ইসলামের দৃস্টিতে প্রযুক্তির ব্যবহার
আল্লাহ তাঁর জ্ঞান ও প্রজ্ঞামাফিক নিজ বান্দাদের জীবনযাপনে তাদের কল্পনাতীত সব উপাদান সৃষ্টি করেন। এমন সব মহা উপকরণ প্রস্তুত করেন যা দাবি করে তাঁর দান ও অনুগ্রহের বন্দনা। ‘তিনিই সে সত্তা যিনি সৃষ্টি করেছেন তোমাদের জন্য যা কিছু জমিনে রয়েছে সব।’ (সূরা বাকারা, আয়াত : ২৯) একারণেই সোলায়মান (আ.) কে আল্লাহ পাখির ভাষা শেখালে তিনি বলেন, ‘এটা আমার পালনকর্তার অনুগ্রহ, যাতে তিনি আমাকে পরীক্ষা করেন যে, আমি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি, না অকৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি।’ (সূরা নামল, আয়াত : ৪০)
বান্দাদের প্রতি আল্লাহর নেয়ামত অবিরত। দুনিয়ার এক নেয়ামত থেকে আরেক নেয়ামতে না ফিরতেই হাজির হয় আরও এক নেয়ামত। জলে কত নেয়ামত। স্থলে কত নেয়ামত। এমনকি আধুনিক জীবনোপকরণে কত নেয়ামত। যা দূরকে এনেছে কাছে। সময়কে বানিয়েছে সংক্ষিপ্ত।
আপনি দেখবেন প্রাচ্যে বসে কেউ শুনছে পাশ্চাত্যের কারও সালাম। একজনের সালাম উচ্চারণ আর অপরজনের তা শ্রবণের মাঝে ব্যবধান ক্ষুদ্র কয়েক মুহূর্তের। উত্তরপ্রান্তের লোক শুনছে দক্ষিণপ্রান্তের কান্না। রোদনধ্বনি আর তা শ্রবণের মাঝে দূরত্ব খুবই কিঞ্চিৎ সময়ের। এ এক অবাক করা বাস্তবতা।
এ গল্প যদি আমাদের পূর্বপুরুষদের শোনানো হত, তারা একে নিশ্চিত কল্পনা, রাতের রূপকথা কিংবা কল্পলোকের চিত্র হিসেবে ধরে নিতেন, চর্মচোখে যার কোনো বাস্তবতা নেই। তারা একে এমন ভাবতেন না কেন? যদি তারা জানতেন, আমাদের কেউ বৈঠকে নিজ আসনে হেলান দিয়ে আছেন কিংবা কক্ষে নিজ খাটে শুয়ে আছেন আর তার কাছে পুব-পশ্চিমের সব খবর পৌঁছে যাচ্ছে!
তিনি কথা বলছেন অজুত, নিযুত, মিলিয়ন-বিলিয়ন লোকের সঙ্গে! তার কাছে উপর্যপুরি খবরাখবর চলে আসছে মুহূর্তেই- তর্জনি হেলনে কিংবা মাধ্যমা চাপতেই! আর এসবই হচ্ছে উঠে দাঁড়ানোর আগেই! মুখ থেকে কথা বের হচ্ছে, সঙ্গে সঙ্গে আঙুলে ডগা তা লিখে ফেলছে আর তৎক্ষণাৎ তা পৌঁছে যাচ্ছে দিক-দিগন্তে! অথচ তিনি এখনো হেলান দেয়া থেকে বসেননি। আর এসব জানতে আপনাকে ঘর থেকে বের হতে হচ্ছে না। ধর্ণা দিতে হচ্ছে না আপনাকে মানুষের কোলাহল, ঘর কিংবা গল্পের আসর বা খবরের লোকদের কাছে! তারা অবাক হবেন নাইবা কেন, তাদের কাছে তো অনুপস্থিত ব্যক্তি ফিরে আসার আগ পর্যন্ত হারিয়েই যেত।
এটা হলো যোগাযোগের মাধ্যমের নেয়ামত- সেটা সামাজিক বা যাই হোক না কেন। দ্রুততা, সূক্ষ্মতা ও পূর্ণতায় এসব জ্ঞানকে বিস্মিত, শ্রবণকে মূর্ছিত ও দৃষ্টিকে বিস্ফোরিত করেছে। এ যে বিশাল নেয়ামত। যা আল্লাহ তার বান্দাদের দান করেছেন তারা কৃতজ্ঞ হয় নাকি অকৃতজ্ঞ তা প্রমাণে। পরীক্ষা করতে যে তারা একে তারা ব্যবহার করে আল্লাহর পছন্দমাফিক ও বৈধ পথে নাকি আল্লাহর সীমালঙ্ঘন এবং তার নিষিদ্ধ করা পথে? ‘আমার বান্দাদের মধ্যে অল্পসংখ্যকই কৃতজ্ঞ।’ (সূরা সাবা, আয়াত : ১৩)
আধুনিক যোগাযোগমাধ্যম এক অনস্বীকার্য বাস্তবতা। এর বহন করা ভালো ও মন্দ দিকগুলো অস্বীকার করার মতো নয়। জ্ঞানী, ইলমধারী ও সুবিবেচনাসম্পন্ন ব্যক্তিদের অবশ্য কর্তব্য হবে দুষ্ট ও অশিষ্ট লোক এবং গাফেল ও অকর্মণ্যদের বিরত রাখা। বেপরোয়া ও অশিষ্টতার উষ্ণতাকে ধীরতা ও কর্তব্যনিষ্ঠার শীতলতা দিয়ে নেভানো। তেমনি আমাদের সবার দায়িত্ব এটা জানা যে, যোগাযোগমাধ্যমের গিবত গিবতই, চোগলখোরি চোগলখোরিই, মিথ্যা মিথ্যাই, অপবাদ অপবাদই, গালির গালিই, গুজব গুজবই। যেকেউ মনে করেন এসব মাধ্যম অর্থ, অভিপ্রেত ও কর্তব্যকে বদলে দেয়, তিনি রূপকল্পে বাস করছেন। যা সৃষ্টি হয়েছে তার চিন্তার সংকীর্ণতা এবং অধিকার ও কর্তব্যে ভ্রূক্ষেপহীনতা থেকে। এ কথা সব নৈতিকতা বিবর্জিত ও শরিয়ত বহির্ভূত পাপের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।
কেননা এসব মাধ্যমে কারও একটি ব্যক্তিগত হিসেব বা আইডির মালিক হওয়া তাকে ইহকালীন জবাবদিহিতা কিংবা পরকালীন গুনাহ থেকে নিরাপত্তা দেয় না। বরং গুনাহ ও জবাবদিহিতার গুরুতরতা বেড়ে যায় একাউন্টে আগমন ও প্রভাব গ্রহণকারীর অনুপাতে। আর আখলাক ও নৈতিকতার মূলনীতি অনঢ় অপরিবর্তনীয়। বরং এটি শ্রবণীয় ভাষার মতো এক পাঠযোগ্য ভাষা। আর আদব-শিষ্টাচারের কোনো বয়স নেই। এ কখনো বৃদ্ধ ও অকার্যকর হয় না।
সোশ্যাল মিডিয়াগুলোতে উম্মাহর কল্যাণকর ও উপকারী নানা দিক থাকলেও এতে বহু অমঙ্গল বিনাশী ক্ষতির দিক রয়েছে খালি মাথাগুলোর জন্য, যার নেই আলোকপ্রদীপ বা সীমানাপ্রাচীর। তবে এর মৌলিক অমঙ্গলের দিক মূলত তিনটি-
প্রথমত, এমন সব বিষয় ছড়িয়ে দেয়া যা এক জাতির সন্তান ও এক মুসলিম সমাজের সদস্যদের মাঝে বিভক্তি, বিবাদ ও দূরত্ব সৃষ্টি করে।
দ্বিতীয়ত, উত্তেজক ও বিভ্রান্তিকর খবর ও গুজব প্রচার করা, যার শুদ্ধতা ও সত্যতা নেই।
তৃতীয়ত, মানুষের সম্মানে আঘাত করা এবং অন্যের দোষ খুঁজে বেড়ানো। শরিয়ত নয় মনগড়া উপায়ে, উপদেশ নয় উপহাসের মাধ্যমে চরিত্র নিয়ে কথা বলা।
মনে রাখবেন, এসব আক্রমণের অধিকাংশই আল্লাহ ও আখিরাতের চেতনার বাঁধন আলগা করে দেয়। কেন নয়, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহ ও শেষ দিবসে বিশ্বাস করে, সে যেন উত্তম কথা বলে নয়তো নীরব থাকে।’ (বুখারি ও মুসলিম)
জেনে রাখুন, এই মাধ্যমগুলো আপনাদের সফরের ব্যাগ। অতএব খেয়াল করুন এতে কী বহন করছেন। অবকাশের জগতে এ আপনাদের সামনে নিজেদের কর্ম। অচিরেই চিরকালের জগতে আপনারা রবের সঙ্গে মিলিত হবেন। এ ব্যাগগুলো ভালো থাকলে ভালো; খারাখ থাকলে খারাপ।
শায়খ ড. সাউদ বিন ইবরাহিম আশ-শুরাইম