নিরাপদে থাকুক পাখি,পাখির সৌন্দর্যে আমরা মাতি

প্রকৃতির অপরুপ সৌন্দর্যের লীলাভূমি বাংলাদেশের একমাত্র আবাসিক জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় (জাবি)। এই অপরুপ সৌন্দর্যকে হাজারগুণ বাড়িয়ে দেয় ক্যাম্পাসের পরিযায়ী পাখির আগমন, যাদের সাধারনত আমরা অতিথি পাখি নামে ডাকি ।শীতকালের জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় আর অতিথি পাখি, এ দুয়ে মিলে সৃষ্টি করে এক অপূর্ব সৌন্দর্যের মেলবন্ধন। এ কারণেই বুঝি সুন্দর এই ক্যাম্পাসকে শীত একটু  দ্রুতই আলিঙ্গন করে । দূষিত ঢাকা শহরে যখন ফ্যানের বাতাসে ঘুমাতে হয় তখন একটু শীতের আমেজ, বিশুদ্ধ বায়ু আর লেকের পানিতে ভেসে বেড়ানো অতিথি পাখির সৌন্দর্য অবগাহন করতে চাইলে বৃক্ষরাজি পরিবেষ্টিত সবুজ এই ক্যাম্পাস হচ্ছে সবচেয়ে উপযুক্ত স্থান।

শীতকালের শুরু থেকেই ক্যাম্পাসের লেকগুলোয় অতিথি পাখির আনাগোনা শুরু হয়। শীত বাড়ার সাথে সাথে অতিথি পাখির আগমনও বাড়তে থাকে। সাধারনত অক্টোবরের শেষ সপ্তাহ বা নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে অতিথি পাখি আসা শুরু হয় আর  মার্চ মাস পর্যন্ত এরা ক্যাম্পাসে বিচরণ করে, বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেকগুলো লেক রয়েছে। এগুলোর মধ্যে প্রশাসনিক ভবনের সামনের ও পিছনের লেক; আল বেরুনী হল, প্রীতিলতা হল, জাহানারা ইমাম হল -সংলগ্ন লেকগুলোয় সবচেয়ে বেশি পাখির কলতান দেখা যায় । লেকগুলো লাল-পদ্ম ফুলে শোভিত থাকে। লাল-পদ্ম ফুলের চাদরে ঢাকা এই লেকে বৈচিত্র্যময় বাহারি পাখির উড়াউড়ি এক দৃষ্টিনন্দন ও মনোমুগ্ধকর পরিবেশের জন্ম দেয়। প্রায় একশত প্রজাতির বৈচিত্র্যময় পাখির দেখা মেলে সুবুজ ক্যাম্পাস জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে।

এদের মধ্যে রয়েছে হাঁসপাখি ,ছোট সরালি বা পাতি সরালি, বালি হাঁস, রেড ক্রেস্টেড পচার্ড, ফ্লাইফেচার,  ধলাবুক ডাহুক, ছোট পানকৌড়ি, পাতি পানমুরগি, গার্গেনি, ইউরেশিয়ান কার্লিউ, পিনটেইল, মুরহেন, নর্দান, বামুনিয়া, জলপিপি, নাকতা, চিতাটুপি, ছোট লাল গুড়গুটি, কোম্বডাক ও ভিনদেশী বক সহ আরও নাম না জানা হরেক প্রজাতির অতিথি পাখি। এসব পাখির অধিকাংশই আসে উত্তরের হিমালয় ও এর সংলগ্ন এলাকা থেকে ; কিছুসংখ্যক আসে আরও উত্তরের সাইবেরিয়া অঞ্চল থেকে।  রুডি শেলডাক , বালি হাঁসেরা বাস করে মধ্য এশিয়া আর উত্তর-পশ্চিম চীনে। আর শীত এলেই আমাদের দেশে এসে ঘুরে যায়। এরা দল বেধে থাকতে পছন্দ করে না। একা একা কিংবা জোড়ায় জোড়ায় থাকতে এরা পছন্দ করে। পরিভ্রমণে বের হওয়া ছাড়া এরা সাধারনত দল বাঁধে না। তিব্বত ও মঙ্গোলিয়ায় এই পাখিকে পবিত্র পাখি মনে করা হয়। বৌদ্ধদের কাছে এই পাখির নাম ব্রাক্ষিনী পাখি।

Post MIddle

রেড ক্রেস্টেড পচার্ড/রাঙ্গামুরি রাঙ্গামুরি হাঁসের একটি প্রজাতি। এদের আসল বাস ইউরোপ আর মধ্য এশিয়ায়। তবে শীতকালে এরা যখন পরিভ্রমণে বের হয় তখন এরা বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়া বা পশ্চিম আফ্রিকায় চলে যায়। এরা খুবই মিশুক প্রকৃতির। সবসময় দল বেধে ঘুরাঘুরি করে। এরা পানিতে ডাইভ দিয়ে খায় তাই এদের ডাইভিং হাঁস বলা হয়। ইউরেশিয়ান কার্লিউ/ বড় গুলিন্দা বড় গুলিন্দার বাস এশিয়ার উত্তরাঞ্চলে। এরা ঘুরতে বের হলে যায় দক্ষিণ এশিয়ায়। তখন এরা বাংলাদেশেও আসে।  এরা খুবই মিশুক প্রকৃতির পাখি। এরা সাধারনত কাদার মধ্যে ঘুরে বেড়ায় আর পোকামাকড় খায়।  শীতকালে অতিথি পাখি বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চল সহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের জলাশয়ে দেখতে পাওয়া গেলেও দিন দিন অতিথি পাখির আগমন কমে আসছে। এর প্রধান কারণ হল অবাধে অতিথি পাখি শিকার করা। এছাড়াও অন্যান্য কিছু বিষয় যেমন জলাশয়ের সংখ্যা কমে যাওয়া, বনাঞ্চল ধ্বংস করা, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিশেষত সুন্দরবনে ইকোসিস্টেমের অবনতি ও অতিথি পাখি কমে যাওয়ার কারণ। এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। প্রতি বছরই এখানে প্রচুর পরিমাণে অতিথি পাখির আগমন ঘটে। এজন্যই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় অতিথি পাখির জন্য বিখ্যাত। অতিথি পাখির আগমন যাতে অব্যাহত থাকে সেজন্যে প্রশাসনের তরফ থেকে বেশ কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। ক্যাম্পাসের লেকগুলো প্রশাসনিকভাবে সংরক্ষিত ঘোষনা করা হয়েছে। বেশ কিছু লেক আর এলাকাকে পাখির অভয়ারণ্য হিসেবে ঘোষনা করা হয়েছে।

লেকগুলোতে মাছ ধরাও নিষিদ্ধ। ক্যাম্পাসে প্রতি বছর পাখি মেলার আয়োজন করা হয় যেখানে বিচিত্র প্রজাতির হরেক রকমের পাখি দেখতে পাওয়া যায়।

ক্যাম্পাসে অতিথি পাখি দেখার সবচেয়ে ভাল সময় হল শীতের সকাল ও বিকাল। বিকালে দর্শনার্থীদের আনাগোনা বেশি থাকে। অনেক আলোকচিত্রী ও এখানে আসেন। ক্যাম্পাসে দর্শনার্থীদের কিছু বিষয়ে খেয়াল রাখা দরকার। যেমন সংরক্ষিত ও অভয়ারণ্য ঘোষিত এলাকায় গাড়ির হর্ণ না বাজানো, গোলমাল না করা, শিস না বাজানো, ঢিল না ছোঁড়া সর্বোপরি পাখিদের বিরক্তি ও ভীতির কারণ হয় এমন কিছু না করা। ক্যাম্পাসে দর্শনার্থীদের নিরাপত্তা ও নিয়ন্ত্রনের জন্য নিরাপত্তা কর্মী রয়েছে।


ঢাকা শহর থেকে ক্যাম্পাসের দূরত্ব প্রায় ৩০ কিলোমিটার। তাই সকালে অতিথি পাখি দেখতে চাইলে খুব সকালে রওনা দিতে হবে। ক্যাম্পাসে আসার জন্য প্রচুর বাস পাওয়া যায়। গুলিস্তান, ফার্মগেট, কল্যাণপুর বা গাবতলী থেকে সরাসরি গাড়িতে ক্যাম্পাসে আসা যায়। আবার গাবতলী থেকে মানিকগঞ্জগামী যেকোন বাসে ক্যাম্পাসে আসা যায়। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অপার সৌন্দর্য আর অতিথি পাখি সবসময়ই দর্শনার্থীদের মুগ্ধ করেছে। প্রকৃতিপ্রেমী আর পাখিপ্রেমীরা তাই বারবার এই ক্যাম্পাসে ছুটে আসেন।

////স

পছন্দের আরো পোস্ট