ভিটামিন ‘এফ’

১.

মোবাইলে দুই বন্ধুর কথা হচ্ছে।

প্রথম বন্ধু: জানিস, দু‘দিন হলো টুপুন নেটওয়ার্কের বাইরে। গুগলে সার্চ দিয়েও পেলাম না!

দ্বিতীয় বন্ধু: অারে মামা, তুমি তো এখনও অাপডেট হইতে পারলা না। ফেসবুকে সার্চ দাও, পাবা!

২.

সাড়ে পাঁচ বছরের দিব্য মাকে জিজ্ঞেস করল, মা তুমি কি এখন ফেসবুক দেখছ? ওর মা ট্যাবের ওপর থেকে চোখ না সরিয়ে হ্যাঁ বলতেই দিব্য বলল, একটু দেখি না। দিব্য ট্যাবটা মার কাছ থেকে টেনে নিয়ে পেজ স্ক্রল করে ছবি, স্ট্যাটাস দেখতে লাগল। একটা সুন্দর ছবি দেখিয়ে দিব্য বলল, মা এই ছবিতে একটা ‘লাইক‘ দিয়ে দাও!

৩.

পরিচিত এক ছোট ভাই মিজানের বাবা মারা গেলো গত ১০ ফ্রেব্রুয়ারি বিকেলে। মিজান তার বাবার মৃত্যু সংবাদ ফেসবুকে দিল। কেবল একজনকে মোবাইলে জানালো তার বাবার মৃত্যুর সংবাদটি।

এরপর, মিজান ব্যস্ত হয়ে পড়ে তার বাবার পরবর্তী সব কাজ শেষ করতে। বাবার মরদেহ গ্রামের বাড়িতে নিতে হবে। মিজানের অনেক কাজ।

বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে হয়ে যায় কেউ আসে না মিজানের পাশে। মিজান অবাক হয়। তার এতো এতো বন্ধু কেউ তার বাবাকে দেখতে এলো না!

রাতে মিজানের বাবার মরদেহ গাড়িতে তোলার আগে দু‘জন বন্ধুর দেখা পায় মিজান। বন্ধুদের দেখে মিজানের গলা ধরে আসে। সে কিছু বলতে পারে না। তার মনে পড়ে এদের একজনকে সে ফোন করেছিল।

মিজান তার বাবাকে শরিয়তপুরে দাফন করে, ধর্মীয় অাচার শেষ করে সপ্তাহ খানেক পরে ঢাকায় ফেরে। এক রাতে ফেসবুকে ঢুকে দেখে তার বাবার মৃত্যুর খবরের নিচে কত-শতজন স্ট্যাটাস দিয়েছে। কালো ব্যাজ, ফুলের ছবি দিয়ে ওয়াল ভরিয়ে ফেলেছে। এসব দেখে মিজানের কান্না আসে। কতজন তাদের মন্তব্যে লিখেছে, বন্ধুর বাবার জন্য আমাদের এই করা উচিত, ওই করা উচিত।

মিজান কেঁদেই ফেলে, দরকার নেই তার এসব বায়বীয় আবেগ। সেইদিন সে কাউকে পায়নি। অথচ ভার্চুয়াল মাধ্যেমে সবাই শোকাতুর!

মিজান বলল, ফেসবুকের কারণে আমরা অসামাজিক হয়ে পড়ছি! সামাজিক যোগাযোগের কথা বলা হলেও তা অামাদের বায়বীয় অর্থে সামাজিক করছে। আমি কোনো বন্ধুর সমস্যা হলে, কারোর বাবা মারা গেলে তাদের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছি। আর আমার বেলায় সবাই দায় সারল একটা স্ট্যাটাস দিয়ে!

ফেসবুক নিয়ে এমন হাজারও ঘটনা অাছে। ফেসবুকের কারণে আরব বসন্তের জন্ম হয়েছে, শাহবাগে গণজাগরণ সৃষ্টি হয়েছে। এমন শতেক উদাহরণ দেওয়া যাবে।

অাসলে প্রযুক্তি এমনই। কেউ এটাকে ভালো বলবে। কেউ বলবে মন্দ। যারা গ্রহণ করতে পারে না তারাই অাসলে বর্জনের পক্ষে অাওয়াজ তোলে, খারাপ বলে। তরুণরাই অাবার এই প্রযুক্তিকে কল্যাণকর কাজে ব্যবহার করে। কেউ কেউ অপব্যবহারও করে। তাতে করে কিন্তু প্রযুক্তির কোনও ক্ষতি হয় না। ক্ষতি হয় ব্যক্তির, সমাজের।

অনেক সময় প্রযুক্তি এবং মানুষের মেলবন্ধনকে ভারসাম্যহীন করে তোলে প্রযুক্তি। অবশ্য সেসব ঠিক করার জন্য রয়েছে অাইন এবং অাইন প্রয়োগকারী সংস্থা। ফলে যে যার মতো করে প্রযুক্তি ব্যবহার করবে।

তবে শিক্ষা হলো এই যে, অামাদের একটি মাধ্যমের ওপর নির্ভরতা কমাতে হবে। বিকল্প মাধ্যমের ওপরও অামাদের নির্ভর করতে হবে। মেইল, মোবাইলফোনকেও ফেসবুকের বিকল্প হিসেবে রাখতে হবে।

Post MIddle

অতি নির্ভরশীল হয়ে পড়লেই সমস্যা। এখন তো কোনও তথ্য বা ডকুমেন্ট কাউকে পাঠানোর জন্য মেইল ঠিকানা চাইলে বলে ফেসবুকে অ্যাটাচ করে দাও।

অাজকাল তো ডেটে গিয়ে, প্রথম দেখায় একে অন্যের সঙ্গে কথা না বলে অাগে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেয়, ‘আমরা ডেটে এসেছি।‘ ‘এই মাত্র অামাদের দেখা হলো।‘ একটু ক্ষণ পর পর এ ধরনের স্ট্যাটাস আপ হতেই থাকে।

এই যে এ ধরনের, এতো এ‌‌‌তো স্ট্যাটাস দেওয়া হচ্ছে, তা ক‘জন দেখতে আগ্রহী। অনেকে হয় তো বলবে, কেউ না কেউ তো দেখছে। তবে অনেকেই যে দেখতে চাইছে না বা বিরক্ত হচ্ছে সেটাও মাথায় রাখতে হবে।

চিকিৎসাশাস্ত্রে ভিটামিন ‘এফ‘ বলে কিছু নেই। তবে ফেসবুকের কল্যাণে এর উদ্ভাবন এরই মধ্যে বিশ্ববাসী জেনে ফেলেছে। অনেকে এখন ফেসবুককে আদর করে ‘ভিটামিন এফ‘ নামে ডাকছে।ভিটামিনের ঘাটতিতে যেমন বিভিন্ন ধরনের রোগ শোক হয়। তেমনকি অনেকে অাবার ফেসবুক ব্যবহার না করে বিভিন্ন ধরনের অসুখে ভুগছে। চিত্ত অস্থির হয়, মন কেমন কেমন করে, অতি চিন্তায় মাথা ব্যথাসহ বিভিন্ন ধরনের রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটছে। ভিটামিন ‘এফ‘ খেলে (ব্যবহার করলে) রোগ থেকে মুক্তিও পাওয়া যাচ্ছে।

পরিমিত ভিটামিন সেবন শরীর ভালো রাখলেও অতিরিক্ত ভিটামিনের ডোজ (বিশেষ করে একটি ভিটামিন) শরীর খারাপ করে দেয়। এখন ফেসবুকও নাকি সেই কাতারে জায়গা করে নিয়েছে। বিশেষ করে ছেলে-মেয়েদের অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বললে এমনটি মনে হয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী তাইশা তাশরিন মিমু ছোট বেলা থেকেই অসামাজিক তকমা নিয়েই বড় হয়েছে। আর এখন তো ফেসবুকের কল্যাণে রীতিমতো ‘এক ঘরে‘।

মানে সারাদিন ঘরে বসেই ট্যাবে ফেসবুক নিয়ে অাছে। পড়াশোনার বাইরেও যে একটা জগৎ আছে সেই জগৎ তার কাছে প্রায় অজানা-অচেনা। এই মাথা তোলা সময়ে সে মাথা নত করেই কাটিয়ে দিচ্ছে। বলে, এখন কারও সঙ্গে সরাসরি দেখা করা, সময় নিয়ে কথা বলা একটা ঝামেলার বিষয়। যানজটের কথা বলে ঘর থেকে সে বেরই হতে চায় না। তার মা উদ্বিগ্ন, হাতের ট্যাবটা কোনও ভাবে নিয়ে নিলে কী তার পরিবর্তন হবে?

অনেককেই বলতে শুনছি, ফেসবুক খুব খারাপ। নেশার মতো। অনেক সময় খেয়ে ফেলে। এই তাদেরইকে অাবার কিছুক্ষণ পরে ফেসবুকে লগ-ইন করেতে দেখা যাচ্ছে।

ফেসবুক প্রসঙ্গে প্রফেসর ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল রিখেছেন, আমি যে কোনও ফরম্যাটের সামাজিকতার পক্ষে। অামি ফেসবুকে হাই বলার চেয়ে বন্ধুর সঙ্গে হাত মেলাতে পছন্দ করি, হ্যান্ডশেক করে তাকে একটি ঝাঁকুনি দিয়ে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছা করে, কেমন অাছিস। তার কছ থেকে উষ্ণতা নিতেও ভালো লাগে। তিনি বলেন, ফেসবুক দরকার অাছে। তবে তা যেন বাড়াবাড়ির পর্যায়ে চলে না যায়। অতিরিক্ত কোনও কিছুই ভালো নয়।‘

বাংলাদেশ ওপেন সোর্স নেটওয়ার্কের (বিডিওএসএন) সাধারণ সম্পাদক মুনির হাসানের ভাষ্য, ‘ফেসবুককে একটি মাধ্যম হিসেবে দেখতে হবে। এটি অামাদের জীবন-যাপনের একটি অনুষঙ্গ। এটিকে জীবন-যাপনের ‘ টুল‘ বানিয়ে ফেললেই যত সমস্যা। কারণ অামি ফেসবুক নিয়ে থাকব, ফেসবুক অামাকে নিয়ে থাকবে না। টুল বানিয়ে ফেললে ফেসবুক অাপনাকে নিয়ন্ত্রণ করবে।

কথা সাহিত্যিক অানিসুল হক একবার লিখেছিলেন, “মা অসুস্থ। পাশের ঘরে শুয়ে অাছে। ছেলের দেখার সময় নেই। সময় নেই মায়ের পাশে গিয়ে বসার। কারণ সে ফেসবুকে ব্যস্ত। স্ট্যাটাস দিচ্ছে, ‘মাই মাদার ইজ ভেরি সিক, প্লিজ প্রে ফর হার‘।“

অামাদের এক বন্ধুর মা কিছুদিন অাগে মারা গেলেন। বন্ধু প্রবরটি তার মায়ের মৃত্যু সংবাদ ফেসবুকে দিতে বেশ তৎপর ছিল। ‘এইমাত্র মায়ের গোসল শেষ হলো‘, ‘অামি মায়ের খাটিয়া ধরলাম‘, ‘অামি মাকে কবরে নামালাম‘ এই জাতীয় স্ট্যাটাসে (ছবিসহ) ভরে উঠছিল বন্ধুটির ফেসবুক ওয়াল। মায়ের মৃত্যুর পরে কীভাবে সম্ভব একজন ছেলের পক্ষে ফেসবুকে সক্রিয় থাকা সম্ভব? ওই যে ভিটামিন!

একমাত্র তার মায়ের মৃত্যু সংবাদটি ছাড়া অার সব তথ্য কার কী কাজে লাগবে?

ফেসবুকের ১০ বছর!

২০০৪ সালে যাত্রা শুরু ফেসবুকের। দেশের ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের কাছে প্রিয় হতে খুব বেশি সময় লাগেনি ফেসবুকের। গত ৩১ মার্চ পর্যন্ত বাংলাদেশে ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৭০ লাখেরও বেশি। তবে এর মধ্যে এক তৃতীয়াংশরই বেশি ফেক বা নকল অাইডি।

ফেসবুক এখন সাইটের চেয়েও বেশি কিছু। বন্ধু তৈরি, হারিয়ে যাওয়া বন্ধুকে খুঁজে বের করা, প্রিয়জনের সঙ্গে সময় কাটানো, কেনাকাটা, বিজ্ঞাপন, ব্যবসা সব কিছু যেন ফেসবুককে ঘিরে।

বিখ্যাত, জনপ্রিয় ব্যক্তিত্বদের সহজেই খুঁজে পাওয়া যায় এখানে। সাধারণ মানুষের সঙ্গে দূরত্ব কমিয়ে নেওয়ার বড় সুযোগ ফেসবুক পেজ। সামাজিক ও ব্যক্তিগতভাবে অন্যায়, অত্যাচারের প্রতিবাদ, প্রতিরোধ গড়ে তুলতে দুঃশাসনের বিরুদ্ধে ফেসবুক তরুণ সমাজের কাছে দারুণ এক হাতিয়ার। এর সঠিক ব্যবহার গড়ে তুলতে পারে শান্তিময় ও সুস্থ রাজনৈতিক বিপ্লবের দেশ।

বিশ্বায়ন ও বিশ্বকে হাতের মুঠোয় নিতে ফেসবুকের চেয়ে ভারো কিছু নেই বলে সবার অভিমত। একটি স্ট্যাটাস, ছবি, ভিডিও সমাজ, রাষ্ট্রের অনেক কিছুর পরিবর্তন করে দিতে পারে। ব্যক্তি ও দেশের জন্য বড় নিয়ামক এই সামজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অপব্যবহার নয়, ইতিবাচক ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।

 

EH

পছন্দের আরো পোস্ট