যবিপ্রবির ৩য় সমাবর্তন

রাষ্ট্রপতি ও যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (যবিপ্রবি) চ্যান্সেলর মোঃ আবদুল হামিদ নবীন গ্রাজুয়েটদের উদ্দেশ করে বলেছেন, দেশের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে তোমাদের উপর। তোমাদের তারুণ্য, জ্ঞান, মেধা ও প্রজ্ঞা হবে দেশের উন্নয়নে প্রধান চালিকাশক্তি। দেশ ও জনগণের কাছে তোমাদের আছে ঋণ। একজন বিবেকবান নাগরিক হিসেবে সেই ঋণ তোমাদের পরিশোধ করা উচিত।

বুধবার বিকেলে যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘৩য় সমাবর্তন-২০১৮’ অনুষ্ঠানে সভাপতির বক্তব্যে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ এসব কথা বলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু একাডেমিক ভবনের সামনের মাঠে এই সমাবর্তন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এর আগে বেলা আড়াইটার সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের সন্নিকটে আব্দুলপুরে অস্থায়ীভাবে স্থাপিত হেলিপ্যাডে মহামান্য রাষ্ট্রপতি অবতরণ করেন। সেখানে তাঁকে যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোঃ আনোয়ার হোসেনের নেতৃত্বে বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে লাল গালিচা সংবর্ধনা দেওয়া হয়। পরে মোটর শোভাযাত্রা করে অনুষ্ঠানস্থলে আসেন রাষ্ট্রপতি এবং তাঁর সফরসঙ্গীরা। এবারের সমাবর্তনে বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫৭০ জন গ্রাজুয়েট অংশগ্রহণ করেন। তাঁদের মধ্যে আটজন চ্যান্সেলর স্বর্ণপদক, পাঁচজন ভাইস চ্যান্সেলর পদক এবং ৫৬ জন ডিন্স অ্যাওয়ার্ড পান।

গ্রাজুয়েটদের উদ্দেশ করে আবদুল হামিদ বলেন, ‘দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ থেকে সর্বোচ্চ ডিগ্রি অর্জনকারী একজন গ্র্যাজুয়েট হিসেবে সবসময় সত্য ও ন্যায়কে সমুন্নত রাখবে। দুর্নীতি ও অন্যায়ের প্রতিবাদ করবে। রাষ্ট্রের বিবেকবান নাগরিক হিসেবে তোমাদের কাছে প্রত্যাশা করি, তোমরা কখনো ডিগ্রির মর্যাদা, ব্যক্তিগত সম্মানবোধ আর নৈতিকতাকে ভূলুণ্ঠিত করবে না। আর একটা কথা বলি, কর্ম উপলক্ষে তোমরা পৃথিবীর যে প্রান্তেই থাকো না কেন, এ দেশ ও দেশের জনগণের কথা ভুলবে না। ভুলবে না খেটে খাওয়া সাধারণ জনগণের কথা। মনে রাখতে হবে, বাঙালির শেকড় এই সাধারণ জনগণের মধ্যেই প্রোথিত। কর্মজীবনে তোমরা সফল হও, সার্থক হও-এই কামনা করি।’

বক্তব্যের শুরুতে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ অবিভক্ত বাংলার প্রথম ঘোষিত জেলা যশোরের ঐতিহ্য ও বরণ্যে ব্যক্তিদের কথা তুলে ধরেন। তিনি বাংলা সাহিত্যে সনেটের প্রবক্তা মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত, বিশ্বখ্যাত চিত্রশিল্পী এস এম সুলতান, বিজ্ঞানী রাধাগোবিন্দ, বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক সহচর শহীদ মসিয়ূর রহমান, মুসলিম জাগরণের পথিকৃৎ মুন্সী মেহেরুল্লাহ, বীরশ্রেষ্ঠ সিপাহী হামিদুর রহমান ও ল্যান্স নায়েক নূর মোহাম্মাদ শেখসহ আরও অনেক বিখ্যাত ব্যক্তিদের স্মরণ করেন। এ ছাড়া যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় বিশেষ অবদান রাখায় স্মরণ করেন প্রয়াত শিক্ষামন্ত্রী এ এস এইচ কে সাদেককে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য সম্পর্কে বর্ণনা করতে গিয়ে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় কেবল পাঠদান কেন্দ্র নয়, বরং তা জ্ঞান সৃষ্টি ও চর্চার এক অনন্য পাদপীঠ। মুক্তচিন্তা, সমকালীন ভাবনা, জ্ঞান-বিজ্ঞানের নবতর অভিযাত্রাসহ সংস্কৃতি চর্চা, সৃজনশীল কর্মকা- শিক্ষার্থীদের জানার পরিধিকে যেমন বিস্তৃত করে তেমনি তাদেরকে পরিণত করে বিশ্ব নাগরিকে। লেখাপড়ার পাশাপাশি সৃজনশীল কর্মকা- শিক্ষার অন্যতম অনুসঙ্গ। এর অনুপস্থিতিতে আজ কূপম-ুকতা, উগ্রবাদসহ নানামুখী অসহিষ্ণুতা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে মুক্ত চিন্তার পরিবেশ বাধাগ্রস্থ করছে। এ থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। আগামী প্রজন্মকে আধুনিক বাংলাদেশের নির্মাতা হিসেবে প্রস্তুত করতে এবং সকল স্তরে নেতৃত্বদানে সক্ষম ও দক্ষ নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে হলে তাদের মধ্যে মানবিক মূল্যবোধের জাগরণ ঘটাতে হবে। তিনি পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, পরমত সহিষ্ণুতা ও অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে লালন করার আহ্বান জানান। এক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থী, গবেষক, অভিভাবক, ছাত্রসংগঠনসহ সকলকে সম্মিলিতভাবে অবদান রাখার ওপর গুরুত্বারোপ করেন।

বিশ্বব্যবস্থায় যোগ্যতাই টিকে থাকার একমাত্র মানদ- উল্লেখ করে রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ বলেন, ‘সময়ের প্রয়োজনেই শিক্ষার্থীদেরকে তথ্যপ্রযুক্তিতে দক্ষ মানবসম্পদ হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। আমি বিশ্বাস করি, যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় উচ্চশিক্ষার এ উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে অব্যাহত প্রচেষ্টা চালিয়ে যাবে।

শোষণমুক্ত একটি সমৃদ্ধ ‘সোনার বাংলা’ বিনির্মাণই ছিলো আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম অঙ্গীকার উল্লেখ করে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ আরও বলেন, বর্তমান সরকার মহান মুক্তিযুদ্ধের সেই লক্ষ্য বাস্তবায়নে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে ডিজিটাল বাংলাদেশ, রূপকল্প ২০২১, রূপকল্প ২০৪১ ঘোষণার মাধ্যমে দেশকে উন্নয়নের মহাসড়কে যুক্ত করা হয়েছে। গৃহীত হয়েছে আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা পূরণে কার্যকর পদক্ষেপ। মাথাপিছু আয়, জাতীয় প্রবৃদ্ধি, নারীর ক্ষমতায়ন, স্যানিটেশন, কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ইত্যাদি ক্ষেত্রে আমরা প্রশংসনীয় সাফল্য অর্জন করেছি। পদ্মা সেতু এখন দৃশ্যমান। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট মহাকাশে উৎক্ষেপণের অপেক্ষায় রয়েছে। এসকল অর্জনকে আরো এগিয়ে নেয়ার জন্য মানসম্মত বিজ্ঞান শিক্ষা ও তথ্যপ্রযুক্তি খাতে আন্তর্জাতিক মানের দক্ষতা অর্জনের বিকল্প নেই।

Post MIddle

প্রযুক্তি উন্নয়নের বাহন উল্লেখ করে আবদুল হামিদ বলেন, উন্নয়নের অগ্রগতি অব্যাহত রাখতে হলে আমাদেরকে নতুন নতুন উদ্ভাবনে উদ্যোগী হতে হবে। তবে একটি জিনিস মনে রাখতে, হবে উদ্ভাবনই যথেষ্ট নয়। উদ্ভাবনকে যথাযথভাবে প্রয়োগই হচ্ছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে উন্নয়নকে এগিয়ে নিতে হবে। কিন্তু প্রযুক্তি যাতে মানুষকে ব্যবহার না করতে পারে, সে ব্যাপারে সচেতন থাকতে হবে। এ ক্ষেত্রে তরুণ প্রজন্মকে এগিয়ে আসতে হবে। যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাবর্তন বক্তা হিসেবে আগমণ করায় অধ্যাপক ড. রবার্ট হিউবারকে বিশেষভাবে ধন্যবাদ জানান রাষ্ট্রপতি।

সমাবর্তনে অধ্যাপক ড. রবার্ট হিউবার তাঁর নিজের ক্ষেত্র প্রাণ-রসায়ন নিয়ে বিস্তারিত বক্তব্য রাখেন। বাংলাদেশের বিরাট প্রাকৃতিক সম্পদ ও জনশক্তি বিষয়েও কথা বলেন তিনি। গ্রাজুয়েটদের উদ্দেশ করে তিনি বলেন, ‘আপনারা এক নতুন জীবনে পদার্পণ করলেন, যেখানে পিতামাতা, সমাজ, দেশ এবং মানবতার প্রতি রয়েছে গুরু দায়িত্ব। একজন মানুষ হিসেবে এই দায়িত্ব পালনে আপনাদের সদা প্রস্তুত থাকতে হবে।

রবার্ট হিউবার বলেন, ‘খাদ্য, শক্তি এবং পরিবেশ বিপর্যয় এখন মানবজাতির জন্য সবচেয়ে বেশি চ্যালেঞ্জের। কিন্তু এরও সমাধান রয়েছে তোমাদের মতো যুব সমাজের মাথায়। তোমরাই যেকোনো দেশের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ।

বিশেষ অতিথির বক্তব্যে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবদুল মান্নান বলেন, জাতিগত উন্নয়ন ত্বরান্বিত করতে উদ্ভাবনী ও কার্যকর জ্ঞান সৃষ্টি অনিবার্য শর্তসমূহের অন্যতম। উন্নত জাতি গঠনের অপরিহার্য শর্ত হলো দূরদর্শী সিদ্ধান্ত গ্রহণে দক্ষ নাগরিক তৈরি এবং সচেতনতাবৃদ্ধিসহ জ্ঞান ও অন্তর্দৃষ্টির প্রসার ঘটানো। বিশ্বায়নের পরিপূর্ণ সুযোগ গ্রহণ করতে হলে এবং আগামীর পৃথিবীতে মর্যাদার সঙ্গে টিকে থাকতে হলে নতুন জ্ঞান সৃষ্টির কোন বিকল্প নেই। তাই, পরিবর্তনশীল বৈশ্বিক পরিস্থিতির সঙ্গে দ্রুত খাপ খাইয়ে নিতে আমাদের নতুন প্রজন্মের বেড়ে ওঠা, বাস্তবমুখী শিক্ষা ও পেশাগত দক্ষতা বৃদ্ধির প্রতি আমাদের মনোযোগী হতে হবে। আর এক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা অগ্রণী এবং অনস্বীকার্য।

যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোঃ আনোয়ার হোসেন সমাবর্তনে আগত রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ, সমাবর্তন বক্তা অধ্যাপক ড. রবার্ট হিউবার, বিশেষ অতিথি অধ্যাপক আবদুল মান্নানসহ সব অতিথিদের ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেন। তিনি সমাবর্তনের গুরুত্ব তুলে ধরে বলেন, বহু প্রতীক্ষিত এ দিনে গ্রাজুয়েটগণ তাদের দীর্ঘ সাধনার আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি পান। আধুনিক বিশ্বজ্ঞানে আলোকিত আমাদের শিক্ষকম-লী সবসময়ই শিক্ষার্থীদের অন্তরে নবকালের স্পন্দন জাগাতে সচেষ্ট রয়েছেন। যার সার্থক অনুরণনই হল এ সমাবর্তন। তাই সমাবর্তন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাগ্রসরতারও স্বীকৃতি।

অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘স্মরণ রাখবে, তোমাদের এ অর্জনের নেপথ্যে ছিলো সরকার, তোমাদের পরিবার, শিক্ষকম-লী এবং সর্বোপরি এ দেশের জন-সাধারণ, যাদের অর্থে পরিচালিত হয় আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা। তাদের কাছে তোমরা ঋণী। এ ঋণ তোমাদের পরিশোধ করতে হবে। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে তোমাদের উপর অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালনের মাধ্যমেই কেবল এ ঋণ পরিশোধ সম্ভব। দেশ-বিদেশে তোমরা আমাদের প্রতিনিধিত্ব করবে। তোমাদের কাজের উপর এ বিশ্ববিদ্যালয়, দেশ তথা সমগ্র জাতির মর্যাদা নির্ভর করবে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, তোমরা আমাদেরকে নিরাশ করবে না।’

রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদের সভাপতিত্বে সমাবর্তন অনুষ্ঠানে সংসদ সদস্য স্বপন ভট্টাচার্য, আবদুল হাই, এস এম জগলুল হায়দার, শেখ আফিল উদ্দিন, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. হারুন-অর রশীদ আসকারী, খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. মোহাম্মদ আলমগীর, মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. মোহাম্মদ আলাউদ্দিন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. নাসরীন আহমাদ, যশোর-খুলনা অঞ্চলের উচ্চ পদস্ত সরকারি কর্মকর্তাগণ, বিভিন্ন কলেজের অধ্যক্ষসহ বিপুল সংখ্যক বরণ্যে ব্যক্তিবর্গ উপস্থিত ছিলেন। এ ছাড়া সমাবর্তন অনুষ্ঠানে গ্রাজুয়েটগণ ছাড়াও যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন অনুষদের ডিন, চেয়ারম্যান, শিক্ষক, কর্মকর্তা এবং কর্মচারীরা উপস্থিত ছিলেন। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার প্রকৌশলী মোঃ আহসান হাবীব, ইংরেজি বিভাগের চেয়ারম্যান মোঃ মনিবুর রহমান এবং একই বিভাগের প্রভাষক ফারহানা ইয়াসমিন।

//স

পছন্দের আরো পোস্ট