একুশ আমার চেতনায়

একুশ নিয়েই কথা। শিকড় থেকে বিচ্ছিন্ন হলে কারও আর কোনো পরিচয় থাকে না।একুশ আমাদের এই কথাটিই স্মরণ করিয়ে দেয়। কোথায় বরকত কোথায় সালাম,সারা বাংলা কাঁদিয়া মরে, যে রক্তের বানে ইতিহাস হলো লাল,যে মৃত্যুর গানে জীবন জাগে বিশাল,সে জাগে ঘরে ঘরে…। অমর একুশে আজ। চেতনার পথে বাঙালিকে চলার প্রেরণা জোগানো একুশ দ্বিধাহীন অভিযাত্রী বেশে । দিন আজ বেদনা আর আত্মত্যাগের অহংকারে উদ্বেলিত হওয়ার । ভাষার আকর্ষণ আর বাঙালির নাড়ির টানে যে কতটা আবেগ ও প্রীতিময় হতে পাবে তারই প্রমাণ একুশে ফেব্রুয়ারি।

১৯৫২ সালের এই দিনে বাংলার প্রতিটি ঘরে বোনা হয়েছিল একুশের রক্তবীজ। বায়ান্নর সে বীজ থেকে আজকে আমার বাংলাদেশ। এই দেশে উর্দু নয়, বরং বাংলা এবং বাংলাই হয়েছে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। প্রতিটি বাঙালির মতো পৃথিবীর তাবৎ মাতৃভাষাপ্রেমীরও নতুন চেতনায় শাণিত হওয়ার দিন আজ। কেননা একই সঙ্গে আজ ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসও’।

আজ বাংলাদেশের পাশাপাশি ইউনেস্কোর ১৯৫টি সদস্য এবং ৯টি সহযোগী সদস্য রাষ্ট্রের ৬ হাজার ৯০৯টি ভাষার মানুষ পালন করবে এই দিবস।

প্রতিবারের মতো এবারও যথাযথ মর্যাদায় ভাবগাম্ভীর্যের সঙ্গে পালিত হবে মহান শহীদ দিবস। সর্বত্র সকলের কণ্ঠে আজ একই শোকসঙ্গীত- আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি,আমি কি ভুলিতে পারি…। মায়ের মুখের সেই বুলি আর ভালবাসা আক্রান্ত যখন, তীব্র প্রতিবাদ গড়ে তুলেছিল বাঙালী।

১৯৫২ সালের এই দিনে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে রাজপথে নেমে এসেছিল বাংলা মায়ের বিক্ষুব্ধ সন্তানরা। রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে মুখর ছাত্রদের রুখে দিতে নির্বিচারে গুলি চালিয়েছিল পুলিশ। বরকত সালাম রফিক শফিক জব্বারসহ নাম না জানা আরও অনেক শহীদের রক্তে শৃঙ্খলমুক্ত হয়েছিল দুখিনী বর্ণমালা।

একুশ আমাদের বাঁচতে শেখায়, লড়াই করে অধিকার আদায় করতে শেখায়। একুশ বাঙালি জাতির গর্ব ও অহংকার। বাঙালির স্বাধিকার সংগ্রামের প্রতিটি অধ্যায়েই জড়িয়ে রয়েছে একুশের প্রেরণা। একুশের চেতনায় শাণিত হয়ে দানা বাঁধে স্বাধীনতা সংগ্রাম। একাত্তরে রক্তক্ষয়ী মুক্তি সংগ্রামে অর্জিত হয় কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা। এই একুশে জাতির জীবনে অবিনাশী এক মহা-উদযাপনের নাম। ধর্ম-বর্ণ-গোত্র-দল-মত নির্বিশেষে উদযাপন করার মতো এমন কালজয়ী দিন দ্বিতীয়টি নেই। যে কারণে অমর একুশে উদযাপন নিয়ে বাঙালির আবেগ হয়ে ওঠে বাঁধনহারা।

সমাজের সকল অন্যায় অসাম্য ধর্মান্ধতা সাম্প্রয়িকতার বিরুদ্ধে জ্বলে ওঠার নতুন শপথ নেবে বাঙালী। গীতিকবির ভাষায়- স্বাধীন এই বাংলা আমার, কোটি প্রাণ শহীদ মিনার,নেবই নেব, নেবই নেব,নেবই নেব আমরা মনের মতো এই দেশ গড়ে…।

Post MIddle

অমর একুশেইতিহাস বলে, ১৯৪৭ সালে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ভারতবর্ষ বিভক্ত হয়। জন্ম নেয় পৃথক দুই রাষ্ট্র ভারত ও পাকিস্তান। পাকিস্তানের দুই অংশ পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান। সংখ্যাগরিষ্ঠ পূর্বাঞ্চলের মানুষ বাঙালী। মাতৃভাষা বাংলা। অপরদিকে পশ্চিমাঞ্চলে প্রচলিত ছিল সিন্ধী, বেলুচ, উর্দুসহ আরও কয়েকটি ভাষা।

এ অবস্থায় পাকিস্তানের ক্ষমতাসীন মুসলীম লীগ নেতৃত্ব সমগ্র পাকিস্তানের আনুমানিক পাঁচ শতাংশের ভাষা উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার চক্রান্ত শুরু করে। অথচ তারও অনেক আগে পূর্ব পাকিস্তানে ভাষাচেতনার উন্মেষ ঘটেছিল। মায়ের ভাষার প্রতি বাঙালীর অনুভূতি কত তীব্র ছিল তা জানিয়ে মধ্যযুগের কবি আবদুল হাকিম লিখেছিলেন-যে সব বঙ্গেতে জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী,সে সব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি…।

কিন্তু পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী এই অনুভূতি স্পর্শ করতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়। এ অঞ্চলের মানুষকে পেছনে ফেলে রাখার প্রাথমিক ষড়যন্ত্র হিসেবে ভাষার উপর আঘাত হানে। মায়ের ভাষা বাংলা মুখ থেকে কেড়ে নেয়ার ষড়যন্ত্র শুরু হয়। বাংলা ভাষাভাষী মানুষের সকল অনুভূতি তুচ্ছ করে উর্দুকে পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণা আসতে থাকে শীর্ষ মহল থেকে। এমন ষড়যন্ত্রে হতবাক হয়ে পড়ে বাংলার মানুষ। বাঙালীর সে সময়ের মনোজগত তুলে ধরে কবি শামসুর রাহমান লিখেছিলেন- মাগো, ওরা বলে, সবার কথা কেড়ে নেবে।তোমার কোলে শুয়ে,গল্প শুনতে দেবে না। বলো, মা,/তাই কি হয়?

এর পরও নিজেদের সিদ্ধান্তে স্থির থাকে পশ্চিম পাকিস্তানীরা। গণচেতনাকে স্তব্ধ করার ষড়যন্ত্র অব্যাহত রাখে। এ অবস্থায় বাঙালীর সামনে দুর্বার আন্দোলনের বিকল্প ছিল না। সবাই যেন একসঙ্গে গেয়ে উঠেছিলেন- সইমু না আর সইমু না অন্য কথা কইমু না,যায় যদি ভাই দিমু সাধের জান,এই জানের বদলে রাখুম রে,বাপ-দাদার জবানের মান…।

সাধের জান হাসিমুখে বিলিয়ে দিয়ে ভাষার মর্যাদা রক্ষা করেছিল বাঙালী। ১৯৪৮ সাল এবং ১৯৫২ সালের রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম তার প্রমাণ। বিশেষ করে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানীদের গোয়ার্তুমির চূড়ান্ত প্রকাশ ঘটে। এদিন রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবি রুখতে ১৪৪ ধারা জারি করে পুলিশ। কিন্তু সকল ভয় জয় করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা রাজপথে নেমে আসে। বাংলার দাবি চিরতরে স্তব্ধ করতে মিছিলে নির্বিচারে গুলি চালায় পুলিশ। মাটিতে লুটিয়ে পরে আবুল বরকত, আবদুল জব্বার ও আবদুস সালাম, শফিক, রফিকসহ নাম না জানা আরও অনেকে। গীতিকবির ভাষায়- রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন করিলিরে বাঙালী/তোরা ঢাকার শহর রক্তে ভাসাইলি…।

মায়ের ভাষার জন্য বিরল রক্তস্রোত। রাজপথ ভেসে গিয়েছিল তরুণ তাজা খুনে। ঘটনার প্রতিবাদে ক্ষুব্ধ ঢাকাবাসী ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হোস্টেলে সমবেত হন।

একুশ আজ বাঙালির নয় শুধু। এর নিজস্ব মহিমায় এখন দিনটি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। এর অর্থ বাংলা নয় কেবল পৃথিবীর তাবৎ ভাষা রক্ষারও একটি দায়িত্ব পড়ে যায় ভাষাপ্রেমিকের ওপর। একুশ মানে মাথা নত না করা। একুশ আমার চেতনায় ।

সাব্বির আহমেদসাব্বির আহমেদ স্বপ্ন

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।গণিত বিভাগ-৩য় বর্ষ।সাংবাদিক ও ফিচার লেখক

পছন্দের আরো পোস্ট