শুদ্ধ বাংলা পড়ার ভিত তৈরি করছে কমিউনিটি রিডিং ক্যাম্প

এসো মোরা পড়তে শিখি, দু’চোখ ভরে বিশ্ব দেখি। এই শ্লোগানকে অন্তরে ধারণ করে USAID আর্থিক সহায়তায়, সেভ দ্য চিলড্রেন এর কারিগরি সহযোগিতায় আরডিআরএস বাংলাদেশ কর্তৃক বাস্তবায়নকৃত READ প্রকল্পের মাধ্যমে বিদ্যালয়ের পাশাপাশি বিদ্যালয়ের বাইরেও মুক্ত পরিবেশে, আনন্দের সাথে, খেলার মাধ্যমে প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণির শিশুরা এখন শুদ্ধ ও প্রমিত উচ্চারণে বাংলা পড়তে শিখছে। READ প্রকল্পের মাধ্যমে শিশুদের বাংলা পড়ার দক্ষতা উন্নয়নে কুড়িগ্রাম জেলার কুড়িগ্রাম সদর ও উলিপুর উপজেলায় ১৩২টি কমিউনিটি রিডিং ক্যাম্পের মাধ্যমে ৯,৬৮৮ জন শিক্ষাথীর পঠন-দক্ষতা উন্নয়নে কাজ করছে আরডিআরএস বাংলাদেশ।

আমাদের দেশে শিশুদের শিক্ষার প্রাথমিক ভিত তৈরি করে মূলত প্রাথমিক বিদ্যালয়। এরই পাশাপাশি জঊঅউ প্রকল্পের মাধ্যমে শিশুদের বাংলা শিক্ষার ভিতকে আরও স্থায়ী করার জন্য বিদ্যালয়ের বাইরে কমিউনিটি পর্যায়ে চালু করা হয়েছে কমিউনিটি রিডিং ক্যাম্প। ইতিমধ্যে কমিউনিটি রিডিং ক্যাম্প শিশুদের বাংলায় পড়তে শেখার অন্যতম একটি স্থান হিসেবে স্থানীয়ভাবে ব্যাপক পরিচিতি পেয়েছে।

এখানে শিশুরা একজন কমিউনিটি লিটারেসী ভলান্টিয়ার (সিএলভি) এর সহায়তায় মুক্তখেলা ও নাম স্বাক্ষর, গানের সময়, আমরা যা যা করব, গল্প বলা, মূলকাজ, হাতে-কলমে কাজ, সাময়িকী উন্নয়ন ও লেখা অনুশীলন এবং অনানুষ্ঠানিক মূল্যায়ন এই ৮টি ধাপে বাংলা পঠনদক্ষতা উন্নয়নে নিজেদের সমৃদ্ধ করছে। এখানে শিশুরা একদিকে যেমন শুদ্ধ উচ্চারণে বাংলা পড়তে শিখছে, অপরদিকে তেমনি পড়ার খেলা, ছড়া ও কবিতা আবৃতি, গান ও নাচের মাধ্যমে সাংস্কৃতিকভাবে নিজেদের দক্ষতার উন্নয়ন করার সুযোগ পাচ্ছে।

বিভিন্ন মানবিক গুণাবলী অর্জনের মাধ্যমে নিজেদের বিবেকবান মানুষ হিসেবে তৈরি করছে। এই ক্যাম্পগুলো পরিচালনার জন্য প্রতিটি ক্যাম্পে রয়েছে ৭ সদস্য বিশিষ্ট একটি কমিউনিটি রিডিং ক্যাম্প ম্যানেজমেন্ট কমিটি। প্রতি মাসেই ক্যাম্পে আয়োজন করা হয় অভিভাবক সভা। যার মাধ্যমে শিশুদের মাসিক অগ্রগতি অভিভাবকদের জানানো হয় এবং বাড়িতে শিশুদের জন্য অভিভাবকদের কী করণীয় সে বিষয়ে আলোচনা করা হয়। যা নির্দিষ্ট অভিভাবকদের মাধ্যমে আবার ফলোআপও করা হয়। যার ফলে রিডিং ক্যাম্পের আওতাভুক্ত শিশুদের বাড়িতে একটি পড়ার নির্দিষ্ট স্থান তৈরি হয়েছে এবং সে বাড়িতেও অভিভাবকদের সহায়তায় পড়া চর্চা করতে পারছে।

Post MIddle

ক্যাম্প থেকে প্রতি সপ্তাহে শিশুদের পড়ার জন্য স্ব স্ব শিশুর উপযোগি একটি করে গল্পের বই দেওয়া হয়। এর ফলে পাঠ্য বইয়ের বাহিরেও তার পড়ার অভ্যাস তৈরি হচ্ছে। শিশুদের বাংলা পঠনদক্ষতার এই অগ্রগতি সরেজমিনে দেখতে যাওয়া হয় কুড়িগ্রাম সদর উপজেলা সংলগ্ন আজিজ নগর কমিউনিটি রিডিং ক্যাম্পে। সেখানে গিয়ে দেখা যায় ২০/২৫ হাত লম্বা ও ১০ হাত প্রসস্থ একটি জায়গায় চারিদিকে দড়ির সাথে বিভিন্ন রঙিন পোস্টার সমৃদ্ধ উপকরণ দিয়ে ঘেরা মাঝখানে রঙিন ম্যাটে ৩০জন শিশু ইউ আকৃতিতে বসে কা, খা, গা, ঘা জোরে জোরে উচ্চারণ করে পড়ছে। সামনে আছে একটি ধ্বনিচার্ট।

রিডিং ক্যাম্পএটি দেখে দেখে একজন পড়ছে, অন্যরা তার সাথে সাথে পড়ছে। পড়া শেষে কথা হয় রনি নামে এক শিক্ষার্থীর সাথে, সে জানালো এখানে তার ভালোলাগা কিছু কথা। রনি বললো, আমরা সপ্তাহে তিনদিন এখানে স্কুল ছুটির পর পড়তে আসি। আপা আমাদের নিয়ে গান করে, গল্প শোনায়, আমরা জোড়ায় পড়ি, একমিনিট করে প্রত্যেকে বইয়ের পড়া পড়ে আপাকে শুনাই, পড়তে গিয়ে আমাদের যার যেখানে সমস্যা আপা সেখানে সহযোগিতা করে।

এভাবে আমরা খুব আনন্দের সাথে, খেলতে খেলতে পড়তে শিখি। ক্যাম্প বিষয়ে কথা হয় ক্যাম্প সংলগ্ন আজিজ নগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের সাথে, তিনি জানান, কমিউনিটি রিডিং ক্যাম্প হলো বিদ্যালয়ের বাহিরে প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণির শিশুদের বাংলা পড়তে শেখার একটি উপযুক্ত স্থান, যা প্রকান্তরে বিদ্যালয়কেই সহায়তা করছে।

এ প্রসঙ্গে কথা বলি স্থানীয় অভিভাবকের সাথে তিনি বলেন, “হামার ছাওশয়া গুলাক আগত প্রাইভেট পড়াই ছিনুক, এলা আর প্রাউভেট পড়া নাগে না এটে কোনায় পড়া হয়”। অনুসন্ধান করে জানা যায় যে, কমিউনিটি রিডিং ক্যাম্পগুলোর কারণে শিশুদের বাংলা পঠনদক্ষতায় ধারাবাহিক উন্নয়ন হওয়ায় তারা এখন প্রত্যেকেই বিদ্যালয়মূখী হয়েছে, যার ফলে বিদ্যালয়ে শিশু অনুপস্থিতির হার কমেছে এবং বাংলা বিষয়ে নম্বর প্রাপ্তির হারও পূর্বের তুলনায় বৃদ্ধি পেয়েছে। শেষ বিকালে যখন ফিরে আসি রিডিং ক্যাম্প থেকে, তখনও কানে বাজে রিডিং ক্যাম্পের শিশুদের সুস্পষ্ট উচ্চারণ কা, খা, গা, ঘা।

নাসিম উদ্দীন আহম্মেদ। সিনিয়র টেকনিক্যাল অফিসার। রিড প্রকল্প ।আরডিআরএস বাংলাদেশ,রংপুর।

পছন্দের আরো পোস্ট