শিক্ষা ক্যাডার বিতর্ক: যা জানা দরকার
বিসিএস একটি তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক পরীক্ষা যা ছয়টি ধাপ পার হয়ে মেধা, পছন্দক্রম ইত্যাদির উপর ভিত্তি করে একজন লোক ক্যাডার অফিসার হিসেবে নিয়োগ লাভ করেন। সুযোগ্য ক্যাডার অফিসার বাছাই করার দায়িত্ব বাংলাদেশ সংবিধান পিএসসিকে (পাবলিক সার্ভিস কমিশন) দিয়েছে। ক্যাডার সার্ভিসে বিসিএস পরীক্ষা ছাড়া পার্শ্বপথে প্রবেশের কোন সুযোগ নেই। কিন্তু ২৮টি ক্যাডারের মধ্যে ২৭টি ক্যাডার এ ধারা টিকিয়ে রাখতে সক্ষম হলেও শিক্ষা ক্যাডার নানা পার্শ্বপ্রবেশে (আত্মীকৃত, ডেমোনেস্ট্রেটর, ১০%) ভারাক্রান্ত, ন্যুব্জ, বিপর্যস্ত। প্রশ্ন হলো শিক্ষা ক্যাডারে এমন বিশৃঙ্খল অবস্থা কেন? উত্তর পরে জানব। দেখা যাক, তারা ক্যাডার হলে সমস্যা কোথায়?
এক্ষেত্রে আত্মীকৃত শিক্ষকদের দু’একটা যুক্তি পর্যালোচনা করা যাক। তারা বলে থাকেন, শিক্ষা ক্যাডার সদস্য ও আমরা উভয়েই একই শিক্ষাগত যোগ্যতার অধিকারী, তারাও যা পড়ান, আমরাও তা-ই পড়াই তাহলে মর্যাদা আলাদা হবে কেন? আমাদের জানা থাকা দরকার যে, বিসিএস শিক্ষা ক্যাডার সদস্যদেরকে নিয়োগই দেওয়া হয় শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তা হিসেবে, শিক্ষক হিসেবে নয়। নিয়োগ ও পদায়নের কোথাও শিক্ষক কথাটা লেখা থাকে না। পেশাগত বৈশিষ্ট্যের কারণে তবুও তারা একদিকে শিক্ষক অন্যদিকে শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তা। তাদেরকে শিক্ষকতা করার পাশাপাশি শিক্ষা প্রশাসনের অনেক দায়িত্ব পালন করতে হয়। যেমন- কলেজ প্রশাসন, শিক্ষা বোর্ড, মাউশি, নায়েম, ব্যানবেইস, এনসিটিবি, ডিআইএ, ইউনেস্কো কমিশন, অবসর সুবিধা বোর্ড, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর ছাড়াও সরকারের নিজস্ব নির্বাহী পদ উপসচিব থেকে শুরু করে সচিব পর্যন্ত হতে পারেন। এজন্যই বিসিএস পরীক্ষার মাধ্যমে মেধাবী ও চৌকস কর্মকর্তাদের বাছাই করা হয়। সুতরাং ঘোড়া ও গাধা এক গোত্রের প্রাণি হলেও গাধার সমমর্যাদা দাবী অবান্তর নয় কি?
আইনগত পর্যালোচনাতেও দেখা যায়, আত্মীকৃত কলেজ শিক্ষকদের ক্যাডার মর্যাদা দেওয়া সংবিধান ও আইন পরিপন্থি। সিভিল সার্ভিস আইন ১৯৮০ ও ১৯৮১ অনুযায়ী সরাসরি নিয়োগ ও পদোন্নতি ছাড়া সিভিল সার্ভিসে প্রবেশের সুযোগ নেই। অথচ এর আগে শিক্ষা ক্যাডারে নেতৃত্বের দুর্বলতা, মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত সৎপিতাদের অনৈতিক ও স্বার্থন্বেষীমূলক কর্মকাণ্ডর সুযোগ নিয়ে জনপ্রশাসন ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন ছাড়া সমঝোতামূলক বিধিমালা তৈরি করে তাদেরকে ক্যাডার হিসেবে আত্মীকরণ করে নেওয়া হয়েছে। ফল যা হবার তা হয়েছে। শিক্ষা ক্যাডারের হাতে-পায়ে ধরে দাঁড়ানোর জায়গা চেয়ে এখন ক্যাডারের মূল সদস্যদেরকে উৎখাত করে ঘুমানোর জায়গা করে নিয়েছে। বিসিএস পাশ করা শিক্ষকদেরকে বঞ্চিত করে তারা আগে সিনিয়রিটি ও প্রমোশন নিয়ে নিচ্ছে (আমি নিজেও এর শিকার)। শুধু তাই নয়, ক্যাডার সার্ভিসের প্রশাসনিক পদ অধ্যক্ষ, উপাধ্যক্ষ, শিক্ষাবোর্ডের চেয়ারম্যান, নায়েমের ডিজি ইত্যাদির অধিকাংশই এখনো তাদের দখলে। বর্তমানে তিন শতাধিক সরকারি কলেজের মধ্যে আড়াই শত এর মতো কলেজের অধ্যক্ষ বা উপাধ্যক্ষ তারা। দু’একটা উদাহরণ দিই। বর্তমানে বরিশাল শিক্ষাবোর্ডের চেয়ারম্যান, নায়েমের ডিজি জাতীয়করণকৃত কলেজের শিক্ষক ছিলেন। আমার ১১ বছর ৮ মাসের কর্মজীবনে ৭ জন অধ্যক্ষের অধীনে কাজ করেছি যাদের মধ্যে মাত্র একজন ছিলেন বিসিএস পাশ করা লোক বাকি সবাই পার্শ্বপ্রবিষ্ট লোক। এবারে বুঝুন, তাদের দৌরাত্ম্য কতটুকু। এর আগে জাতীয়করণ করা কলেজের সংখ্য অনেক কম ছিল, তাতেই এ অবস্থা। সামনে ২৮৩ কলেজের পঙ্গপালের মতো যে সংখ্যা মহামারী আকারে ধেয়ে আসছে তা ঠেকানো না গেলে সমস্ত অর্জনই তারা ছিনতাই করে নেবে। ক্যাডার সার্ভিসের চাকরি আমার বহু কষ্টের অর্জন, এটার সুফল ভোগ করা আমার অধিকার। আপনি বিনা কষ্ট ও পরিশ্রমে আমার এ অর্জনকে কেড়ে নিয়ে যাবেন, আমার অধিকারে ভাগ বসাবেন এটা কি করে মেনে নেই, বলুনতো?
জাতীয়করণকৃত কলেজের শিক্ষকদের মধ্যে দু’চারজন যে মেধাবী ও যোগ্যতাসম্পন্ন নেই তা বলা যাবে না। তবে তাদের অধিকাংশেরই ক্যাডার অফিসার হওয়ার যোগ্যতা নেই। কারণ, আমরা তাদের সার্টিফিকেটগত দুর্বলতা ও ডোনেশন ভিত্তিক পাতানো নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পর্কে প্রায় সবাই অবগত আছি। নিয়োগ প্রক্রিয়াটা বির্তর্কিত হওয়ার কারণেই নিবন্ধন পরীক্ষা চালু করা হয়েছে। তাদের কলেজের ফলাফল সরকারি কলেজের চেয়ে ভাল এটাও ঢালাওভাবে দাবী করা হয়। আমাদের জানা দরকার যে, জাতীয়করণকৃত কলেজগুলোতে মূলত উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে পাঠদান করা হয়। আর সরকারি কলেজগুলোর ক্ষেত্রে অধিকাংশ বড় কলেজে অনার্স, মাস্টার্স পড়ানো হয়, উচ্চমাধ্যমিক নয় (এসএসসিতে পাসের হার বৃদ্ধির কারণে সম্প্রতি কিছু কলেজে উচ্চমাধ্যমিক চাপিয়ে দেয়া হয়েছে, কিন্তু শিক্ষক পদ বাড়ানো হয়নি)। তাছাড়া, উপজেলা পর্যায়ের কলেজগুলো সরকারি হলেই আত্মীকৃত শিক্ষকরা আর আগের কলেজে থাকেন না। তারা চলে যান জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ কলেজগুলোতে। সুতরাং উপজেলা পর্যায়ের সরকারি কলেজগুলোতে সারা বছরই শিক্ষক সংকট লেগে থাকে যা ছাত্র-ছাত্রীদের ভাল ফলাফলে সহায়ক নয়। তবে ঢাকার যে কয়টা বেসরকারি কলেজ (যেমন: নটরডেম, ভিকারুন্নেসা ইত্যাদি) ভাল ফলাফল করে এগুলোতে উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্তই পড়ানো হয়। এগুলো সম্পূর্ণ বেসরকারি। সরকারি কোন টাকা পয়সা তারা গ্রহণ করেন না। এগুলোর উদাহরণ টেনে আনা যৌক্তিক নয়। সুতরাং সরকারি কলেজগুলোর তুলনায় বেসরকারি কলেজের ফলাফল ভাল এ দাবী অযৌক্তিক।
আত্মীকৃত শিক্ষকদের আর একটা সমস্যা হচ্ছে আচরণগত। তারা ক্যাডারে অন্তর্ভুক্ত হলেও হীনমন্যতায় ভোগেন। কোন কলেজ আত্মীকৃত শিক্ষক নিয়ন্ত্রিত হলে বা তারা সংখ্যায় বেশি হলে তারা অনেক ক্ষেত্রেই বিসিএস সদস্যদের ডমিনেট করার চেষ্টা করেন। কখনো কখনো তাদের অক্যাডারসুলভ আচরণের কারণে আমরা বিভিন্ন জায়গায় অপদস্থ হই বা আমাদের মর্যাদাহানি ঘটে। তারা পাবলিক পরীক্ষার হলে প্রশাসন ক্যাডারের সর্বকনিষ্ঠ সদস্যের উপস্থিতেও আতঙ্ক বোধ করেন। তবে কখনো কখনো তারা আমাদের চেয়ে অনেক ক্ষমতাবান, ক্ষেত্রবিশেষে অধিক যোগ্যতাবান (!)। তারা রাজনীতির সাথে সরাসরি জড়িত থাকায় এমপি, মন্ত্রীদেরকে তারা ভাই বলে ডাকেন আর জনপ্রতিনিধি হিসেবে আমরা তাদেরকে স্যার বলে সম্বোধন করি। সুতরাং তারা রাজনৈতিকভাবে যতটা ফায়দা নিতে পারেন আমরা তা পারি না। আবার নানা অবৈধ সুযোগ সুবিধা ভোগের ক্ষেত্রে মন্ত্রণালয়ে যে পরিমাণ টাকা ঢালতে পারেন (পত্রিকার রিপোর্টে প্রকাশিত) বিসিএস করা ক্যাডার সদস্যরা তা পারেন না। শিক্ষা ক্যাডারের দুর্ভাগ্য যে, এ ক্যাডারের নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ হচ্ছেন প্রশাসন ক্যাডারের লোক। আমরা তাদের সৎসন্তান আর কি! সৎ পিতারা পরের ঔরসজাত সন্তানের প্রতি কতটা মমতাময়ী হতে পারেন তা যাদের বাস্তবতা জ্ঞান আছে তারাই বুঝতে পারেন। নাহলে শিক্ষা ক্যাডারের এই হ য ব র ল অবস্থা আজকের নতুন নয়। আমরা একজন সদাশয় অভিভাবকও পাইনি যিনি এগুলো সুরাহা করার চেষ্টা করেছেন। বরং প্রমোশনসহ নানা বৈষম্য আরো বর্ধিত করেছেন। প্রশাসন ক্যাডারে ব্যাচভিত্তিক প্রমোশন, আর ঐ ক্যাডারের লোক হয়েও তাদের নেতৃত্বে শিক্ষা ক্যাডারে শূন্য পদভিত্তিক প্রমোশন। আমাদের ছয় বছর পরে ৩০-তম বিসিএসে যোগ দিয়েও তারা প্রমোশন পেয়ে সহকারী অধ্যাপক আর ২৬ বিসিএসের আমার বন্ধুদের অনেকে একযুগ ধরে প্রমোশন বঞ্চিত। কি বিচিত্র সেলুকাস! এ জ্বালা ভুক্তভুগী ছাড়া কেউ বুঝবে না। যাহোক, আমাদের সাবেক অভিভাবক এন আই খান (সাবেক শিক্ষা সচিব) ও বর্তমান শিক্ষা সচিব মহোদয়ের আচরণ ও কথাবার্তায় তেল ও জলকে এক মর্যাদায় রাখার অভিব্যক্তি প্রকাশিত। আসলে তারা হচ্ছেন ঔপনিবেশিক মানসিকতার ধ্বজ্জাধারী ডিভাইড এন্ড রুল পলিসির প্রবক্তা। আমি বুঝি না, একজন ক্যাডার কর্মকর্তা হয়ে উনারা কি করে আত্মীকৃত শিক্ষকদের পক্ষ নিতে পারেন। কোন স্বার্থের কাছে তাদের বিবেক বোধ বিকিয়ে দিয়েছেন যে, তারা বিসিএস পাশ করা লোকদের বাদ দিয়ে আত্মীকৃত শিক্ষকদের অধিকাংশ কলেজের অধ্যক্ষ পদে নিয়োগ দেন। প্রশ্ন জাতির বিবেকের কাছে।
সমাধান? আমরা কলেজ জাতীয়করণে সরকারের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানাই। কিন্তু জাতীয়করণকৃত কলেজের শিক্ষকদের ক্যাডারভুক্ত করার ব্যাপারেই আমাদের আপত্তি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর অনুশাসন ‘জাতীয়করণকৃত কলেজের শিক্ষকরা অন্যত্র বদলি হতে পারবেন না’ এর মধ্যেই তাদেরকে ক্যাডার বহির্ভূত রাখার কথা উল্লেখিত হয়েছে। এক্ষেত্রে আইনই হতে পারে একমাত্র সমাধান। ক্যাডার সার্ভিস আইন আছে। তাছাড়া জাতীয় সংসদে পাশ হওয়া জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০-এ আত্মীকৃত শিক্ষকদের জন্য আলাদা বিধিমালা তৈরি করে নিয়োগ দানের কথা বলা হয়েছে যা মানলেই সকল সমস্যার সমাধান। আমরা সে আলোকেই সমাধান চাচ্ছি।