হোয়ার টু ইনভেড নেক্সট

Where to Invade Next (২০১৫) হলো একটি আমেরিকান ডকুমেন্টরী ফিল্ম। যা লিখেছেন ও পরিচালনা করেছেন মাইকেল মুর। ফিল্মটি পরিপূর্ণ ভ্রমণের মধ্যে দিয়ে আমেরিকার সামাজিক, অর্থনৈতিক অভিজ্ঞতার সাথে ইটালী, ফ্রান্স, ফিনল্যান্ড, তিউনেশিয়া, জার্মানী, আইসল্যান্ড, নরওয়ে ও পর্তুগালের বিকল্প ধারার অভিজ্ঞতার তুলনা করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের চিন্তাভাবনা কীভাবে আরো উন্নত করা যায় এই উদ্দেশ্য নিয়েই মাইকেল মুরের বিশ্বভ্রমণ…

ইতালি: ইতালির জনসংখ্যা ৬১ মিলিয়ন। এরা সেক্সকে বেশ প্রাধান্য দেয়। ইতালিতে শ্রমিকদেরর অধিকার নিশ্চিত করা হয় যা তাদের ভালো জীবন যাপনে সহায়তা করে। ইতালিতে ছুটি, হানিমুন করতে আলাদাভাবে বেতন প্রদান করা হয়। এমনকি পিতা মাতার জন্য সমস্তু ব্যয়ভারও বহন করা হয়। মাইকেল মুর দুইজন শ্রমিক জানি এবং ত্রিস্ট্রিনার সাক্ষাতকার নেয়, তারা কীভাবে ছুটি কাটাতে পছন্দ করে? ইতালিরা প্রতি বছর ৩০/ ৩৫ দিন ছুটি কাটায়। এছাড়াও সরকারি ছুটি রয়েছে ১২ দিন। শীতকালে জুনের প্রথম দিকে ১ সপ্তাহের জন্য প্ল্যান করে ঘুরতে যাওয়ার জন্য। এমনকি হানিমুনের জন্য ১৫ দিন পেইড হলিডে পায়। ডিসেম্বরে অতিরিক্ত বেতন দেয়া হয় ইতালির শ্রমিকদেরকে। মোট ১৩ মাস বেতন পায় তারা। ইতালিতে ৫ মাসের মাতৃকালীন ছুটি পায় এবং সেই ছুটিতে র্পূণ বেতন পায় তারা। ইতালিরা একে ১২ মাসে ১৩ বারের মতো ছুটি মনে করে। ব্যাংকগুলোতে ৮০ দিন ছুটি পায়। কিছু কিছু কোম্পানিতে দুই ঘন্টার জন্য বাড়ি যায় লাঞ্চ করার জন্য। দুকাটি মোটরসাইকেল কোম্পানির মতো কিছু কিছু কোম্পনিতে মুনাফা বেশী হলে বেতন বেশী দেয় এবং সুযোগ সুবিধা বেশী দেয়। অন্যদিকে আমেরিকায় কোন পেইড হলিডে নেই। তবে অল্প কিছু কোম্পানিতে এক বছরে দুই সপ্তাহ পর্যন্ত পেইড হলিডে পেতে পারে।

ফ্রান্স: মুর ফ্রান্সের একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় পরিদর্শন করেন। সেখানে তিনি স্কুলের বিভিন্ন ধরনের খাবার এবং যৌন শিক্ষার দিকগুলি নিয়ে কথা বলেন। ফ্রান্সিসরা মূলত গণতন্ত্র ও অস্তিত্ববাদে বিশ্বাসী। তারা খাবার, সেক্স এডুকেশন ও ট্র্যাক্সকে প্রাধান্য দিয়ে থাকে। বলা হয়ে থাকে ফ্রান্সের একটা স্কুল ক্যাফেটেরিয়ার রান্নাঘরও থ্রি/ ফোর স্টার হোটেলের মতো। ফ্রান্সের স্কুলে খাবারের মেনুতে চিজ, ফলমূল, শাকসবজি দেয়। তারা কোকোকোলা জাতীয় কোন পানীয় দ্রব্য খায়না। অন্যদিকে আমেরিকার বাচ্চারা বার্গার, পিজ্জা, মাংস এগুলো বেশি খায়। ফ্রান্সের স্কুলের বাচ্চারা বলছে এগুলো স্বাস্থ্যকর খাবার নয়। স্কুলে নাস্তার জন্য ২০ মিনিট, দুপুরের খাবারের জন্য ১ ঘন্টা সময় পায় তারা। কীভাবে ম্যানার শিখতে হয়, তার জন্য একে অন্যকে খাবার পরিবেশন করতে শিক্ষা দেয়। আমেরিকার স্কুলগুলো স্বাস্থ্যকর এলাকায় অবস্থিত নয় অন্যদিকে ফ্রান্সের স্কুলগুলো স্বাস্থ্যকর এলাকায় অবস্থিত। ফ্রান্সের সবগুলো স্কুল প্রায় একই রকম। সবথেকে গরীব স্কুলের খাবারের মেনুতে ডিল সস, গোস্ত, মুসাকা, ভ্যানিলা ফ্রাউয়ারস্ধসঢ়;, চিজ এগুলো প্রতিদিন থাকে। তাদের হেলথ কেয়ার ও ডে কেয়ার রয়েছে। ফ্রান্সরা কোথায় কি ট্র্যাক্স দেয় তা প্রতিটা লাইন বাই লাইন দেয়া থাকে। ফ্রান্সরা যোদ্ধা নয় কিন্তু তারা প্রেমিক। তারা ভালোবাসতে শিক্ষা দেয়। ফ্রান্সরা সেক্স এডুকেশনকে প্রাধ্যান্য দেয়। আমেরিকায় ‘টিন প্র্যাগনেনসি’ রেট ফ্রান্সের দ্বিগুণ, জার্মানির থেকে ৬ গুণ, সুইজারল্যান্ডের থেকে ৭ গুণ।

ফিনল্যান্ড: শিক্ষার দিক থেকে অন্যতম হলো ফিনল্যান্ড। শিক্ষার দিক থেকে ফিনল্যান্ড ১ নম্বও অবস্থানে অন্যদিকে আমেরিকার স্টুডেন্টসরা ২৯ নম্বর অবস্থানে রয়েছে। ফিনল্যান্ডের শিক্ষার্থীদের মেধা যাচাইয়ের জন্য কোন পরীক্ষা নেয়া হয়না। তাদের কোনো হোমওয়ার্ক নেই। তাদের অনেক বেশী সময় দেয়া হয় মজা করার জন্য। স্কুলে গড়ে সপ্তাহে ২ টা ক্লাস করতে হয়। তাদের প্রত্যেকেই একাধিক ভাষায় কথা বলতে পারে। জার্মানি, স্প্যানিস, সুইডিশ, ইংরেজি প্রভৃতি ভাষা তারা পারে। ফিনল্যান্ডের স্কুল হচ্ছে সেটা যা সুখকে খুঁজে পেতে সাহায্য করে, যা সুখী করে। ফিনল্যান্ডের সবগুলো স্কুল একইরকম। সেখানে টিউশন ফি নেওয়া অবৈধ। সে কারণে সেখানে কোন প্রাইভেট স্কুল নেই। এটা দ্বারা প্রমাণ কওে যে তারা সবাই ধনী। অন্যদিকে আমেরিকার শিক্ষাব্যবস্থা হচ্ছে ব্যবসাকেন্দ্রীক। তারা টাকা উপার্জন করতে শেখায়। আমেরিকার স্কুলগুলোতে রাষ্ট্র সম্পর্কে পড়ানো হয়। সেখানে কোন কবিতা পড়ানো হয়না। কারণ তারা মনে করে এটা সময়ের অপচয়।

স্লোভেনিয়া: স্লোভেনিয়া ১২টি দেশ ও দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ফ্রি যাওয়া-আসা করতে পারে। স্লোভেনিয়ায় কোন টিউশন ফি নেই। স্লোভেনিয়ার শিক্ষাব্যবস্থা আমেরিকার শিক্ষাব্যবস্থার থেকে ১০০০ গুণ ভালো এবং তা তুলনাযোগ্য নয়। আমেরিকার শিক্ষাব্যবস্থা খুব কঠিন ও উচ্চ মাধ্যমিকের মতো। স্লোভেনিয়ায় অক্ষর ২৫ টি কিন্তু আমেরিকায় ২৬ টি। এরা দ’ি উচ্চারণ করে না। লুবিয়ানা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১০০ টার মতো কোর্স রয়েছে যা ইংরোজিতে শিক্ষা দেয়া হয়। স্লোভেনিয়ায় কলেজগুলো সবার জন্য উন্মুক্ত। একবার স্লোভেনিয়া সরকার টিউশন ফি আরোপ করার চেষ্টা করলে  তা বিক্ষোভের মাধ্যমে তারা দমন করে। ফ্রান্স, জার্মানি, ফিনল্যান্ডের থেকে আমেরিকার টিউশন ফি বেশী।

জার্মানি: জার্মানিতে সপ্তাহে ৩৬ ঘন্টা কাজ করতে হয় আর বেতন পায় ৪০ ঘন্টার। তারা যতক্ষণ কাজ করে ততক্ষণ শুধু কাজই করে। অবসর সময়টুকু তারা পোষা কুকুর অথবা গার্লফ্রেন্ডের সাথে কাটায়। জার্মানিতে সার্বজনীন চিকিৎসা সেবা রয়েছে, এমনকি তিন সপ্তাহ পর্যন্ত ফ্রি সেবা নিতে পারে তারা। জার্মানিরা ম্যাসাজ করাতে খুব পছন্দ করে। যখন তারা ম্যাসাজ করায় তখন তারা মনে করে যে, তারা স্বর্গে বাস করছে। প্রতিদিন জার্মানির প্রতিটি স্কুলে শিক্ষা দেয়া হয় যা তাদের পূর্বপুরুষেরা করে গেছে। তারা কীভাবে জীবনযাপন করেছে সেসব গল্প করতো যা জার্মানীর নাৎসীদের সাথে সম্পর্কিত। তারা তাদের পূর্বপুরুষদের স্মৃতি রক্ষার্থে রাস্তায়, সাইনবোর্ডে লিখে রাখে যাতে তারা তাদেরকে ভুলে না যায়। কখনও কেউ কোন যুদ্ধ বা কোথাও থেকে চলে যাবে আর কখনো ফিরে আসবে না এমন পরিস্থিতিতে তাকে ফিরিয়ে আনতে কি কি স্মৃতি হিসেবে ব্যবহার করা যায় সেজন্য সেসব বস্তু দিয়ে একটা স্যুটকেস ভর্তি করা হয়।

পর্তুগাল: পর্তুগাল ক্রীতদাস প্রথার অংশ হিসেবে ড্রামকে ব্যবহার করে। তারা মে ডে পালন করে। বেশীরভাগ রাষ্ট্রই মে ডে তে কাজ বন্ধ রাখে কিন্তু আমেরিকারা তা রাখে না। পর্তুগালে মাদক ব্যবহার করার জন্য কাউকে আটক করা হয়না। গত ১৫ বছরে কাউকে আটক করা হয়নি। এমনকি তাদের কোন শাস্তির ব্যবস্থাও নেই কিন্তু আমেরিকায় মাদকের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তির বিধান রয়েছে এমনকি তাদের ভোট দেওয়ার ও অধিকার নেই। মানুষের মর্যাদাই হচ্ছে পর্তুগালের সমাজের মেরুদন্ড এমনকি পর্তুগালে শাস্তি হিসেবে কোন মৃত্যুদন্ড নেই। কারণ তারা মনে করে মৃত্যুদন্ড মর্যাদাহানিকর। এছাড়াও পর্তুগালে রয়েছে সার্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা, যাতে মাদকসেবীরাও স্বাস্থ্য সেবা নিতে পারে।

নরওয়ে: নরওয়ের কারাগারের সিস্টেম হলো পুনর্বাসন ও কোন প্রতিশোধ স্পৃহা না জাগানো। কারাগারে টিভি দেখা, সাইক্লিং, বাস্কেটবল খেলা, মাছ ধরা সবই করা যাবে শুধু বাইরে যেতে পারবে না। তাদের মূল থিম হচ্ছে আসামীদের স্বাধীনতাকে ছিনিয়ে নেয়া। তারা তাদের বন্ধু, পরিবারকে মিস করবে, এটাই তাদের শাস্তি। কারাগারে আসামীরা অস্ত্রও রাখতে পারে। একটা ভবনে ১১৫ জন আসামীর বিপরীতে মাত্র ৪ জন নিরস্ত্র গার্ড থাকে। অন্যদিকে আমেরিকা অপরাধ প্রবণতার দিক থেকে বিশ্বে অন্যতম। আর ৮০ ভাগ আসামীই পাঁচ বছরের মধ্যেই আবার অ্যারেস্ট হয়। এদিকে নরওয়েতে সবথেকে নিম্ম ২০ ভাগ। নরওয়ের আসামীরা ভোট দিতে পাওে এমনকি তারা কারাগারের ভেতর থেকে ডিবেট করতে পারে, লাইভ প্রোগামে যোগ দিতে পারে। কারাগারে যে লাইব্রেরি আছে তা আমেরিকার স্কুল লাইব্রেরির মতোই। সেখানে রেকর্ডিং স্টুডিও রয়েছে। তাদের সবার মূল থিম হলো নরওয়ের যত্ন নেয়া। নরওয়ের সর্বোচ্চ শাস্তি ২১ বছরের জেল। যা বিশ্বের সর্বনিম্ম খুনিদের শাস্তি।

তিউনিশিয়া: উত্তর আফ্রিকার একটা মুসলিম দেশ তিউনিশিয়া। নারীদের জন্য ফ্রি হেলথ কেয়ার রয়েছে এব সেখানে ১৯৭৩ সাল থেকে গর্ভপাত বৈধ ও গর্ভপাত ফ্রি। সেখানে নারীদের সমান অধিকার রয়েছে। নারীরা ভালো শিক্ষা, ভালো কাজের সুযোগ পায় যাতে সে অধিকতর ভালো জীবনযাপন করতে পারে এবং পরিবার পরিকল্পনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সংবিধানের ৪৬ নং অনুচ্ছেদে নারীদের অধিকারের কথা বলা হয়েছে। তিউনিশিয়ান বিপ্লব তথা আরব বসন্তে সে দেশের মেয়েরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। মুসলিম রাষ্ট্র হলেও মেয়েদের হিজাব পড়া বাধ্যতামূলক নয়। তাছাড়া মেয়েদের পোশাক ও জীবন যাপনে রাষ্ট্র কোন হস্তক্ষেপ করে না।

আইসল্যান্ড: আইসল্যান্ডে ১৯৭৫ সালের ২৪ অক্টোবর নারী আন্দোলন বা ধর্মঘট শুরু হয়। এরপর থেকে বছরের এইদিনে ৯০ ভাগ নারী কোন কাজ করে না। কোন স্কুল, ব্যাংক খোলা থাকে না, বাস চলাচল করে না। নারীরা এইদিনে কোন কাজ করে না। তারা তাদের গুরুত্ব বোঝায় এবং ছেলে মেয়ে উভয়ই সমান তা বোঝায়। আন্দোলনের পাঁচ বছর পরে এই দিনে তারা বিশ্বের প্রথম গণতান্ত্রিকভাবে নারী প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করে। আইসল্যান্ডে বড় কোন কোম্পানিতে ৪০% মেয়ে ও ৪০% পুরুষ কোটা থাকে।

পরিশেষে বলা যায়, এভাবে সকল দেশের উন্নত চিন্তাধারা বা তাদের ভালো দিকগুলো নিয়ে যদি কোন দেশের অবকাঠামো ঢেলে সাজানো হয় তাহলে তা নিঃসন্দেহে পুরো বিশ্বের জন্য আদর্শের বিষয় হবে।

পছন্দের আরো পোস্ট