যে শহরটা কথা বলে……

রাজধানী ঢাকার পাশে যে ক‘টি উন্নত জেলা রয়েছে তার মধ্যে কুমিল্লা অন্যতম একটি জেলা। শিক্ষা-শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি আর আন্দোলনের পাদপীঠ কুমিল্লা। প্রাচীন ঐতিহ্য সমৃদ্ধ জেলা হিসেবে কুমিল্লা এ উপমহাদেশে বেশ সুপরিচিত।

কুমিল্লার খাদি শিল্প, তাঁত শিল্প, কুটির শিল্প, মৃৎশিল্প ও কারুশিল্প, ময়নামতির শীতল পাটি ইত্যাদি স্ব-স্ব ঐতিহ্যে স্বকীয়তা আজও বজায় রেখেছে। কালের বিবর্তনের ধারা এসেছে অনেক কিছু, অনেক কিছু গেছে হারিয়েও, হারায়নি এখানকার মানুষের আন্তরিকতাপূর্ণ আতিথিয়েতা ও সামাজিক সম্প্রীতি। কুমিল্লাকে নিয়ে অনেকেই লিখেন আবার অনেকে লিখেনও না আমি আজ দৈনিক আজকের কুমিল্লা পত্রিকার প্রথম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে সামান্য কিছু লিখার চেষ্টা করেছি। প্রথমেই জেনে নেই এই কুমিল্লা নামের জন্মের ইতিহাস।

কুমিল্লা‘র জন্মের ইতিহাস শুরুতেই বর্ণনা করা কারণ হচ্ছে এখানকার কুমিল্লা নামের সৃষ্টির ইতিহাস জানা থাকলে হয়তো আমরা আমাদের সেই ঐতিহ্য লালন করে চলতে পারবো। এখন আর কুমিল্লার ঐতিহ্য নেই অনেকাংশেই হারাতে বসেছি আমরা কালের বির্বতনে।
বাংলা সাহিত্যের “ঐতরেয় আরণ্যক” নামক বইয়ে প্রথম ‘বঙ্গ’ নামক উপজাতির উল্লেখ পাওয়া যায়। ইতিহাস পাঠে আমরা ‘বঙ্গ’ ‘সমতট’, বরেন্দ্র’,‘গৌড়’,‘রাঢ়’ ইত্যাদি নামের সঙ্গে পরিচিত হই বইটিতে। কুমিল্লা ছিল প্রাচীন ‘সমতট’ জনপদের অংশ। চতুর্থ শতকের সমুদ্রগুপ্তের এলাহাবাদ স্তম্ভলিপিতে লিখা রয়েছে ভবাক-নেপাল-কর্তৃপুরে-কামদপরে সঙ্গে এবং বরাহ মিহিরের (৬ষ্ঠ শতক) ‘বৃহৎ সংহিতা’ পুন্ড্রা-তা¤্র-লিপ্তক-বর্ধমান-বঙ্গের সঙ্গে ‘সমতট’ নামে একটি জনপদের উল্লেখ পাওয়া যায়।

বর্তমান কুমিল্লা জেলা সেই সমতট রাজ্য ভুক্ত ছিল। ৭ম-১২শ শতাব্দি পর্যন্ত তা পল্লবীত হয়েছে। ১২৩৪ খ্রিষ্টাব্দে দামোদর দেবের অপ্রকাশিত মেহার পট্রোলী পড়ে প্রমাণ হয় কুমিল্লা জেলাই ছিলো সমতটের প্রধান কেন্দ্র। ভিবিন্ন যুগে বিভিন্ন ভাবে এ জেলার ভৌগলিক সীমা রেখা নির্ধারণ করা হয়েছে। ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী ১৭৬৫ সালে বাংলার দেওয়ানী লাভ করার পর ত্রিপুরাকে দুই অংশে ভাগ করে। এক অংশের নাম করণ করা হয় ‘চাকলা-রৌশনাবাদ’। অন্য অংশের নাম রাখা হয় ‘ত্রিপুরা’। তবে সামগ্রীক ভাবে ‘ত্রিপুরা’ বলতে কখনো পার্বত্য ত্রিপুরা, কখনো বর্তমান কুমিল্লা, আবার কখনো ত্রিপুরা-পার্বত্য ত্রিপুরাকে বুঝানো হত। এর সীমা ছিল বর্তমান বাংলাদেশের একচতুর্থাংশ এবং সিলেটের অর্ধাংশ। নোয়াখালীর এক তৃতীয়াংশ এবং ঢাকা জেলার কিয়দংশ। তার মধ্যে জেলার ত্রিপুরার ছয় আনা অংশ মাত্র। ত্রিপুরাধিপতিগনের জমিদারী ছিলো বেশ।

অপরদিকে ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পনী কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত বা ত্রিপুরা জেলার ‘ত্রিপরা প্রপার’ বলতে চাকলা-রৌশনাবাদকে বুঝাতো। প্রকৃত অন্য গ্রন্থে জানা যায় ইংরেজ সরকার এই জেলাকে তখন রৌশনাবাদ-ত্রিপুরা বলতো।

মুসলমান অধিকৃত এই ত্রিপুরার নাম ছিলো চাকলা-রৌশনাবাদ। এটি গঠিত হয়েছিল ২২ টি পরগনা নিয়ে। চাকলা-রৌশনাবাদ ছিল পর্বত্য ত্রিপুরার সর্ববৃহত্ত রাজ্য। বাংলার গর্ভণর সূজা-উদ-দৌলা কর্তৃক ১৭৩২ সালে বাংলার সঙ্গে একে সংযুক্তি করণের ফলে নামকরণ করা হয় চাকলা-রৌশনাবাদ। তখন চাকলা-রৌশনাবাদের দায়িত্বে ছিলেন ত্রিপুরা রাজ্যের ভারপ্রাপ্ত ইংরেজ রেসিডেন্ট। আর ত্রিপুরা ও নোয়াখালীর অন্তর্গত অন্যান্য মহলের দায়িত্ব অর্পিত হয় ঢাকার রাজস্ব কর্মচারীদের হাতে। ওই সময় বেশ ক‘বছর সেনাবাহিনী মারফত এর খাজনা আদায় করা হতো। কেবল ১৭৭৬ খ্রিষ্ট্রাব্দে পার্বত্য ত্রিপুরার মহারাজার সঙ্গে নিয়মিত খাজনা আদায়ের বিষয়ে চাকলা-রৌশনাবাদের সমঝোতা হয়। তখন ক্রমে ১৭৯৩ সালে মহারাজার হাতে এর শাসন ভার চলে
যায়।

এর আগে চাকলা-রৌশনাবাদ আধা সরকারী অঞ্চল ছিল। এই সময় এই অঞ্চলের অধীন নোয়াখালী এবং ত্রিপুরা চলে আসে। পরবর্তীতে ত্রিপুরা আর নোয়াখালী এ দুইটিকে বিভক্তি করণের ফলে চাকলার কিছু অংশ ত্রিপুরায় থেকে যায়।

১৭৮৯ পর্যন্ত কেবল রাজস্ব আদায়ের সুবিধার জন্যই এটিকে জেলা হিসেবে আখ্যায়িত করা হত। আমাদের সবচেয়ে সৌভাগ্য হলো ১৭৯০ সালে তৎকালীন জেলা মেজিস্ট্রেট বুলার সাহেবের সুপারিশ ক্রমে ত্রিপুরা জেলার প্রতিষ্ঠা হয়। এর মধ্যে সীমানা নেয়া হয় দাউদকান্দি, গঙ্গামন্ডল, বরদাখাত, ভুলুয়া (নোয়াখালী) পরগনা নিয়ে। ১৭৯৩ সালে সরাইল, দাউদপুর, হারিপুর, বেজরা পরগনা ছাড়াও নোয়াখালীর মূল ভুখন্ড নিয়ে পূর্ণাঙ্গ ত্রিপুরা রাজ্যে গঠন হয়। ১৮২১ সালে নোয়াখালী একটি জেলা হিসেবে মর্যাদা পেয়ে পৃথক হয়। পরবর্তীতে ত্রিপুরা থেকে ১৮৩০ সালে ছাগলনাইয়া থানা ব্যতীত নোয়াখালীর বাকি অংশ ত্রিপুরা জেলা থেকে নোয়াখালী জেলায় চলে যায়। এবং পরবর্তীতে ১৮৭৬ সালে ছাগলনাইয়া থানাও ত্রিপুরা থেকে বিচ্ছিন্ন হয় । ঢাকার জেলার গজারিয়া থানা ত্রিপুরা তথা কুমিল্লা জেলার অধীনে ছিল।

২০শতকের দ্বিতীয় পাদে তা ত্রিপুরা হতে বিচ্ছিন্ন করে ঢাকার মুন্সীগঞ্জ মহকুমার সঙ্গে যুক্ত করা হয়। এতে করে ত্রিপুরা অনেকটা ছোট হতে থাকে ১৯৬০ সাল পর্যন্ত জেলাটি ত্রিপুরা জেলা নামেই পরিচিত ছিল। ১৯৬০ সালের আগস্ট মাসে এক প্রশাসনিক আদেশে এটিকে কুমিল্লা জেলা নামে অবিহিত করা হয়। বর্তমানে এই নামেই এই জেলা সুপরিচিত। কুমিল্লার দেশের পুরাতন ১৯ জেলার অন্যতম জেলা। ১৯৮৪ সালে কুমিল্লার অন্তর্গত চাঁদপুরও ব্রাহ্মনবাড়িয়া মহকুমা দুটি পৃথক জেলার মর্যাদা লাভ করে কুমিল্লা থেকে প্রশাসনিক ভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এর পূর্বে এই দুই মহকুমা সহযোগে কুমিল্লার পরিচিত ছিলো বৃহত্তর কুমিল্লা হিসেবে।

বর্তমান কুমিল্লা জেলায় একটি সিটি কর্পোরেশন, ৮টি পৌরসভা, ১৭টি উপজেলা রয়েছে। এই উপজেলা গুলো হলো- আদর্শ সদর, কুমিল্লা সদর দক্ষিণ, চৌদ্দগ্রাম, লাকসাম, বরুড়া, নাঙ্গকোট, মনোহরগঞ্জ, চান্দিনা, তিতাস, দাউদকান্দি, হোমনা, মেঘনা, মুরাদনগর, দেবিদ্বার, বুড়িচং, ব্রাহ্মণপাড়া ও লালমাই। উল্লেখ্য যে, এখন পর্যন্ত কুমিল্লাই বাংলাদেশের একমাত্র জেলা যাতে সাবার্ধিক সংখ্যক উপজেলা রয়েছে। পরবর্তীতে কুমিল্লা জেলার ঐতিহ্য আর অবকাঠামোগত উন্নয়ন দেখে ১৮৬৪ সালে কুমিল্লায় পৌরসভা প্রতিষ্ঠিত হয়। ২০১১ সালের ২৩ জুন স্থানীয় সরকার বিভাগ কুমিল্লা সদর ও কুমিল্লা সদর দক্ষিন পৌরসভা বিলুপ্ত করে কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশন (কুসিক) গঠন করে এবং ১০ জুলাই ২০১১ সালে এর গেজেটের মাধ্যমে তা প্রকাশ করে। ওই দিনই কুমিল্লা লাভ করে দেশের ৮ম সিটি কর্পোরেশনের মর্যাদা।

আমি যে বিষয়টি আজ বলতে এসেছি এবার আসি মূল আলোচনায়। আমাদের দেশের অন্যান্য জেলার মতো ধর্মীয় পরিচয় দৃষ্টির আলোকে কুমিল্লাতে আনুপাতিক হারে মুসলিম-হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান জনগণের বসবাস রয়েছে। আমরা আমাদের এই শহরে সব ধর্ম-সম্প্রদায়ের মানুষ মিলেমিশে বসবাস করে আসছি কাল আর বংশ পরামপরায় যা বাংলাদেশর অন্যান্য জেলার শহরের চেয়ে ঐতিহ্য মন্ডিত ও ভিন্নতর। এ জেলায় যুগে যুগে অনেক রাজনৈতিক নেতা কিংবা নামি দামি ব্যক্তির জন্ম হয়েছে। যাদের আলোকিত জিবনের ফলে আজ কুমিল্লার নাম বাংলাদেশর ইতিহাসের প্রথম পরতে অবস্থান করছে। আন্তর্জাতিক সীমান্ত দৈর্ঘ্য হিসেবে কুমিল্লার দৈর্ঘ্য ১০৬ কিলোমিটার এবং ৩০৮৭.৩৩ বর্গ কিলোমিটার।

আমাদের জেলার উত্তরে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা, দক্ষিণে ফেনী ও নোয়াখালী জেলা, পূর্বে ভারতের ত্রিপুরা, পশ্চিমে চাঁদপুর, নারায়ণগঞ্জ ও মুন্সীগঞ্জ জেলা। আলোচনা করতে গিয়ে আমি বলে রাখি জাতিসংঘের একটি হিসাব অনুযায়ী কুমিল্লা জেলা হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ জেলা এবং কুমিল্লা শহর হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে ঘনবসতি পূর্ণ শহর। যার মধ্যে বিলুপ্ত কুমিল্লা পৌরসভার জনসংখ্যা ৩ লক্ষাধিক এবং সদর দক্ষিণ পৌরসভার জনসংখ্যা ১ লক্ষাধিক মিলে বর্তমানে কুমিল্লা শহরে তথা সিটি কর্পোরেশনে বসবাস করছে ৩,৩৯, ১৩৩ জন। তারমধ্য পুরুষ ১,৭৭,৩০০ জন ও মহিলা ১,৬১,৮৩৩ জন (২০১১ সালের আদম শুমারী অনুযায়ী)। কুমিল্লা সদর ও সদর দক্ষিণ পৌরসভা মিলে বর্তমান মহানগরের আয়তন ১৭.৯৪+৩৫.১০=৫৩.০৪ বর্গ কি.মি.। এখানে এই তথ্যটি একারণে তুলে আনলাম কারণ সিটি করর্পোরেশন নির্বাচনের পূর্বে কিংবা তারও আগে এই নগরীর বসবাসের একটি পরিসংখ্যানে নগর পরিকল্পনাবিদরা উল্লেখ্য করেছিলেন আগামী পঞ্চাশ বছরেও কুমিল্লা শহর উত্তর ও পূর্ব দিকে বর্ধিত হওয়ার কোন কারণ নেই। কারণ এই মহানগরীর উত্তরে গোমতী নদী এবং পূর্ব দিকে ভারত।

তাহলে আমাদের এই শহরের কি হবে আগামী পঞ্চাশ বছর পর ধ্বংস হয়ে যাবে নাকি আমরা এই শহর রক্ষায় কার্যকর কোন প্রকার পদক্ষেপ নেবো। এ প্রশ্ন কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশন নিবার্চনের পূর্বে টাউন হল মিলনায়তনে এক আলোচানা সভায় বার বার উঠে এসেছিল। আমি তখন কুমিল্লা সাংবাদিকতা করার ফলে এই অনুষ্ঠানটিতে থাকার সুযোগ হয়।

যাপিত জিবনের এই স্বল্প সময়ে আমি দেশের বিভিন্ন জেলায় শহরে যাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছে। আমার জিবন পরিচালনায় মা-বাবার পর যাকে অভিবাবক হিসেবে মানি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় রেলপথ মন্ত্রী কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা আওয়ামীলীগের বিপ্লবী সাধারণ সম্পাদক কুমিল্লার সম্পদ শ্রদ্বেয় মোঃ মুজিবুল হক এমপি মহোদয়ের ব্যক্তিগত কর্মকর্তা হিসেবে। যে জেলাতেই গিয়েছি কুমিল্লার নাম শুনলে আলাদা একটি সুনাম সুখ্যাতি দিয়ে সম্মোধন করে প্রতিটি মানুষ, দেশের অত্যান্ত সুনামধন্য জেলার মধ্যে আমাদের জেলার নাম সবার মুখে থাকেই। তবে দূভার্গ্য আমি এ কুমিল্লার ছেলে হয়েও কুমিল্লার মতো ঐতিহাস-ঐতিহ্য লালিত শহরের অব্যবস্থাপনা আজ লিখেছি।

Post MIddle

আমি আমার ব্যক্তিগত অভিমত থকে যতটুকুই পেরেছি নাগরিক সমস্যা গুলো তুলে ধরেছি এখানে কাউকে হেয় করার উদ্দেশ্যে নয়। কুমিল্লার অব্যবস্থাপনা এখন শুধু মাত্র আমাকে নয় নগরের অধিকাংশ মানুষকেই হতাশ করে। প্রতিদিন হতাশা নিয়েই নগরীতে বসবাসরত নাগরিকরা তাদের কর্মব্যস্ত জিবন শুরু করে আবার হতাশা নিয়েই বাসায় ফিরে। সম্ভাবনা কিংবা উত্তরণের কোন সুষ্ঠ সমাধান নিয়ে ফিরে না। এক সময় শিক্ষা সাহিত্য আর সংস্কৃতির পাদপীঠ হিসেবে থাকা সেই খ্যাতিও মুছে যাবার পথে। আমাদের ২০১১ সালের গননা অনুপাতে আমারা ৬০.০২% শিক্ষিত মানুষ এই জেলায় বসবাস করি। আমি দেখেছি দেশের বিভিন্ন পৌরসভা কিংবা সিটি কর্পোরেশনের প্রতিটি রাস্তায় নাগরিকদের অবাধে চলাচলের ব্যবস্থা কি সুন্দর কতোই না নিপূণ ভাবে তৈরী করেছে একেকটি সিটি করর্পোরেশন। দূর্ভাগ্য আমাদের আমরা কেনই যে পারছিনা। একটি বিষয় জনশ্রুতি রয়েছে কুমিল্লা শহর নিয়ে কেন যেন কারোই মাথা ব্যথা নেই। যে যার মতোই দখল আর নিজ নিজ অবস্থান থেকে লুটপাটে ব্যস্ত। সমস্যা সম্পর্কে আপনি আমি হরহামেশাই চিন্তা করে থাকি চায়ের দোকানে হোক আর রেস্টুরেন্টেই হোকনা কেন। কথা গুলো হচ্ছে এমন-

দেশের একটি প্রথম সারির জেলায় কোথায় আবাসিক এলাকা কোথায় বাণিজ্যিক এলাকা হবে তারও কোন প্রকার মনে হয় যেন নিয়মনীতি নেই। নগরীর কান্দিরপাড় একটি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক এলাকা এখানেও অবাধে উঠছে আবাসিক ভবন কিংবা বাণিজ্যিক ভবন। যে ভবন গুলোতে দিব্যিই পরিবার নিয়ে বসবাস করছে অধিকাংশ কর্মজিবী মানুষ। নগরীতে প্রতিদিনই নির্মাণ হচ্ছে বহুতল ভবন অথচ কি দূর্ভাগ্যই না আমাদের কিছু সংখ্যক ভবন ব্যতিত অধিকাংশ ভবনেই নেই কার পার্কিং ব্যবস্থা। কোন ভবনেরই পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা রাখা হচ্ছে না মানা হচ্ছেনা বিল্ডিং কোড নেই পার্কিং ব্যবস্থা। শহর একটাতে যানজট লেগেই থাকে। এদিকে কেউ নজর দেয়না সবাই সবার মতো করে লুটে পুটে খাচ্ছে । মাসিক সিএনজি, অটোবাইক, ইজিবাইক থেকে তোলা হচ্ছে লক্ষ লক্ষ টাকা চাঁদা। প্রশাসনের চলছে তোষামোধী কে অবাধে বিক্রি হচ্ছে মাদক থানায় বেচা কেনা হয় গাঁজা। কে বলবে কে লিখবে সবাইতো ভয়পায়। এসব আমার মুখের কথা নয় কুমিল্লা শহরে যে কোন মানুষকে নিবির ভাবে জিজ্ঞাসা করবেন আমার কথা গুলোর সাথে হুবহু মিলে যাবে। এবার আসেন আমার কথায়

যানজট নিরসনে জেলা প্রশাসনের প্রতিটি মাসিক উন্নয়ন সভা কিংবা আইন শৃঙ্খলা কমিটির সভায়। সমাজের দায়িত্বশীল কিংবা প্রশাসনের কর্তা ব্যক্তিরা বলে থাকলেও তা টেবিলেই সীমাবদ্ধ থেকে যায়। একটি উন্নত জেলা হিসেবে এখানে নেই কোন প্রকার নিয়মের বলয়। নেই কোন প্রকার জবাবদিহীতা আপনি কুমিল্লা শহরে প্রবেশের কোন পথেই সহজে প্রবেশ করতে পারবেন না। কারণ প্রতিটি প্রবেশ পথেই অপরিকল্পিত ভাবে মাসিক হারে চাঁদা নিয়ে তৈরী করা হয়েছে সিএনজি স্ট্যান্ড। উদাহরণ হিসেবে বলাযায় একসময় কুমিল্লা শহরের মূলবাণিজ্যের প্রাণ কেন্দ্র বলা হতো নগরীর চকবাজারকে। প্রতিদিন লক্ষ লক্ষ টাকার বাণিজ্য হতো কিংবা এখনো হয়ে থাকে অথচ তার প্রধান সড়কটিতে প্রবেশ যদি আপনি তেলীকোটা চৌমুহোনী দিয়ে প্রবেশ করে কাশারীপট্টি মোড় পর্যন্ত আসতে চান তাহলে আপনার অন্তত আধাঘন্টা কিংবা এক ঘন্টা সময় লাগবেই এটি নিত্যদিনের দূর্ভোগ।

আপনি এখান দিয়ে প্রবেশ করবেন না ধরে নেন আপনি প্রবেশ করবেন টমছমব্রীজ দিয়ে শহরের প্রবেশের জন্য এই পথটি আপনার জন্য কমর্ফোটেবল হবে। দূভার্গ্য হলেও সত্য আপনি নগরীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইন্সটিটিউট এলকা থেকে নিউ হোস্টেল পর্যন্ত সড়কটিতে যানজটে আটকা পড়ে বসে থাকতে হবে অধাঘন্টা থেকে একঘন্টা। ইতোপূর্বে অনেক লেখালেখির পর এখান থেকে বাস স্ট্যান্ড সরিয়ে নগরীর জাঙ্গালিয়া এলাকায় নেয়া হলেও বর্তমানে “যেই লাউ সেই কদু” অবস্থা। এবার প্রবেশের চেষ্টা করুন আপনি শাসনগাছা দিয়ে এই পথটি দিয়েও প্রবেশ করতে আপনার সময় লাগবে আধাঘন্টা কিংবা এক ঘন্টা। কারণ এখানেও মাসিক হারে চাঁদা নিয়ে সিএনজি এবং বাস স্ট্যড করা হয়েছে মূল সড়কের মাঝ খানেই। এই সমস্যা গুলো আজকের নয়, দীর্ঘদিনের। আমরা কুমিল্লার মানুষ নিজেদের নিয়ে অনেক সচেতন নগরীতে বসবাসকরা প্রতিটি নাগরিকই পরিবার নিয়ে চলাচলে দেশের অন্যান্য জেলার নাগরিকদের তুলনায় অনেকটাই স্বচ্ছন্দে বসবাসে বিশ^াসী।

সেক্ষেত্রে নিজ নিজ অবস্থান থেকে সৌখিনও বটে, কালের পরিক্রমায় জেলার ঐতিহ্য পূর্বের তুলনায় বর্তমানে হিসেবে করে দেখা গেছে অনেকাংশই হারাতে বসেছি আমরা। পিছিয়েছি শিক্ষার হারেও এখন আর চট্টগ্রাম বিভাগে আমরা প্রথম হইনা।

কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশন ঘোষনার পর আমরা কুমিল্লার নাগরিকরা অনেকটা আনন্দে আত্মহারা হলেও বর্তমানে কুমিল্লা শহরে বসবাসকারী অধিকাংশ নাগরিকই শহরের এই অব্যবস্থাপনা দেখে আত্মচিৎকার করে দায়িত্বশীলদের ধিক্কার দিয়ে থাকেন একথা দিবালোকের ন্যায় সত্য। কেননা আপনি নগরীতে আপনার কোমলমতি শিশুকে নিয়ে ঘুরতে বের হবেন তাতে বাসা থেকে বের হলেই পাবেন অপরিকল্পিত ভাবে মাসিক মাশোয়ারা তুলে অনুমোতি দিয়ে চলা ইজিবাইক আর আটোবাইকের লাগামহীন ভাড়া নৈরাজ্য। পাবেন ঘোষের টাকা নিয়ে গোপনে অনুমোদন দেয়া অসংখ্য অগনিত রিক্সার জটলা। অপরিকল্পিত হাই রাইজ বিল্ডিং হচ্ছে দিনদিন ডেভেলপার প্রতিষ্ঠান সমূহ সিটি কর্পোরেশনের কিছু অসাধু কর্মকর্তাদের অদুরদর্শি সিদ্ধান্তের মাধ্যমে অনুমোদন নিয়ে শহরকে একটি ইটকাঠের নগরীতে পরিণত করছে। শুধু নির্মাণই করছে কিন্তু চিন্তাই করছেনা তার সাথে চাই সুষ্ঠ পয়নিষ্কাশন ব্যবস্থা, ড্রেনেজ সিষ্টেম, পরিকল্পিত ওয়েষ্ট ম্যানেজম্যান্ট, নিরাপদ খাবার পানি, বিদ্যুৎ ও গ্যাস এর সরবরাহ কিভাবে নিশ্চত হবে। প্রতিদিন পুকুর ভরাট আর গাছপালা কেটে ভবন নির্মাণের ফলে প্রাকৃতিক দুর্যোগ, দূর্বিপাক নদী ভাঙ্গন, খরা, অতিবৃষ্টি অনাবৃষ্টি ইত্যাদি কারনে বর্তমানে নগরীতে সামান্য বৃষ্টি এলেই প্রধান প্রধান সড়ক গুলো তলিয়ে যায়। যা কুমিল্লা নগর বাসীর জন্য এখন মহামারী আকার ধরারণ করে আছে।

আমি এই লেখাটিতে শুধু মাত্র কুমিল্লা মহানগরীতে বসবাস করী নাগরিকদের মৌলিক সুবিদা অধিকার যখন শিকরে বন্দি ঠিক তার মাঝ থেকে দু‘চারটি তথা সামন্য তুলে ধরেছি।

আমি আমার ক্ষুদ্র মেধা দিয়ে এসব অব্যবস্থাপনা থেকে উত্তরণের পথ কিভাবে তার মধ্যে যতটুকু বলতে চেয়েছি তা হলো- এখানে আমাদের মনে রাখা দরকার নগরীতে আবাসিক এলাকা এবং বাণিজ্যিক এলাকাকে আমরা পৃথক না করলে আমরা কোনদিনই এ শহরকে একটি পরিকল্পিত নগরী হিসেবে ভাবতে পারবো না এটা পরিষ্কার। ইতোপূর্বে নগরীর পরিধি দক্ষিণে বর্ধিত হয়েই আছে রয়েছে হাউজিং স্ট্রেট এলাকাও। এখন সুযোগ রয়েছে পশ্চিম দিকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক পর্যন্ত বর্ধিত হওয়া। কারণ এর পশ্চিমে সেনানিবাস, শালবন বিহার ময়নামতি যাদুঘর, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। যদি তাই হয় তবে এই মহানগরীর বর্তমান আয়তনের সাথে আরো ১৫ বর্গ কি.মি. যোগ হবে, মহানগরের আয়তন হবে ৬৮.০৪ বর্গ কি.মি.।

ধরে নেয়া যায় জনসংখ্যার বৃদ্ধির হার বর্তমানে হারে বর্ধিত হলে জনসংখ্যা আরো বেড়ে যাবে। যদি জনসংখ্যা বৃদ্ধি পায় তবে বর্তমানে কুমিল্লা শহরে জনসংখ্যা হবে ৬ লক্ষাধিক আর সদর দক্ষিনের জনসখ্যা হবে ৪ লক্ষাধিক অথচ বর্তমান কুমিল্লা শহরের চেয়ে সদর দক্ষিণ এলাকা ৩ গুন বেশী বড় তাই এখানে মানুষের বসবাস বৃদ্ধি করলে শহরের উপর থেকে চাপ অনেক কমে যাবে। এখনই পরিকল্পনা নিতে হবে কি করে পুরাতন কুমিল্লা শহরের জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করে ও জনসংখ্যা সদর দক্ষিনে সঞ্চালন করে জনসংখ্যার হার আয়তন অনুযায়ী সমানুপাতিক করা যায়। মোটকথা শুধু মাত্র কুমিল্লা শহর তথা পুরাতন শহরের দিকে ধাবমান মানুষের শ্রোত ঠেকানো জরুরী। এখানে নগরীর বড় বড় প্রতিষ্ঠান গুলোর অধিকাংশ সড়িয়ে সদর দক্ষিণ অংশ কিংবা নগরীর পদুয়ার বাজার বিশ^রোড অংশে স্থানান্তর করা।

নগরীতে যেমন রয়েছে অসংখ্য নামী দামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ঠিক তেমনী সদর দক্ষিণ অংশে এমন কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা গেলেও শহরের উপর থেকে অধিকাংশ চাপ কমতে পারে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, দূর্বিপাক নদী ভাঙ্গন, খরা, অতিবৃষ্টি অনাবৃষ্টি ইত্যাদি কারনে বর্তমানে নগরীতে সামান্য বৃষ্টি এলেই প্রধান প্রধান সড়ক গুলো তলিয়ে যায়। এ থেকে উত্তরণের পদক্ষেপে হাতে নিয়েও সিটি কর্পোরেশন বার বার ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে।

শহরটির কোল ঘেষে বয়ে যাওয়া গোমতী নদীর সাথে শহরের ট্যানেলের ন্যায় বিশাল আকারের ড্রেনেজ ব্যবস্থা নগরের পানি নিষ্কাশরের একটি মহা উদ্যোগ হতে পারে।

এখানে হতাশ হওয়ার কিছু নেই। বিশ্বায়নের এ যুগে সিটি কর্পোরেশন নিজেও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান যদি তাদের কর্পোরেট রেন্সপনসিবিলিটি পালন করে প্রযুক্তি নির্ভর জ্ঞান নিয়ে বাস্তবতা বিচার করে সুপরিকল্পিতভাবে পরিকল্পনা মাফিক এগুতে পারে। তবে এই মহানগরবাসী আগামী অর্ধশতকে কুমিল্লাকে একটি সুখী সুন্দর সমৃদ্ধশালী পরিকল্পিত নগরী হিসেবে দেখতে পাবে তা দূরে নয়। তবে পূর্বের পৌরসভার পরিকল্পনা ও সওরেজ এবং পয়নিস্কাশন ব্যবস্থা মাথায় রেখে বিল্ডিং কোড না মেনে অপরিকল্পিতভাবে হাইরাইজ দালান কোঠা নির্মানের প্রতিযোগিতায় যেভাবে নেমেছে কুমিল্লার বড় বড় কর্তারা। এতে করে কুমিল্লার ভবিষ্যত নিশ্চত ধ্বংসের দিকে তাতে কোন সন্দেহ নেই।

আমাদের কুমিল্লাতে একটি কথা জনশ্রুতি রয়েছে এই অপরিকল্পিত হাই রাইজ বিল্ডিং সমূহের নির্মাতা ডেভেলপার প্রতিষ্ঠান সমূহ এবং বিগত কুমিল্লা পৌরসভার নির্বাচিত ও অনির্বাচিত কর্মকর্তাদের মাঝে কিছু অসাধু কর্মকর্তা এখনো প্রশাসনে বিভিন্ন টেবিলে বসে আছে বহাল তাবিয়ে। তাদের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া জরুরী। আমাদের মনে রাখা উচিত শুধু হাইরাইজ বিল্ডিং নির্মান করেই মহানগরকে উন্নত করা যাবে না। তার সাথে চাই সুষ্ঠ পয়নিষ্কাশন ব্যবস্থা, ড্রেনেজ সিষ্টেম, পরিকল্পিত ওয়েষ্ট ম্যানেজম্যান্ট, নিরাপদ খাবার পানি, বিদ্যুৎ ও গ্যাস এর সরবরাহের নিশ্চিত ব্যবস্থা করা। আসুন না এক এক করে এই মহানগরের বর্তমান সমস্যা সমূহ মাথায় নিয়ে সিটি কর্পোরেশন নগরপিতা কিংবা স্থানীয় জনপ্রতিনিধি বৃন্দের পর্যালোচনার মাধ্যেমে আমরা কুমিল্লাকে এগিয়ে নিয়ে যাই। ভবিষ্যত প্রজন্মকে উপহার দেই একটি সুষ্ঠ সুন্দর আর মনোরম পরিবেশের কুমিল্লা।

সাংবাদিক এস এন ইউসুফ

লেখক- সাংবাদিক এস এন ইউসুফ, মাননীয় রেলপথ মন্ত্রী মহোদয়ের ব্যক্তিগত কর্মকর্তা ও বার্তা সম্পাদক-দৈনিক ময়নামতি।

পছন্দের আরো পোস্ট