শিক্ষানুরাগী একজন মেজবাহ উদ্দিন আহমেদ সাবু
মানুষ বেঁচে থাকে তার কাজের মধ্যে। এমন একজন মানুষ যিনি একাধারে বীর মুক্তিযোদ্ধা, শিক্ষানুরাগী, উপস্থাপক ও সংগঠক ছিলেন। তিনি মেজবাহ উদ্দিন আহমেদ সাবু। সবার কাছে পরিচিত ছিলেন ‘সাবু ভাই’ হিসেবে।
মেজবাহ উদ্দিন আহমেদ সাবু ১৯৫২ সালের ১ মে পুরান ঢাকার কলতাবাজার এলাকায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম মালুম উদ্দিন আহমেদ এবং মায়ের নাম নাজমা খানম। মাত্র ৫১ বছর বয়সে ২০০৩ সালের ৩ নভেম্বর ঢাকার জাতীয় হৃদরোগ ইন্সিটিউটে ইন্তেকাল করেন। মাত্র ৫১ বছরের জীবনে তিনি প্রতিটি সামাজিক কর্মকাণ্ডে যেমন সক্রিয় ছিলেন তেমনি ছিলেন শিক্ষানুরাগী একজন বিশাল হৃদয়ের মানুষ।
মেজবাহ উদ্দিন আহমেদ সাবু পরিবারে সবার বড় ছিলেন। অনুজ ভাই এরশাদ উদ্দিন আহমেদ বেবি একজন মুক্তিযোদ্ধা। যিনি বক্সার হিসেবেও পরিচিত ছিলেন। তিনিও মারা গেছেন। এছাড়া আরেক ভাই শামসাদ উদ্দিন রতনও বেঁচে নেই। সবচেয়ে কনিষ্ঠ ভাই নওশাদ উদ্দিন আহমেদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে থাকেন। দুই বোনের একজন নাসরিন বেগম আরেকজন সংবাদ উপস্থাপিকা সাবিনা মেহেদি। সাবুর স্ত্রী হোসেনে আরা রীনা মতিঝিল মডেল স্কুলে সরকারি প্রধান শিক্ষিকা হিসেবে কর্মরত আছেন। বড় সন্তান নাদির সাফির তানজিম চাকরি করছেন বসুন্ধরা গ্রুপে এবং কন্যা আনিকা সাবরিন আহমেদ বিজয় টিভিতে উপস্থাপক হিসেবে কর্মরত আছেন।
৭০ এর দশকে মতিঝিল সার্ভেনট কোয়ার্টার হিসেবে পরিচিত এজিবি কলোনিতে যখন মাদক, অপরাধ আর সামাজিক অবক্ষয় চূড়ান্ত রুপ ধারণ করেন সাবু তখন ১৯৮০ সালে মতিঝিল মডেল স্কুল প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন। তিনি এই স্কুলের গভারনিং বডির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ছিলেন।
সাবু ১৯৭৭ থেকে ১৯৮১ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিলের মহাসচিব, ১৯৭৭ থেকে ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত টানা ১০ বছর ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের ৩৩ নম্বর ওয়ার্ডের নির্বাচিত ওয়ার্ড কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত সাবু বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিলের ভাইস চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ আর্চারী ফেডারেশনের সভাপতি, খো খো ফেডারেশনের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট, দিলকুশা স্পোর্টিং ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক এবং মতিঝিল মডেল স্কুল এন্ড কলেজের ম্যানেজিং কমিটির সদস্য ছিলেন।
মুক্তিযুদ্ধের সময় ২ নম্বর সেক্টরে সাহসিকতার সাথে জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করেন। মূলত তাঁর মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ অনুজ ভাই এরশাদ উদ্দিন আহমেদ বেবির সন্ধান লাভের জন্য। ভাই এর সন্ধান করতে গিয়ে নিজেই অস্ত্র হাতে দেশের জন্য যুদ্ধ করেন। তাঁর সাথে একই সেক্টরে যুদ্ধ করেছেন এমন উল্লেখযোগ্য বাক্তিদের মধ্যে আছেন- ব্যান্ড সঙ্গীত শিল্পী পপগুরু আজম খান, মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া, নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু ও মতিঝিলের এক সময়ের ওয়ার্ড কমিশনার ফুয়াদ।
কর্মজীবনে সাবু একজন আয়কর উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করেছেন। পাশাপাশি তিনি তাঁর এলাকা মতিঝিল এজিবি কলোনি বিভিন্ন সামাজিক, ক্রীড়া ও উন্নয়নমূলক কাজের সাথে নিজেকে জড়িয়ে মানুষের কল্যাণে সারাজীবন নিজের জীবন উৎসর্গ করেছেন। মতিঝিলের এজিবি কলোনীতে তিনি গরিব শ্রমজীবি মানুষের সন্তানদের জন্য মতিঝিল নৈশ বিদ্যালয় (বর্তমানে সাবু নৈশ বিদ্যালয়), মতিঝিল মডেল স্কুল এন্ড কলেজ, মতিঝিল আইডিয়াল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, মতিঝিল কলোনী শরীর চর্চা কেন্দ্র ও মতিঝিল কলোনি পাঠাগার (বর্তমানে সাবু স্মৃতি পাঠাগার) স্থাপন করেন । এছাড়াও বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন যেমন মতিঝিল পাঞ্জেরী কল্যাণ পরিষদ, নবাংকুর মেলা ও পাপড়ির অন্যতম উপদেষ্টা হিসেবে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিলেন।
জীবনের শেষ বছরে এসে চারদলীয় জোট সরকারের সময় ২০০৩ সালে বাংলাদেশ টেলিভিশনে ‘হৃদয়ে মুক্তিযুদ্ধ’ শিরোনামে একটি ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানের গ্রন্থনা ও উপস্থাপনা করেছিলেন। ১১টি পর্ব উপস্থাপনার পর তিনি যে রাতে মারা যান তার পরের দিন অর্থাৎ ৪ নভেম্বর ২০০৩ সালে এই ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানের পরবর্তী অর্থাৎ ১২তম পর্বের ভিডিও চিত্র ধারণের তারিখ ও কর্মসূচী নির্ধারিত ছিল।
সাবুর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে ২০০৪ সালে রাজারবাগ পুলিশ লাইন থেকে মতিঝিল এজিবি কলোনি বাজার এবং আল হেলাল জোন থেকে আরামবাগ পর্যন্ত সড়কের নামকরণ ‘ বীর মুক্তিযোদ্ধা মেজবাহ উদ্দিন আহমেদ সাবু সড়ক’ করা হয় । হেলাল জোনের একটি জায়গার নামকরণ করা হয় ‘সাবু চত্বর’ নামে।
মৃত্যু সৃষ্টির প্রতিটি প্রাণীর চূড়ান্ত নিয়তি। মৃত্যুতে মানুষের দৈহিক প্রস্থান অনিবার্য হলেও মেজবাহ উদ্দিন আহমেদ সাবুর মত নিবেদিতপ্রাণ মানুষ সাধারণ হৃদয়ের মণিকোঠায় যুগ যুগ ধরে বেচে থাকবেন তাঁর কাজের দ্বারা।