্য তিনি রাষ্ট্রীয়ভাবে যাকাত উত্তোলন ও যথাযথ বন্টন, সদকা, উশর এবং কর্ম সংস্থান সৃষ্টি করেন।
খ্রীষ্টান ধর্মের পক্ষে ‘রেভারেন্ট মার্টিন অধিকারী’ বলেন- খ্রীষ্ট্রীয় ধর্মীয় গ্রন্থ বাইবেলের অনেক অংশ জুড়ে রয়েছে মানবতা ও ন্যয্যতার বিষয়ে সুষ্পষ্ট শিক্ষা। হিতোপদেশে (মেশাল) বলা আছে, ”ঈশ্বর বাহ্যিক আচার অনুষ্ঠানের চেয়ে মূল্য দেন ন্যায্যতাকে : ধার্মিকতা ও ন্যায়ের অনুষ্ঠান প্রভুর কাছে কুরবানি অপেক্ষা শ্রেয়” (২১:৩)। তিনি হিতোপদেশের উদ্ধুতি দিয়ে আরো বলেন- ”তুমি বোবাদিগের জন্য তোমার মুখ খোল, অনাথ সকলের জন্য খোল, ন্যায় বিচার কর, দু:খী-দারিদ্রের জন্য বিচার কর” (হিতোপদেশ ৩১:৮-৯)। সমাজে সম্পদ ও সুযোগের ন্যায্য বন্টনের অভাবে এক শ্রেনীর মানুষ সম্পদের পাহাড় গড়ে, অপরদিকে অসংখ্য মানুষ দারিদ্রের কশাঘাতে সীমাহীন দু:খ- কষ্টে জীবন যাপনে বাধ্য হয়। এ সমস্যার সমাধানের জন্য সমাজের সকল ক্ষেত্রে সুনীতি ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার বিকল্প নেই। আর আমরা ধর্মের বানী সঠিকভাবে পালন করিনা বলেই আজ মাত্র ১০% মানুষ পৃথিবীর ৯০% সম্পদ ভোগ করে আর অন্যদিকে ৯০% মানুষ বাকি ১০% সম্পদের উপর নির্ভর করে কোন মতে বেচেঁ থাকার চেষ্টা করে।
তিনি আরো বলেন- আমাদের সমস্যা এখানেই যে, আমরা ভোটের আগে কোলাকুলি আর ভোটের পরে গোলাগুলিতে বিশ্বাসী, যারপরনায় মনুষ্যত্ববোধ সিকায় রয়ে যাচ্ছে। ধর্ম আমাদের কেবল স্বর্গে নিয়ে যাবার ব্যবস্থা নয়, বরং এ বাস্তব জগতটা যেন সকলের জন্য সুন্দর ও শান্তির হয় তাই কামনা করে! বাইবেল বলে, তোমরা সৎ কাজ করিতে নিরুৎসাহিত হইও না।
সনাতন হিন্দু ধর্মের পক্ষে ‘প্রফেসর হিরেন্দ্র নাথ বিশ্বাস’ ধর্ম বিশ্বাসে মানব সেবার গুরুত্ব উপস্থাপন করেন এভাবে- ’আমাদের সকল ধর্মের উৎস একই, গন্তব্য একই, তবে নামে-দামে কেবল মত ও পথের ভিন্নতা’। তিনি মহাভারত, বেদ, পুরান, মনু, ঈশপ, স্বামী বিবেকানন্দ ও জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের রেফারেন্স ব্যবহার করে বলেন- সকল যুগে নবী-রাসুল ও সাধকগণের আগমন ঘটেছে মনুষ্যত্বের বিকাশের জন্য। মানবসেবার পূর্বশর্ত হচ্ছে চিত্ত্বকে পূত:পবিত্র করণ। তিনি আরো বলেন- ‘জম্মে কোন দিন মানুষ ব্রাহ্মন হয় না, কর্মেই তার বিকাশ’ এভাবে তিনি মানব সেবার জয়গান গেয়েছেন।
বৌদ্ধ ধর্মের পক্ষে ‘অশিন জিনা রাক্ষিতা’ বলেন- বৌদ্ধ ধর্ম একটি শান্তির ধর্ম। গৌতম বুদ্ধ ভোগবাসনা চরিতার্থকরণ এবং তাঁর অঞ্চলে প্রচলিত শ্রমণ আন্দোলনের আদর্শ অনুসারে কঠোর তপস্যার মধ্যে মধ্যপন্থা শিক্ষা দিয়েছিলেন। তৎকালে বুদ্ধের যে কথাগুলি সমাজের সকল শ্রেণীর মানুষকে প্রবলভাবে আকর্ষণ করেছিল তা হচ্ছে মেত্তা, করুণা, মুদিতা ও উপেক্ষা। মেত্তা বা মৈত্রী শব্দটির অর্থ হচ্ছে সকলকে সমভাবে ভালবাসা, যে ভালবাসা মাতা তাঁর একমাত্র সন্তানকে দিতে পারে। শিষ্য সংঘের প্রতি বুদ্ধের নির্দেশ ছিল মেত্তা বা মৈত্রী যেন মানুষের মনে কখনো ক্ষণস্থায়ী আবেগে পরিণত না হয়। এটা হবে মানুষের প্রতি মানুষের মনের স্থায়ী আবেদন। এই মন সর্বক্ষণ অনুরণিত হবে মানুষের সেবা ও শুভ চিন্তায়। এর প্রকাশ প্রতিফলিত হবে মানুষের সকল কথায় এবং কাজে। এই অবস্থায় মানুষের মন যখন রঞ্জিত হয় তখন সমাজের মঙ্গল না হয়ে পারে না। বুদ্ধের মতে মেত্তা বা মৈত্রী মানুষের মনের নৈতিক চেতনা ছাড়া অন্য কিছু নয়। এই চেতনার দ্বারা যারা অনুপ্রাণিত হবে তাঁদের পক্ষে পরের হিত চিন্তা ব্যতীত অন্য চিন্তা সম্ভব নয়। এতে মন থেকে রাগ-দ্বেষ দূরীভূত হয়ে জীবনে দেখা দেয় প্রশান্ত সূর্যের স্নিগ্ধ আভা। এভাবে তিনি মানব সেবায় বুদ্ধের উপদেশ তুলে ধরেন।
শিখ ধর্মে র পক্ষে ‘আজাদ উইন্ডার সিং’ শিখদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ গুরু গ্রন্থ সাহিবের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, শিখ ধর্মে মানবসেবার কথা রয়েছে। মানবসেবা একটি মহৎ কাজ এবং মহৎ চিত্ত্বের মানুষেরাই এ কাজে নিজেকে নিয়োজিত করে।
অনুষ্ঠিত আন্ত:ধর্মীয় সংলাপের আলোকে আমরা বুঝতে সক্ষম হই যে, পৃথিবীর প্রতিটি ধর্মের ভিন্ন ভিন্ন গ্রন্থ, ধর্মগুরু ও অনুসারী থাকলে ও একটি বিষয়ে সব ধর্ম অভিন্ন মত পোষন করে এবং সকল ধর্মে মানবতার জয়গান গেয়েছে।
সুতরাং, আজকের বিশ্বে ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে একটি শ্লোগানই উচ্ছারিত হোক- ”ধর্ম যার যার; মানবসেবা সবার’ । এতে বিভিন্ন বিভাগের প্রধান, শিক্ষক-শিক্ষিকা, কর্মকর্তা,ছাত্র-ছাত্রীগণ উপস্থিত ছিলেন।