নিতুর ঈদ পরিকল্পনা

সেলাই মেশিনের গরগর আওয়াজ, ব্যস্তসমস্ত রাজপথ, ব্যস্ত বস্ত্র ব্যবসায়ীরা,সেমাই-চিনির দোকানে কম ভিড় জমেনি।
ব্যাংকের বিভিন্ন শাখায় উপছে পড়া ভীড়।সরকারি -বেসরকারি চাকরিজীবী’রা এসেছে ঈদ বোনাস ও এই গত মাসের মাসিক বেতন তুলতে।
ব্যাংকের সামনে। একটি শিশু গিয়ে বললোঃ
-স্যার,কিছু টাকা দেন।
-এখন,নেই যা এখান থেকে।
ব্যর্থ হয়ে সেখান থেকে ফিরে এসে, অন্য আরেক জনের কাছে গিয়ে
হাত বাড়িয়ে বলে,”স্যার,কিছু টাকা দেন।”
-এই নে।
হাতের মুঠো খুলে দেখে দুই টাকার একটা নোট।
যত্রতত্র ঘুরে যা পায় তা দিয়ে ওর,একবেলা খেয়ে না খেয়ে দিনরাত
অনায়াসে পার হয়ে যায় কীভাবে সে নিজেই চিন্তাপর হয়ে ভাবে।কথায় আছে না!,”যার কেউ নেই তার আছে সৃষ্টিকর্তা”।
আসলে কথাটি একশত ভাগে একশত ভাগ সত্যি।
ওর নাম নিতু।বয়স ১০-১২ বছর হবে।গাঁয়ের রং শ্যামলা,লম্বায় হনে ৩.৮ ইঞ্চি। পড়নে যত্রতত্র ছেঁড়া জামা।বাপ মরা মেয়ে। বাবা মারা গেছে মায়ের অন্তগর্ভে থাকা অবস্থায়,ওর বয়স তখন আট মাস।
আর একটু পরে যদি বাপটা  মারা যেতো  তাহলেই তার সাথে একবারের জন্য হলেও স্বাগতিক সাক্ষাতকারটা হতো।
কপালে লিখন খন্ডানোর ক্ষমতা কারো নেই।ভাগ্যের পরিহাস মেনে নিতেই হবে।
বাপ মরা মেয়ে। নিতু আর ও মা জরিনা বেগম মিলে সংসার।
স্বামী’র মৃত্যুর পর দ্বিতীয় স্বামীর কথা চিন্তা করেনি শুধু নিতুর কথা ভেবে, যদি দ্বিতীয় স্বামী নিতুকে না দেখে তাহলে বাপ মরা মেয়েটার দেখ ভাল কে করবে?ছেলে হলেও না হয় হতো।
জরিনা, এ বাড়ি ও বাড়ি কাজ করে। নিতু ছুটে অপরিচিত লোকের পিছনে শুধু কিছু পাওয়ার আশায়।
ওর, মা সুস্থ থাকাতে কোন কিছুর অভাব বুঝতে দিতো না।
এখন কারো বাড়িতে কাজে যায় না,যাবে কি করে গত তিন মাস ধরে বিছায় শুয়ে আছে অর্ধ মৃত লোকের মত।
মায়ের চিকিৎসার খরচ, ঘরের অন্নজল জোগান দিতে হয় নিতুকে।
এসব কিছুর জন্য ভিক্ষার পথ খুঁজে নিয়েছে,আর এছাড়া কোন উপায় নাই।মেয়ে মানুষ কেউ কাজ দিতে চায় না।আর যারা
কাজ দেয়  অমানুষগুলো তার দিকে লোভনীয় দৃষ্টিতে তাকায়।
তাই সে আজ নিরুপায় হয়ে বেছে নিয়েছে ভিক্ষার চাকরি।
ভিক্ষা করা তার চাকরি বলা যেতে পারে,নিত্য নতুন কাজ করতে হয় তাকে,আর তাছাড়া কোন উপায় নাই।হয়তো আর একটু বড় হলে তার   পেশাটা পাল্টে যাবে তখন সে নিজের পায়ে দাঁড়াতে শিখবে।অন্যের কাছে আর হাত পেতে চলতে হবে না।মা, অসুস্থ বিছানায় পড়ে ভালো চিকিৎসা দিতে পারছে না,আর দিবে বা কি করে ডাক্তারের কাছে গেলে বলে এর জন্য অনেক টাকা খরচ হবে।
টাকার অভাবে অনেক সময় ঔষধ খাওয়া বন্ধ থাকে। গ্রামের কবিরাজের ঔষধ দিয়ে দিনরাত পার করতে হয় অসুখের সাথে যুদ্ধ করে।দিন দিন এ যুদ্ধে হেরে যাচ্ছে নিতু।হয়তো বেশি দিন নেই, তার যে টুকু আছে হয়তো সে টুকু হারাতে বসেছে সে।
তার না খেয়ে থাকা, রোজা থাকা শামিল।আর কয়েক দিন পর ঈদ।
সকলে নতুন নতুন জামা কিনতেছে।
শুধু নিতু, দূর থেকে শুধু লোভনীয় দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।তার নিজের কাপড়ের দিকে তাকায় দেখে, অনেক কয়েক জায়গায় ছিড়া।আর মায়ের গায়ে পরা শাড়িটা চলছে প্রায় ৩বছর থেকে।
অশ্রু সিক্ত তার চোখ।কোন দিন তার চোখ অশ্রু সিক্ত দেখা মেলেনি।হঠাৎ আজ যেনো তার জীবনে জমে থাকা কালো  মেঘগুলো ভাড়ী হয়ে গেছে, তাই আর ধরে রাখতে না পেরে ছেড়ে দিয়েছে,অশ্রু ধারা।
সে ভাবে, মাকে যদি একটা শাড়ি কিনে দিতে পাড়তুম, তাহলে মা অনেক  খুশি হতো।মায়ের মুখে একটুখানি হাসির ঝলক দেখতে পেতাম।শুনেছি বাপজান মারা যাবার পর থেকে মা মোর হাসে নাই।
Post MIddle
আমার জামা না হলেও হবে,কিন্তু মার জন্য একটা শাড়ি কিনতেই হবে!
-কি করি!
শাড়ি কিনতেতো অনকে টাকা লাগবে! কম করে হলেও দুইশত থেকে আড়াইশত টাকা।
বাড়িতে তো কোন কানাকড়ি জমাতে পারি না।
যাই হোক ঈদ বাকী এই কটা রাতদিন ভিক্ষা করবো।এ থেকে খেয়ে দেয়ে যা থাকে, কষ্ট করে জমিয়ে মাকে একটা শাড়ি কিনে দিতেই হবে।আমার এই ছিঁড়া জামা দিয়ে কিছু যায় আসে না কারণ আমি ভিক্ষা করি।
এদের আগের দিন, নিতু দেখে যে তিনশত টাকা জমা হয়ে গেছে।
সে রাতে বাজারে যায়।রাস্তার পাশের দোকান থেকে নিজের পছন্দমত একটা শাড়ি কেনে সাথে আধা কেজি চিনি-আর এক কেজি সেমাই কিনে সে বাড়ি ফেরে।
-মা!মা!ম!
নিতু,আনন্দে আত্নহারা। কে দেখে তার আনন্দ।
-কিরে নিতু!কি হইছে তোকে আজ এত খুশি খুশি লাগতেছে।
-মা! তোমার জন্য একটা জিনিস আনছি।
-কি আনছোস মা!
-তোমার লগে আমি একটা শাড়ি আনছি।
-এত টাকা তুই কোনে পালি মা।
-ভিক্ষার টাকা জমায়ছিলাম।বাদ দাও ওসব কথা।
এই যে মা এটা তোমার জন্য।
মা!শাড়ি তোমার পছন্দ হয় নাই।
মায়ের চোখ বেয়ে বেয়ে অশ্রু ঝরে।
তোর বাপ এই রকম ঈদের আগের দিন একটা শাড়ি আনি দিছিলো।তোর বাপের কথা মনে পড়তাছে মা।
 আনন্দে কানতাছিরে মা।
হ, খুব পছন্দ হয়ে।
তোর জন্য কি নিছোস।
এই যে মা, চিনি আর সেমাই।
এগুলা তোমার আর আমার জন্য। তুমিশুয়ে থাকো মা,আর শুনো আমার জন্য কিছু চিন্তা করো না।আমার ছেঁড়া জামা পড়ে ঘুরতে কোন অসুবিধে হয় না।
আমি রাতে খাবার তৈরি করি।
আর কাল সকালে, মানে ঈদের দিন। আমরা দুজনে মিলে সেমাই খামু।আর আমি পাড়ায় পাড়ায় টই টই করে ঘুরমু।
অনেক মজা হবে কাল, খুব মজা হবে।
আর কাল তুমি এই শাড়ি পড়বে কিন্তু বলে দিলাম
-ঠিক। আছে রে।
আমি কাল এই শাড়িটা পড়বো।
-আয়!শুয়ে শুয়ে গল্প করি। জীবন শকটের বিভ্রান্তিজনক যাত্রাভিনয়ের গল্প।
শাফিউল কায়েস
বিভাগঃপরিবেশ বিজ্ঞান ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, গোপালগঞ্জ।
পছন্দের আরো পোস্ট