পড়াশোনার ভারে কতটা মানসিক চাপে শিশুরা

“আম্মু বলে পড় রে সোনা   আব্বু বলে মন দে

 পাঠে আমার মন বসে না    কাঠাল চাপার গন্ধে”

এটা কবির কবিতা – যাতে শিশুর মনের আকুতি ব্যক্ত করা হয়েছে। কিন্তু মা-বাবা? তারা কি চান?  তাদের চাওয়া পাওয়ার ভাষাটা সন্তানের পড়াশোনার বেলায় একেবারে ভিন্ন। পাখি ডাকা স্নিগ্ধ ভোরে বাচ্চাকে টেনে তোলা হয় ঘুম থেকে। ঘুম চোখে ইচ্ছার বিরুদ্ধে  । তাকে তৈরি করা হয় স্কুলের জন্য। অনুপোযোগী বয়সে বাচ্চাকে দেওয়া হয় স্কুলে। স্কুলে পরিক্ষাকেন্দ্রিক পড়াশোনার কারণে শিশুকে পরীক্ষার যুদ্ধে অবর্তীণ হতে হয়।এখানেও বাবা-মার প্রত্যাশা ১ম স্থান,এ প্লাস। একটা নম্বরও কম পাওয়া যাবে না।স্কুলের পাশাপাশি  শিশুকে ভালো নামকরা স্কুলে ভর্তি করানোর জন্য তাকে ভর্তিযুদ্ধের জন্য তৈরি করা হয়।

স্কুল, কোচিং, ধর্মীয় শিক্ষা,আর্ট ক্লাস, বাড়ির কাজ,হাতের লেখা তার উপড় গাদাগাদা বইয়ের বোঝা তো আছেই। এ যেন রীতিমত এক মানসিক  নির্যাতন। একটা শিশুকে কতটা মানসিক  চাপ আমরা না বুঝে দিচ্ছি। এটা বইবার ক্ষমতা তার আছে কি?  অনেক সময় দেখা যায় শিশুকে রিক্সায়, বাসে,গাড়ীতে পড়ানো হচ্ছে।পরীক্ষায় যাতে একটি  নম্বরও কাটা না যায়। পরীক্ষা শেষে গেট থেকেই আবারও প্রশ্ন। কেমন হয়েছে?  কয়টা  ভুল হল?  যদি ভুল হয়েই থাকে তবে তো কাজ সারা। সকলের সামনেই বাচ্চাকে গালমন্দ শুরু  করা হয়। যার ফলে শিশুর মধ্যে একধরণের হীনমন্যতা কাজ করে। মোটকথা বাংলাদেশের মা-বাবারা পরীক্ষাকেন্দ্রিক পড়াশোনার কারণে নিজেদের  বাচ্চাকে রোবটের আদলে গড়তে চান। তারা বাচ্চার মধ্যে পড়াশোনার কমান্ড  সেট করে দিবে আর সে শুধু অভিবাবদের ইচ্ছেমত পড়বে।

Post MIddle

পি.এস.সি,জে.এস.সি সবগুলোতে গোল্ডেন এ প্লাস  থাকতে হবে। মা-বাবার আকাশচুম্বী প্রত্যাশা শিশুর মধ্যে প্রচন্ড মানসিক  চাপের সৃষ্টি করে। এর ফলাফল হয় ভয়াবহ। এই অসম প্রতিযোগিতার কারণে নষ্ট হয় অর্থ, শ্রম। সবচেয়ে বেশি  ক্ষতি হয় আমাদের প্রিয় সন্তানের। তারা মানসিক চাপের ফলে একরোখা আচরণ করতে থাকে।  তাদের মধ্যে রাগ ও জেদ তৈরি হয়। তারা মিথ্যা বলতে শুরু  করে,খাবার খেতে চায় না, অনেক কিছু গোপন করে,মা-বাবাকে এড়িয়ে চলতে চায়। সুন্দর পৃথিবী  তার কাছে বিষাদময় মনে হয়। এক সময় তারা বিভিন্ন অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। সবসময় হীনমন্যতায় ভোগে। অনেক সময় তারা সামান্য কারণে মরে যাওয়ার ইচ্ছা পোষণ করে থাকে।

পড়াশোনার কারণে ১১ বছরের নেহার নাচ বন্ধ করে দিয়েছিলেন তার মা। এই চাপ সহ্য করতে পারেনি ছোট মেয়েটি।তাই সে গলায় ওড়না পেঁচিয়ে  আত্মহত্যা করে।তেমনি আরেক শিশু সুশান্ত পাতিল অনেক চেষ্টা করেও মা-বাবার প্রত্যাশা অনুযায়ী ফলাফল করতে পারেনি। প্রচন্ড মানসিক চাপে শিশুটি স্কুলের বাথরুমে রশি পেঁচিয়ে  আত্মহত্যা  করে।কয়েকবছর আগে চিত্রনায়ক ওয়াসিমের একমাত্র মেয়ে স্কুলের ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করে। এই রকম আরও বহু যটনা আছে।আবার এমনও দেখা যায় ফলাফল বাবা-মার মনের মত করতে না পেরে বাচ্চা খাওয়া বন্ধ করে দেয়। ডাক্তারি পরীক্ষায় কোন রোগ ধরা পরে না। অতিরিক্ত চাপের কারণে ছেলেমেয়েরা ১১/১২ বছর বয়সেই ধূমপানে করতে শুরু করে। এছাড়াও বিভিন্ন  নেশা যেমন মদ, এ্যালকোহল,ড্রাগ  ইত্যাদিতে আসক্ত হয়ে পড়ে।

বাংলাদেশের শিশুরা বেশি চাপে থাকে। দেখা শিশুর পড়া ঠিকমত না হলে তাদের শারীরিক শাস্তি দেওয়া হয়। অনেক সময় দেখা যায় বাথরুমে আটকিয়ে রাখা হয়।এছাড়া বিভিন্ন  পাবলিক পরীক্ষা, স্কুল পরীক্ষা, সি.টি পরীক্ষা, এম.টি পরীক্ষার চাপ তো আছেই। পাশাপাশি দেখা যায় জাপানে ৫ম শ্রেণী পর্যন্ত কোন পরীক্ষাই নাই। পৃথিবীর সেরা শিক্ষা প্রণালীর খেতাব পেয়েছে ফিনল্যান্ডের শিক্ষা ব্যবস্থা। সেখানে শিক্ষার ব্যাপারে সরকারের অহেতুক নজরদারী নেই।ঘন ঘন পাবলিক পরীক্ষা নেই। মা-বাবা বাচ্চাকে শিক্ষকদের কাছে দিয়ে নিশ্চত থাকেন।সেখানে ঝরে পড়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১%এর কম। আসলে একটি শিশুর কাছে অতিরিক্ত প্রত্যাশা না করে তাকে তার সামর্থ্য অনুযায়ী করতে দিন।স্কুল গুলোতে একজন করে কাউন্সেলর থাকলে ভাল হয়। শিশুরা চাইলে সপ্তাহে যেন একবার তাদের সাথে তাদের চাওয়া-পাওয়ার কথা শেয়ার করতে পারে। এতে করে তারা অনেকটা চাপ মুক্ত হতে পারবে।

শিশুরা যদি চাপমুক্ত হয়ে নিজের সেরাটা অর্জন করতে পারে তবেই সে একদিন মানবিক মূল্যবোধ সম্পন্ন মানুষ হিসাবে গড়ে উঠবে।শিশুকে তার সফলতা ও ব্যার্থতা সহ নিঃসার্থ ভালবাসুন। সফলতার অনেক পথ আছে।শিশুর সুন্দর, নির্মল নীল আকাশটাকে কালোমেঘে ঢেকে দিবেন না শুধুমাত্র পড়ালেখা নামক ৪টি অক্ষরের জন্য।

লেখক:শাহানাজ ইসলাম মুক্তা।অধ্যক্ষ, উত্তরা আইডিয়াল কলেজ

পছন্দের আরো পোস্ট