মুহূর্ত মনোময়

চা বানানোর পরীক্ষার্থী হিসেবে যে কোন এক্সামিনারের কাছে আমি দশে সাড়েনয় পাবো। এ পর্যন্ত আমার চা নিয়ে গল্প, কবিতা কম হয়নি। আমার বড় ভাই তো আমার চায়ের একটা স্পেশাল নামও দিয়ে ফেলেছেন। সক্কাল সক্কাল নিজের হাতে বানানো এককাপ (নিজ দায়িত্বে বিশাল মগ পড়ুন) চা না পেলে আমার মা কালী রূপ ধারণ করে জগৎসংসার তছনছ করে দিতে ইচ্ছে করে। চা হাতে পেলেই আমি শান্ত সরস্বতী। জেগে জেগেই কতবার স্বপ্ন দেখেছি আমি চা শ্রমিক বিধুলালের বিয়ে করা বউ। স্কুলে একবার জিজ্ঞেস করেছিলো বড় হয়ে কী হতে চাও। আমি ঝটপট উত্তর দিয়েছি বড় হয়ে চা শ্রমিক হতে চাই।

বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম বর্ষেই আমার ফ্যাকাল্টির পিছনে চা বিক্রেতা চাচার সাথে কঠিন ভাব জমে গেল। দেখলাম আমি এবং গুটিকয় চা-খোর ছাড়া কেউই চাচার দোকানে চা খেতে আসে না। চাচার দোকানে চায়ের সাথে কলা,বিস্কিট, রুটি এসব পাওয়া যায় বটে কিন্তু সিগারেট পাওয়া যায় না বলে কেউ আর শুধু চা খেতে চাচার দোকানে আসে না। একদিন আক্ষেপের সাথে চাচাকে বলতে শুনলাম, ‘মা জননী ভাবিছিলাম সিগ্রেট জীবনেও বেচপো না। নিজ হাতি পোলাপানগের নিশার কাঠি তুইলে দিবার মন টানে না গো আম্মা। কিন্তু না বেইচে আর উপায় নাই মনে হচ্চে। পাঁচ পাঁচটা প্যাট। আমাগের চলবি কি দিয়ে কন।’
– চাচা সিগারেট কিনবেন না। কাল আপনার দোকানে এসে আমি চা বানানোর একটা গোপন মন্ত্র শিখিয়ে যাবো। এরপর পাশের দোকানে থেকে সিগারেট কিনে আপনার দোকানে বসে যদি সবাই চা না খায় তবে আমার নামই পাল্টায়ে ফেলবো, যান।

নাহিদা আশরাফীসপ্তাখানেক বাদে চাচা আমার মাথায় আশির্বাদের যে হাতটি রেখেছিলো আজও সেই হাত চোখ বুজলেই অনুভব করি।শুধু চা বিক্রির জন্যেই চাচার দুই ছেলেও এসে চাচার সাথে কাজে যোগ দিলো।
লাভ যে আমারো কিছু কম হয়েছিলো তা নয়। আশির্বাদের সেই হাতের সাথে সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ দিন পর্যন্ত একদিনও চাচাকে চায়ের দাম দিতে পারিনি।
ইদানীং ক্লান্তি ভর করে। এই দৃঢ়চেতা স্বাবলম্বী ভদ্রমহিলার মধ্যেও কি এক সুপ্ততাপ ইচ্ছের ফুলকি জ্বালাতে চায়।আহা কেউ যদি এককাপ চা বানিয়ে সামনে দিতো। পরক্ষনেই ভাবি, চায়ের ব্যাপারে আমার নাক তো হিমালয় স্পর্শ করেছে। অন্যের বানানো চা আমার মুখে রুচবে তো?
সেদিন নিজের রুমে লো ভলিউমে রবিবাবুকে শুনছিলাম—
‘দিবস-রজনী আমি যেন কার আশায় আশায় থাকি…
আমায় চমকে দিয়ে কন্যারত্নটি এককাপ চা সামনে এনে দিলো। আমি স্মিত হেসে মুখে দিতেই চমকে উঠলাম। এ তো আমারই বানানো চা। আহা! এত সুখ কোথায় লুকিয়ে ছিলো।

কন্ঠ তার হেরেস্বরে না চাইতেও গেয়ে উঠলো,

‘চক্ষে আমার তৃষ্ণা
ওগো তৃষ্ণা আমার বক্ষ জুড়ে
আমি বৃষ্টিবিহীন বৈশাখী দিন
সন্তাপে প্রান যায় যে পুড়ে…

পছন্দের আরো পোস্ট