পাগল প্রেমিক

বটগাছ জড়িয়ে ধরে কাঁদতে দেখেছেন কাউকে? আমি দেখেছি। নিদারুণ সে দৃশ্য। যেনো নিজের আত্মাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছিলো সে। অনুভব করতে চেষ্টা করেছিলাম তার কষ্টকে। পারিনি। দম বন্ধ হয়ে এসেছিলো। পরে শুনেছিলাম, লোকটা পাগল। প্রতি দিন বটগাছটাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদে সে। আর মনীষা মনীষা বলে চিৎকার করে।
ঘটনাটা ১৯৯২ সালের। তপ্ত রোদ। সূর্য যেনো মাথার কাছাকাছি চলে এসেছে। হাত বাড়ালেই ছোয়া যাবে। নদী মাঠ সব শুকিয়ে চৌচির। কোথাও পানি নেই। চারিদিকে শুধু বালি আর বালি। ধলেশ্বরী নদী যেনো সাহারা মরুভূমি।
মোতালেব তখন গঞ্জে যাচ্ছিলো। তার মায়ের অসুখটা বড্ড বাড় বেড়েছে। ওষুধেও কাজ হচ্ছে না। গঞ্জে থেকে ভালো ডাক্তার নিয়ে না ফিরতে পারলে হয়তো বাঁচানো যাবে না। নিজের থেকেও বেশি ভালোবাসে সে তার মাকে।
মোতালেবের মায়ের ছিলো এক কঠিন রোগ। কি রোগ ঠিক সেটা জানতো না। গরীবের এই এক সমস্যা। বড় রোগ হলে চিকিৎসা করানো সম্ভব নয় বলে গরীবেরা সে রোগ নির্ণয়ই করতে যায়না। জানা রোগ নিয়ে ঘুরলে নিজকে মৃত মানুষ মনে হয়। অথচ অজানা হাজারটা রোগ নিয়ে ঘুরলেও শরীর টলে না।
সবাই জানতো, যেকোনো সময় ওপারের ডাক পড়তে পারে মোতালেবের মায়ের। তবু এবার ছেলেকে মিনতি করে বলেছিলো, আর কয়েকটা দিন বাঁচতে চাইরে মোতালেব। এই কথাটা শুনেই আর নিজেকে স্থির রাখতে পারছিলো না সে। দিলো দৌড়। গঞ্জে থেকে ভালো ডাক্তার নিয়ে যদি অল্প কয়েকদিন বাঁচানো সম্ভব হয় তাও শান্তি পাবে সে। না হলে মায়ের এই আকুতি তাকে কুড়েকুড়ে খাবে আজীবন।
খুব জোড়ে দৌড়াচ্ছিলো সে। তার সাথে পাল্লা দিয়ে রোদের তীব্রতাও যেনো বাড়ছিলো। কয়েক মাইল যেতেই হাপিয়ে উঠলো মোতালেব। ধলেশ্বরীর এই অনিকেত প্রান্তর পাড়ি দিয়ে আর ২ মাইল দুরেই গঞ্জ। কিন্তু ধলেশ্বরীর এই প্রান্তর যেনো পথের কাটা হয়ে দাড়ালো। তপ্ত বালি আর মাথার উপর আগুনের উনুনে তৃষ্ণায় ব্যাকুল হয়ে পড়তে লাগলো।
পা দুটো অবশ হয়ে গেছে। আর এক পা এগুতে পারবে না সে। অথচ মায়ের জন্য ডাক্তার নিয়ে যেতেই হবে। মাথাটাও যেনো গুলিয়ে যাচ্ছিলো আস্তে আস্তে।
হঠাৎ মোতালেব আবিষ্কার করলো, সে শুয়ে আছে। চারপাশে ছনের দেয়াল। শক্ত বিছানা আর শক্ত বালিশ। চোখ খুলতে ভয় করছিলো তার। হঠাৎ চোখ খুলতেই একটি মেয়েলি কণ্ঠস্বর ভেসে এলো- ‘আমরা তো ভয়ই পেয়ে গেছিলাম। আপনি কোথা থেকে এসেছেন? কোথায় যাচ্ছিলেন?’ অনেকগুলো প্রশ্নের ভিড়ে কোন প্রশ্নের উত্তর আগে দেয়া উচিত ভেবে পাচ্ছিলো না মোতালেব। হঠাৎ তার মনে হলো বাসায় অসুস্থ মা। ডাক্তার নিয়ে যাওয়ার কথা। বিছানা থেকে লাফিয়ে উঠলো মোতালেব। তা দেখে অনেকটা হতভম্ব হয়ে গেলো মেয়েটি।
আমার মা অসুস্থ। ডাক্তার নিয়ে যেতে হবে। বলেই দ্রুত হাটা শুরু করে দিলো মোতালেব। ডাক্তার নিয়ে বাড়ি পৌছাতে পৌছাতে গিয়ে দেখলো কবর খোড়া হচ্ছে। বাড়ির পেছনের বাশঝাড় থেকে বাশ কাটা হচ্ছে। নিমপাতার পানি গরম করা হচ্ছে। চোখের জলে বিদায় দিতে হলো মাকে। মায়ের শেষ ইচ্ছে পূরণ করা হলোনা তার।
মায়ের বিদায়ে অনেকটা ভেঙে পড়েছিলো মোতালেব। মাস দুই পরে শোকের রেশটা অনেক খানি কমে গেছে। এখন নিজের জন্য কিছু করা উচিত।
হঠাৎ মনে পড়লো সেই বটগাছটার কথা। যার নিচে ছায়া খুজতে গিয়ে নিজেকে আবিষ্কার করেছিলো এক কুঁড়েঘরে। যে ঘরকে আলোকিত করেছিলো এক চন্দ্রমুখী। কি সুন্দর দেখতে। যৌবনের উচ্ছল ঢেউ খেলা করছিলো তার সর্বাঙ্গে। হরিণীর মতো চোখ, লাজুক আর ভয়ার্ত সে চাহনী। যেনো একটা বাঘের সামনে অসহায় হরিণী বসে আছে।
আচ্ছা, মেয়েটি কি ও ঘরে একাই থাকে? আর কাউকে তো দেখতে পেলাম না সেদিন। অত বড় একটা নির্জন প্রান্তরে একা একটা ঘর। ঘরটাও কেমন নিঃসঙ্গ। পাশাপাশি আর একটা ঘর থাকলে মন্দ হতো না। অন্তত আড্ডা দিয়ে কাটিয়ে দিতে পারতো। কিন্তু চন্দ্রমুখীদের ঘরটা একাই। তার কোনো সঙ্গী নাই। এই যা, মেয়েটির নামই জিঙ্গেস করা হয়নি সেদিন। কিভাবে করা হবে? মায়ের মৃত্যুবস্তায় ওসব খেয়াল থাকে না কি? এতদিন হয়ে গেলো, মেয়েটার একটা খোঁজ নেয়া দরকার। সেদিন হয়তো মেয়েটিই তাকে বাঁচিয়েছে, সেবা করেছে। অমন হাতের ছোয়ায় জীবন ফিরে পেয়েছে মোতালেব।
সারাদিনের কাজ গুছিয়ে বিকেলে রওনা হলো মোতালেব। গন্তব্য চন্দ্রমুখীর ছোট্ট কুঠির। এখন আর সেই রোদ নেই, তপ্ত উনুন নেই। নদীতে জোয়ার লাগতে শুরু করেছে। নতুন পানিতে পা ভিজাতে খুব ভালো লাগছিলো মোতালেবের। মায়ের মৃত্যুর পর অনেকদিন এমন প্রান খুলে হাটা হয়নি। আজ সে অনেক খুশি। চারদিকে যে আনন্দের পসরা সাজানো তা যেনো মোতালেবের জন্যই করা।
ছনের ঘর হলেও ওদের দরজাটা ছনের নয়। কাঠের। তাতে দুইবার আঘাত করতেই বেরিয়ে এলো চন্দ্রমুখী। যদিও বাতাস ছিলোনা কিন্তু ভেতর থেকে যেনো দমকা বাতাস এসে মোতালেবকে এলোমেলো করে দিয়ে গেলো। আজ অনেক সুন্দর করে সেজেছে চন্দ্রমুখী। চুলে চিপচিপে তেল, পাখির বাসার মতো সুন্দর একটা খোপা, বামকানে একটি কলমি ফুল গোজা। কার জন্য এ সাজ? মনে মনে প্রশ্ন করে মোতালেব। কিন্তু এ প্রশ্ন করা উচিত হবে না।
‘আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।’
‘কেনো?
‘সেদিন আপনি যদি আমাকে না বাঁচাতেন হয়তো এই পৃথিবীর আলো বাতাস আর দেখাই হতো না।’
‘ওভাবে বলবেন না, বাঁচা মরা সব আল্লাহর হাতে। সেদিন যেমন করে চলে গেলেন!’
‘মায়ের জন্য ডাক্তার আনতে গিয়েছিলাম। তাই কিছু বলে যেতেও মনে ছিলোনা।’
‘আপনার মা এখন কেমন আছেন?’
‘মা মারা গেছেন।’
কথাটা বলতে আর শুনতেই দুজনে যেনো এক চাপা কষ্ট অনুভব করলো।
‘আপনি কি কোথাও বের হচ্ছিলেন? অনেক সেজেছেন দেখছি।’
‘না, আমি এমনিতেই সাজি। তাছাড়া এখানে দেখার কেউ নেই। এত বড় এক নির্জন প্রান্তরে আর কোনো ঘর নেই। নিজের মন যা চায় তাই করি। সাজতে আমার খুব ভালো লাগে।’
Post MIddle
‘আপনারা কে কে থাকেন এখানে? সেদিন আপনাকে ছাড়া আর কাউকে দেখতে পেলাম না।’
‘আমি আর আমার বাবা। বাবা সারাদিন কাজ করে রাতে বাড়ি ফিরে। তারপর উনুুন জ্বলে। আপনি কিছু মনে করবেন না,আমাদের দুর্দশার কথা শুধু শুধু আপনাকে বলতে গেলাম।’
‘না না কি মনে করবো?
‘এই যা, বাড়িতে অতিথি আসলো অথচ কোনো যত্নই করতে পারছি না।’
‘কিছুই করতে হবে না আমার জন্য। এক গ্লাস পানি দিলেই অনেক খুশি হবো।’
চন্দ্রমুখী পানি আনতে ভেতরে গেলো। যেনো কোনো স্বর্গের অপ্সরী হেটে যাচ্ছে। রক্ত মাংসের অপ্সরী। এই নির্জন বাড়িতে একা এক সুন্দরী অপ্সরী কেমন করে থাকে? বিধাতা বোধ হয় কিছু সৌন্দর্য গোবরে রেখে মজা পান। এমন সুন্দরী মোতালেব জীবনেও দেখেনি। এমনকি কল্পনাতেও না। সৃষ্টিকর্তা এত সুন্দর করে মানুষ সৃষ্টি করতে পারেন তা চন্দ্রমুখীকে না দেখলে বোঝা যায় না। এই যা, মেয়েটির নামই জিজ্ঞেস করা হয়নি। অমন সুন্দর মেয়ের নাম না থাকলেও চলবে। অপ্সরীদের নামের দরকার হয়না। অপ্সরীদের দেখলে চোখ এমন ব্যস্ত হয়ে যায় যেনো বাকি ইন্দ্রিয়গুলো অকেজো হয়ে পড়ে।
‘এই নিন পানি।’
সম্ভিত ফিরে পেলো মোতালেব।
‘আচ্ছা, আপনার নামটাই জানা হলো না।’
‘আমার নাম মনীষা।’
বাহ, কি সুন্দর নাম। যেমন রুপ তেমন নাম। সোনায় সোহাগা।
‘আপনি যেমন সুন্দর, আপনার নামটাও তেমনি সুন্দর।’
‘থাক, আমার লজ্জা লাগে।’
মনীষার দিকে এক নজর তাকাতেই থমকে গেলো মোতালেব। সত্যিই লজ্জা পেয়েছে মেয়েটি। মুখটা কেমন রক্তবর্ণ ধারণ করেছে। যেনো পানি পেয়ে কিসমিস টসটস করছে। সত্যিকারের অপ্সরীরা লজ্জা পেলেও বুঝি এমন লাগে।
‘আমি আজ উঠছি। একটা দরকারে গঞ্জে যেতে হবে।’
‘আচ্ছা, আবার আসবেন সময় পেলে।
কথা বাড়াতে পারছিলো না মোতালেব। অমন অপ্সরীর সাথে এক বসায় তিন জনম কাটিয়ে দেয়া সম্ভব। কিন্তু কোনো কথাই খুঁজে পাচ্ছিলো না সে। অগত্যা বিদায় নিতেই হলো।
মনের ভেতর হাজার প্রশ্ন ঘুরপাক খেতে লাগলো মোতালেবের মাথায়। অমন নির্জনে এক সুমিষ্ট গোলাপ ফুটে আছে। তার খোঁজ কি কোনো ভ্রমর পায়নি? পেলে কি মধু খেয়ে উড়াল দেবে না? ফুল ছিড়ে ফেলে পায়ে পিসে চলে যাবে না। আচ্ছা, ফুলটা কি পারবে, দুষ্ট ভ্রমরদের হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করতে? পারবে তো? যদি না পারে? কি হবে তাতে? এত সুন্দর ফুল। বখাটে কিছু ভ্রমর এসে নোংরা করে দিয়ে যাবে তা হতে পারে না।
আচ্ছা, এত সব ভাবছে কেনো মোতালেব। একটা ফুল ঝড়ে গেলে, নষ্ট হলে তার কি আসে যায়? হ্যা, কিছু তো অবশ্যই যায় আসে। তবে কি মোতালেব মনীষাকে ভালোবাসে?
হ্যা, মোতালেব মনীষাকে ভালোবেসে ফেলেছে। অনেক বেশি ভালোবেসে ফেলেছে। মনীষা শুধুই তার। কোনো দুষ্টু ভ্রমর নির্জনতা, আর অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে তাকে নোংরা করতে পারবে না। কিছুতেই না। আজই সে মনীষার কাছে যাবে। মনীষার বাবাকে বলবে, তার হৃদয়ের কথা। তিনি নিশ্চয় না করতে পারবেন না।
কিন্তু দিনের বেলা গেলে তো মনীষার বাবাকে পাওয়া যাবে না। তাই সন্ধ্যার দিকেই রওনা দিলো মোতালেব। মাঝ রাস্তায় হঠাৎ একটা কুকুর এসে ঘেউ ঘেউ করতে লাগলো। পথের লাঠি কুড়িয়ে কুকুরটাকে বিদায় করে আবার হাটতে লাগলো সে। তখন আনুমানিক রাত আটটা বাজে। মোতালেব যতই মনীষাদের বাড়ির কাছে পৌছাচ্ছিলো ততোই যেনো স্বর্গের নাগাল পাচ্ছিলো। তিলতিল করে মনের ভেতর যে স্বরস্বতী গড়ে তুলছিলো সে আজ যেনো তার নাগাল পাওয়ার সময় এসে গেছে।
মনীষাদের বাড়ির সামনে এসে হঠাৎ থমকে দাড়ালো মোতালেব। এত রাতে দরজা খোলা! একটু যেনো ধাক্কা খেলো সে। দুইবার ডেকেও কারো কোনো সাড়া পাওয়া গেলো না। অগত্যা, ঘরের ভেতরে ঢুকে গেলো। নিজের চোখকে কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছিলো না মোতালেবের। একটা নিথর দেহ। পেটের দুই পাশে দুইটা চাকু ঢোকানো। চাকু দুটাকে কেন্দ্র করে রক্তস্রোত প্রবাহিত হচ্ছে। বুঝতে বাকি রইলো না যে, ওটা মনীষার বাবার মৃতদেহ। কিন্তু মনীষা কোথায়?
মোতালেবের মাথা কাজ করছিলো না। হঠাৎ বিছানার দিকে চোখ গেলো তার। যে বিছানায় সে একদিন শুয়েছিলো। স্বর্গের অপ্সরীর ছোয়ায় বেঁচে থাকার নিশ্বাস ফিরে পেয়েছিলো। সেই বিছানায় মনীষার শাড়ী। এলোমেলো। ছোপছোপ রক্তের দাগ। কিন্তু মনীষা কোথায়? কোথা থেকে যেনো চাঁদের উদয় হলো। সে আলোতে রক্তের দাগগুলো ঠিকই বুঝা যাচ্ছিলো। ফোটা ফোটা রক্ত। কিছু পর পর। একেক ফোটা রক্ত আরেক ফোটা রক্তের সন্ধান দিচ্ছিলো। আর সে রক্তপথ ধরে এগিয়ে চললো মোতালেব। এরপর এসে দাড়ালো বটগাছটার সামনে। যে বটগাছের নিচ থেকে মনীষা নামক এক স্বরস্বতী তাকে নতুন জীবন দিয়েছিলো।
সে স্বরস্বতী আজও আছে। তবে এবার বটগাছটার নিচে নয়। বটগাছটার ডালে। আর পাশের কর্দমাক্ত ক্ষেত দিয়ে কয়েকটি পদচিহ্ন চলে গেছে দূরে। বহুদূরে…
লেখক:উজ্জ্বল হোসেন সায়েম I শিক্ষার্থী I গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ I রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
পছন্দের আরো পোস্ট