ত্যাগ ও কুরবানির পবিত্র ঈদুল আযহা
ঈদ শব্দটি আরবি। এর অর্থ বারবার ফিরে আসা, ঘুরে ফিরে আসা, জামায়েত হওয়া, খুশি, আনন্দ, অভ্যাস ইত্যাদি। এমন দিনকে ঈদ বলা হয় যে দিন মানুষ একত্র হয় ও দিনটি বারবার ফিরে আসে। এটা আরবি শব্দ “আদা-ইয়াউদু” থেকে উৎপন্ন হয়েছে। আবার অনেকে বলেন এটা আরবি শব্দ “আদত” বা অভ্যাস থেকে উৎপন্ন। কেননা মানুষ ঈদ উদযাপনে অভ্যস্ত। সে যাই হোক, যেহেতু এ দিনটি বারবার ফিরে আসে এবং মুসলমানরা এ দিনে তাদের প্রভুর নির্দেশ পালন করে আনন্দ পায় তাই এর নামকরণ করা হয়েছে ঈদ।
এ শব্দ দ্বারা এ দিবসের নাম রাখার তাৎপর্য হলো আল্লাহ রাব্বুল আলামিন এ দিবসে তার বান্দাদেরকে নিয়ামাত ও অনুগ্রহ দ্বারা বারবার ধন্য করেন ও তাঁর ইহসানের দৃষ্টি বারবার দান করেন। যেমন রমযানে পানাহার নিষিদ্ধ করার পর আবার পানাহারের আদেশ প্রদান করেন। সদকায়ে ফিতর, হজ-যিয়ারত, কুরবানির গোশত ইত্যাদি নিয়ামাত তিনি বারবার ফিরিয়ে দেন। আর এ সকল নিয়ামাত ফিরে পেয়ে ভোগ করার জন্য অভ্যাসগতভাবেই মানুষ আনন্দ-ফুর্তি করে থাকে।
ঈদ এর একাধিক অর্থ থাকলেও আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষ ঈদ বলতে খুশিই বুঝে থাকে। এ খুশির ঈদ আমাদের মাঝে আসে প্রতি বছর দু’বার। একটিকে আমরা বলি ঈদুল ফিতর বা রোযার ঈদ, আর অন্যটিকে বলে থাকি ঈদুল আযহা বা কুরবানির ঈদ। ঈদুল ফিতর মাহে রমযানে পূর্ণ একমাস সিয়াম সাধনা পালনের মাধ্যমে তাকওয়া অর্জন ও ক্ষুধাতুরের কষ্ট অনুভব করার সাথে সম্পৃক্ত। আর ঈদুল আযহা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় পবিত্র হজ্জ পালন ও মুসলিম জাতির পিতা ইবরাহীম এবং স্বীয় পুত্র ইসমাঈল আলাইহিমাস সালাম এর ত্যাগ ও কঠিন ঈমানী পরীক্ষার উজ্জ্বল দৃষ্টান্তের কথা।
যে সমাজে এখনো আল্লাহর বিধানের বিরুদ্ধে রিট দায়ের করা হয়, হাজার হাজার মানুষ না খেয়ে পথে-ঘাটে জীবন যাপন করছে, দিনে তিন বেলা তিন মুঠো ভাত ঝুটে না যাদের, রাত্রি বেলায় আশ্রয় পায় না যারা তাদের মতো অসহায়দের মুখে হাসি না ফুটিয়ে কীভাবে সম্ভব ঈদের সত্যিকার আনন্দ উপভোগ করা!
ঈদ অর্থ খুশি বা আনন্দ। কিন্তু এ আনন্দ কার জন্যে? যে শয়তানকে খুশি করতে পেরেছে তার জন্যে, নাকি যে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করতে পেরেছে তার জন্যে? নিঃসন্ধেহে যে আল্লাহকে খুশি করতে পেরেছে ঈদ কেবল তার জন্যেই। যে সমাজে সত্য বলা বা সত্যের উপর অবস্থান করার কারণে ভাল মানুষগলো নির্যাতনের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়, প্রভাব খাটিয়ে চলে যুলুমবাজরা, সেখানে ঈদের আনন্দ খুঁজে পাওয়া কীভাবে সম্ভব। যারা আজ অসহায়-মাযলুম তাদের কি মনে চায় না ঈদের আনন্দ করতে? তা হলে পারছে না কেন? এ বাস্তব সত্যটুকুন উপলব্ধি করতে না পারলে সত্যিকার অর্থে ঈদ এর আনন্দ অনুভব করা যাবে না।
কেউ আনন্দ পায় পরকে ঠকিয়ে, কেউ পায় পরকে দিয়েÑ তবে দুজনের মর্যাদা কিন্তু এক নয়। নমরুদ-ফেরাউন আনন্দ পেয়েছে অন্যের উপর যুলম-নির্যাতন করেÑ তাদের ঠিকানা হয়েছে জাহান্নামে। দুনিয়াতেও হয়েছে তারা অপমানিত। আর মুসলিম জাতির পিতা ইবরাহীম ও পুত্র ইসমাঈদ আলাইহিমাস সালাম আনন্দ পেয়েছেন মহান রবের নির্দেশ পালন করতে গিয়ে আগুনে ঝাপ দিয়ে, ছুরির নিচে গর্দান পেতে দিয়ে। আগুনের কুন্ডুলিতে ঝাপ দিয়েও ইবরাহীম আলাইহিস সালাম ভুলেননি তাঁর রবকে। তাঁর এ ত্যাগ কবুল করেছেন আল্লাহ তায়ালা। ফলে তিনি হয়েছেন মুসলিম জাতির পিতা। যুগ যুগ ধরে এ ইতিহাস লেখা থাকবে সোনালি আক্ষরে। এ সব স্মরণ করতে থাকবে মুসলিম জাতি। ইবরাহীম ও ইসমাঈল আলাইহিমাস সালাম এর আত্মত্যাগই আজ আমাদেরকে অনুপ্রাণিত করে ঈদুল আযহা উদযাপন আর পশু কুরবানি করতে।
ইসলামে ঈদের প্রচলন
মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন মুসলিম উম্মাহর প্রতি রহমত হিসেবে যেসব নিয়ামাত দান করেছেন তার মধ্যে ঈদ অন্যতম। হাদীসে এসেছে- ‘রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলইহি ওয়া সাল্লাম যখন মদিনাতে আগমন করলেন তখন মদিনাবাসীদের দুটো দিবস ছিল যে দিবসে তারা খেলাধুলা করত। রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলইহি ওয়া সাল্লাম জিজ্ঞেস করলেন এ দু’ দিনের কি তাৎপর্য আছে? মদিনাবাসীগণ উত্তর দিলেন, আমরা মূর্খতার যুগে এ দু’ দিনে খেলাধুলা করতাম। তখন রাসূলে কারীম সল্লাল্লাহু আলইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, ‘আল্লাহ রাব্বুল আলামিন এ দু’ দিনের পরিবর্তে তোমাদের এর চেয়ে শ্রেষ্ঠ দুটো দিন দিয়েছেন। তা হল ঈদুল আযহা ও ঈদুল ফিতর।’ (আবু দাউদ- ১১৩৪, হাদীসটি সহীহ)
যে দুটো দিন ছিল শুধু খেলা-ধুলা, আমোদ-ফুর্তির জন্য আল্লাহ তায়ালা তা পরিবর্তন করে এমন দুটো দিন দান করলেন যে দিনে আল্লাহর শুকরিয়া, জিকির, তার কাছে ক্ষমা প্রার্থনার সাথে সাথে শালীন আমোদ-ফুর্তি, সাজ-সজ্জা, খাওয়া-দাওয়া করা হবে। এতে একদিকে আল্লাহর নির্দেশ মান্য করে তাঁর খাটি গোলাম হওয়ার যেমন সুযোগ রয়েছে তেমনি রয়েছে আনন্দ ফুর্তিও।
ঈদের তাৎপর্য
ইতিপূর্বে আলোচিত আনাস রাদি আল্লাহ বর্ণিত হাদীস থেকে ঈদের ফজিলত সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পাওয়া গেছে। তা হল আল্লাহ রাব্বুল আলামিন উম্মতে মোহাম্মদীকে সম্মানিত করে তাদের এ দুটো ঈদ দান করেছেন। আর এ দুটো দিন বিশ্বে যত উৎসবের দিন ও শ্রেষ্ঠ দিন রয়েছে তার চেয়েও শ্রেষ্ঠ।
ইসলামের এ দুটো উৎসবের দিন শুধু শুধু আনন্দ-ফুর্তির দিন নয়। বরং এ দিন দুটোকে আনন্দ-উৎসব-এর সাথে সাথে জগৎসমূহের প্রতিপালকের ইবাদাত-বন্দেগি দ্বারা রঙিন করা হবে। যিনি জীবন দান করেছেন, সুন্দর আকৃতি, সুস্থ শরীর, ধন-সম্পদ, সন্তান-সন্ততি, পরিবার-পরিজন দান করেছেন। যার জন্য জীবন ও মরণ তাকে এ আনন্দের দিনে ভুলে থাকা হবে আর সব কিছু ঠিকঠাক মত চলবে এটা কীভাবে মেনে নেয়া যায়? তাই ইসলাম আনন্দ-উৎসবের এ দিনটাকে আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের ইবাদাত-বন্দেগি, তাঁর প্রতি শুকরিয়া-কৃতজ্ঞতা প্রকাশ দ্বারা সুসজ্জিত করেছে। আর উক্ত হাদীস দ্বারা বুঝা যায় যে, ঈদুল ফিতরের চেয়ে ঈদুল আযহা আরো শ্রেষ্ঠ। হাদীসে ঈদুল আযহার কথাই আগে বলা হয়েছে।
মুমিনের ঈদ
ঈদ যেমন বারবার ফিরে আসে তেমনি মুমিনের জীবনে ত্যাগ কুরবানির পরীক্ষাও বারবার ফিরে আসে। ত্যাগ কুরবানির পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়াই মুমিনের ঈদ। রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, দুনিয়াটা মুমিনের জন্য জেলখানা। জেলখানায় যেমন কয়েদির কোন স্বাধীনতা নেই তেমনি দুনিয়ার জীবনেও মুমিনের নিজস্ব কোন স্বাধীনতা নেই। মুমিন স্বাধীনতা ভোগ করবে পরকালে। তাই দুনিয়ার পরাধিনতার মধ্যেই রয়েছে মুমিনের সুখ। মুমিন নিজের নফসকে প্রভুর নির্দেশের গোলাম বানিয়ে নেয়, নিজে কখনো নফসের গোলাম হয় না।
ইতিহাস সাক্ষি, পৃথিবীর সকল মহৎ ব্যক্তিই ত্যাগ কুরবানিকে নিজেদের পাওনা ও পরিতৃপ্তির বিষয় হিসেবে গ্রহণ করে নিয়েছিলেন। আল্লাহর খুশিতে তাঁরা ছিলেন খুশি, আল্লাহর অখুশিতে তাঁরা ছিলেন অখুশি। আল্লাহকে খুশি করতে গিয়ে দুনিয়ায় হাজার যুলুম, নির্যাতনকে তাঁরা হাসি মুখে গ্রহণ করে নিয়েছেন তবুও মাথা নত করেননি বাতিলের সামনে। সুমাইয়া, আম্মার ইবনে ইয়াসার, বেলাল, খাব্বাব রাদি আল্লাহু তাঁর উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
খাদিজা, আয়েশা, আবূবকর, উমার, উসমান, আলী, আবু হুরায়রা রাদি আল্লাহু সর্বস্ব বিলিয়ে দিয়েছেন কেবল আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সন্তুষ্টির ঈদ করতে গিয়ে। ইসলামের খিদমাতে ইমাম আবু হানিফা, শাফেয়ী, মালেক, আহমাদ ইবনে হাম্বল, ইমাম বুখারী ও মুসলিম ছিলেন পাগল পারা। সায়্যেদ কুতুব, ইমাম গাজালি, শাহজালাল, শাহপরান, শাহ মাখদুমও তাঁদেরই পথের অনুসারী।
তাদের পথ ধরে আজও যারা কালিমার পতাকা উড্ডীন করার প্রচেষ্টায় জীবন বিলিয়ে দিয়ে যাচ্ছেন, জীবন-যৌবন সব কিছু দেয়ার পরেও প্রতিহিংসার জালে আটকা পড়ে ঈদ করছেন কারাগারে, তারাও রয়েছেন মুমিনদের তালিকায়। এভাবে যুগ যুগ ধরে যারাই আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি অর্জন করে আনন্দ পেতে চাইবে তাদের সবাইকে ত্যাগ ও কুরবানির পরীক্ষা দিতে হবে। আর এ ধরনের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার আনন্দই তাদের ঈদ।
ইবরাহীম আ. ঈদ করেছেন পুত্রকে জবাই করে
আত্মত্যাগের মহান নায়ক ইবরাহীম আলাইহিস সালাম ঈদ করেছেন প্রাণের প্রিয় একমাত্র পুত্র ইসমাঈল আলাইহিস সালামকে কুরবানি করার মাধ্যমে। তাঁর কাছে পুত্রের সম্পর্ক বড় ছিল না, ছিল প্রভুর নির্দেশ পালন করাটাই বড়। তাই তিনি কুন্ঠাবোধ করেননি পিতা হয়ে পুত্রের গলায় ছুরি চালাতে। পুত্রও ছিল আল্লাহর প্রেমের মহান আশিক। ফলে পিতার সিদ্ধান্তে দ্বিমত পোষণ করেনি সে। বিলিয়ে দিয়েছে নিজের জীবনটাকে আল্লাহর পথে অকুন্ঠচিত্তে। তাঁদের এ মহান ত্যাগ শুধু ইতিহাসের পাতায়ই লেখা হয়নি, লেখা হয়েছে অপরিবর্তনীয় মহাগ্রন্থ আলকুরআনেও। জীবন্ত কুরআন আজো তা সাক্ষ্য দিচ্ছে।
দাম্পত্য জীবনের শুরুতে ইবরাহীম আলাইহিস সালাম এর কোন সন্তানাদি ছিল না। তিনি আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করে বলেছেন, ‘হে আমার রব, আমাকে সৎকর্মশীল সন্তান দান করুন’। (সূরা-৩৭. আস্সফ্ফাত : ১০০)। আল্লাহ তায়ালা তাঁর দোয়া কবুর করেন। দোয়ার জবাবে বলেন, ‘অতঃপর তাকে আমি পরম ধৈর্যশীল একজন পুত্র সন্তানের সুসংবাদ দিলাম’। (সূরা-৩৭. আস্সফ্ফাত : ১০১) ইবরাহীম আলাইহিস সালাম এর বয়স যখন প্রায় ৮০ বছর তখন পুত্র হিসেবে ইসমাঈল আলাইহিস সালাম জন্ম গ্রহণ করে। এর পর ইসমাঈল আলাইহিস সালাম যখন চলাচল করার মতো অবস্থায় পৌঁছলো তখন শুরু হলো এক কঠিন পরীক্ষা। আল্লাহ তাকে কুরবানি করার জন্য পিতাকে স্বপ্নে নির্দেশ দিলেন। পিতা তাঁর রবের নির্দেশ পালনের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করলো। এ ব্যাপারে ছেলের সাথেও পরামর্শ করল। আল্লাহর নির্দেশ পালনে ছেলেও রাজি হলো। উভয়ের সিদ্ধান্তের কথা আল্লাহ তায়ালা আলকুরআনে প্রকাশ করেছেন। কুরআন বলছে, ‘অতঃপর যখন সে তার সাথে চলাফেরা করার বয়সে পৌঁছল, তখন সে বলল, ‘হে প্রিয় বৎস, আমি স্বপ্নে দেখেছি যে, আমি তোমাকে জবেহ করছি, অতএব দেখ তোমার কী অভিমত’; সে বলল, ‘হে আমার পিতা, আপনাকে যা আদেশ করা হয়েছে, আপনি তাই করুন। আমাকে ইনশাআল্লাহ আপনি অবশ্যই ধৈর্যশীলদের অন্তর্ভুক্ত পাবেন’। (সূরা-৩৭. আস্সফ্ফাত : ১০২) এরপর ইবরাহীম আলাইহিস সালাম নিজ সন্তানকে কুরবানি করে আল্লাহর সন্তুষ্টির ঈদ উদযাপন করেন। যেমন কুরআনে বলা হয়েছে, ‘অতঃপর তাঁরা উভয়ে যখন আত্মসমর্পণ করল এবং সে তাকে (ইসমাঈলকে ) কাত করে শুইয়ে দিল। তখন আমি তাকে আহ্বান করে বললাম, ‘হে ইবরাহীম, ‘তুমি তো স্বপ্নকে সত্যে পরিণত করেছ। নিশ্চয় আমি এভাবেই সৎকর্মশীলদের পুরস্কৃত করে থাকি’। ‘নিশ্চয় এটা সুস্পষ্ট পরীক্ষা’। আর আমি এক মহান জবেহের (একটি জান্নাতী দুম্বার) বিনিময়ে তাঁকে মুক্ত করলাম। আর তাঁর জন্য আমি পরবর্তীদের মধ্যে সুখ্যাতি রেখে দিয়েছি। ইবরাহীমের প্রতি সালাম। এভাবেই আমি সৎকর্মশীলদের পুরস্কৃত করে থাকি। নিশ্চয় সে আমার মুমিন বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত। (সূরা-৩৭. আস্সফ্ফাত : ১০৩-১১১)
তাঁরা ঈদ করেছেন ঈদের দাবির আলোকে। আর আমরা ঈদ করি আমাদের নফসের খায়েসে। যে ঈদ ইবরাহীম আলাইহিস সালামকে করেছিল ধন্য, সে ঈদ কি আমরা আজো উদযাপন করতে পেরেছি?
ঈদের দিনের আমল
যা অতীত হয়ে গেছে তা বাদ দিয়ে আজ থেকে আবার আমাদের নতুন করে শপথ নিয়ে আমলী জীবন যাপন শুরু করা দরকার। আমাদের এবারের ঈদ যেন না হয় আগের মতো ময়লা আবর্জনার আচরণে ভরপুর। যদি আমরা এবারের ঈদ থেকে ভাল কাজ করা শুরু করতে পারি তাহলে জীবনের মোড় এখনো ঘুরিয়ে দেয়া সম্ভব। তাই ঈদের দিন প্রত্যেকের কর্তব্য হবে ঈদের সলাতে আগ্রহ সহকারে অংশ গ্রহণ করা, মনোযোগ দিয়ে খুতবা শোনা এবং ঈদের প্রচলনের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করা, সম্ভব হলে পায়ে হেঁটে ঈদ গাহে যাওয়া, কুরবানির পশু জবাই করে তা দিয়ে আহার করা।
মনে রাখতে হবে ঈদের দিনটা আল্লাহ তায়ালার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ ও সৎ-কাজ করার দিন। এ দিনটা যেন গান-বাজনা, মদ্য-পান, অশালীন বিনোদন প্রভৃতি পাপাচারের দিনে পরিণত না করা হয়। কেননা অনেক সময় এ সকল কাজ-কর্ম নেক আমল বরবাদ হওয়ার কারণে পরিণত হয়। খেয়াল রাখতে হবে, এ ঈদে আমাদের আমল থেকে যেন বাদ না যায় সলাত আদায় করা, গোসল করা, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা অর্জন, সুগন্ধি ব্যবহার, তাকবীর দেয়া, গরীব-দুখীর খবর নেয়া, তাদেরকে সাহায্য সহযোগিতা করা, সবার সাথে ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় করা, আত্মীয়-স্বজনদের খোঁজ খবর নেয়া ও তাদের বাড়িতে বেড়াতে যাওয়া, হাদিয়া দেয়া, সামর্থ থাকলে কুরবানি দেয়া, যারা কুরবানি দিতে পারেনি তাদের জন্য গোস্ত পাঠান ইত্যাদি।
আত্মত্যাগের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত ঈদুল আযহা
নিখুঁতভাবে তাকালে আমরা দেখতে পাবো যে, জীবনের প্রতিটি মুহূর্তই আমরা নিজের জন্য বা কারো না কারো জন্য কুরবানি দিয়ে যাচ্ছি। জীবনের বেশির ভাগকেই হয়তো নিজের জন্য দিচ্ছি মনে করে কুরবানি করছি। কিন্তু তাতে নিজের জন্য খুব কম অংশই থাকে, কেননা মৃত্যুর পরপরই যাবতীয় জিনিসগুলো অন্যের হয়ে যায়। তাই নিজের জন্য যা কিছু সঞ্চয় করা হয়, সেসবেরও খুব সামান্যই নিজের হয়ে থাকে। এর বাইরে মাতা-পিতা, স্ত্রী-সন্তান, ভাই-বোন, আত্মীয়-পরিজন, প্রতিবেশী সকলের জন্যই নানা অংশে ত্যাগ ও কুরবানি আমাদেরকে করতেই হয়। সমাজবদ্ধ যাপনে যা জীবনের মূলধারার সাথেই সম্পৃক্ত হয়ে আছে। এ সব ত্যাগ ও কুরবানির একটা বিনিময় তো মানুষ হিসেবে সবাই পৃথিবীতে প্রাপ্ত হয়, কিন্তু মুসলমানগণ এসবের দু’টো পুরস্কার পাবে। একটি পৃথিবীতে যা পাওয়ার তা, অন্যটি পাবে মুসলমান তার প্রভু আল্লাহর সন্তুষ্টি বিধানের নিয়তে যদি কোন ত্যাগ ও কুরবানি করে থাকে, তবে আখেরাতে সেসবের পরিপূর্ণ প্রতিদান। অবস্য মুসলমান হয়েও যদি নিয়ত বা সংকল্পে শুধুমাত্র দুনিয়ার পাওনাকে নির্দিষ্ট করে দেয়, তবে মুসলমান হওয়া সত্বেও আখেরাতে তার জন্য আর কিছু বাকি থাকবে না। সর্বোপরি এসব ত্যাগ ও কুরবানির মূখ্য উদ্দেশ্য হয় নিজ থেকে নিয়ে দুনিয়ার কেউ না কেউ।
আবার দুনিয়াবি কাজের জন্য ত্যাগ ও কুরবানির বাইরেও এমন কিছু ত্যাগ ও কুরবানি আল্লাহ মানুষের কাছ থেকে চেয়েছেন, যেসবের মূখ্য দিকটাই হয় আল্লাহ তায়ালা, অর্থাৎ শুধু মাত্র তাঁর জন্যই। যেমন ইসলামের মৌলিক ইবাদতগুলোসহ এজাতীয় অন্যান্য ওয়াজিব, সুন্নাত ও নফল ইবাদাত। নামায আদায় না করলে বাহ্যিকভাবে দুনিয়ার কারো তেমন কোন ক্ষতি হবে না, কিন্তু আদায় করলে ব্যক্তি নিজেসহ তার আশপাশের সমাজ তা দ্বারা উপকৃত হবে ইত্যাদি। তন্মধ্যে বর্তমানে আমরা পার করছি একটি মৌলিক ইবাদাত হজ্জ ও তার পাশাপাশি কুরবানির মৌসুম অর্থাৎ কুরবানির ঈদ। এ কুরবানির প্রারম্ভ ইতিহাস আমাদের সবারই কম-বেশি জানা রয়েছে। আল্লাহর আদেশে মুসলিম জাতির পিতা ইবরাহীম আলাইহিস সালাম তাঁর আপন সন্তান ইসমাইল আলাইহিস সালামকে কুরবানির জন্য প্রস্তুত হয়েছিলেন। মূলতঃ ইবরাহীম আলাইহিস সালামের জন্য এ ছিল এক কঠিন পরীক্ষা। কিন্তু তিনি এবং তার প্রাণপ্রিয় পুত্র দুজনেই কুরবানি দিতে ও হতে ছিলেন সন্তুষ্ট চিত্তে প্রস্তুত। তখন আল্লাহ তাঁর প্রতি তাঁদের এহেন আন্তরিক ও কার্যকর আনুগত্য ও আত্মসমর্পপনের বাস্তবায়ন দেখে বালক ইসমাঈলের স্থলে জান্নাত হতে ফিরিস্তার মাধ্যমে একটা দুম্বা শুইয়ে দেন; এভাবেই ইবরাহীম ও ইসমাঈল আলাইহিমুস সালাম আত্মত্যাগের এক কঠিন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন।
প্রতিবছর কুরবানির মৌসুম এলেই যতটা না রক্তের স্রোতধারা প্রবাহিত হয় কুরবানির ঈদের দিনে, এর চেয়ে বহু বহুগুণ বেশি রক্তের সাগর ভাঙ্গে ধর্ম শব্দের এলার্জিতে আক্রান্ত নাস্তিক-মুরতাদদের হৃদয়ে। সারা বছর অসংখ্য প্রাণী টুকরো টুকরো করে কেটে আগুনে চড়িয়ে-পুড়িয়ে খেতে তাদের কোন ব্যাথা লাগে না, কেবল বুকটা ভেঙ্গে যায় শুধুমাত্র মুসলমানগণ যখন তাদের পরম প্রিয় আল্লাহর জন্য ঈদুল আযহার দিনে কুরবানির পশুর গলায় ছুরি বসায়। তাদের পশুপ্রেম তাদেরকে তখন পশুত্বে পরিণত করে। তাদের হাম্বা রব আর চিৎকারে তখন পশুরাও যেন হেসে উঠে। কী অর্বাচিনের মতো তাদের এহেন আচরণ, তারা তখন পশু জবাইয়ের সময়কার ঘটনাগুলোকে যেন পশুর রক্তে নয়; তাদের নিজেদেরই প্রতিহিংসা সমৃদ্ধ বুকের রক্তে নানাভাবে রঞ্জিত করে করে অপপ্রচারের আর্তনাদে মেতে উঠে। তারা তখন এ কুরবানিতে ত্যাগ খুঁজে পায় না, পায় কেবলি কপটতা, হৃদয়ের প্রশস্ততা খুঁজে পায় না, পায় কেবলি সংকীর্ণতা। তারা তাদের সংকীর্ণ বিবেক দিয়ে মানুষের উপর মানুষের যুলম, অত্যাচার, প্রভুত্ব, খামখেয়ালিপনা, নির্যাতনের চরম সীমা নির্ণয় করতে পারে না, পারে শুধু প্রতিহিংসার আগুনে জলতে। মানুষ যখন মানুষের রক্ত দিয়ে গোসল করে তখন তাদের অন্ধ বিবেক দিশা খুঁজে পায় না, পায় না সমাধানের কোন হাতিয়ার। তখন বদির হয়ে বসে থাকাটাই নিজেদের কাজ মনে করে। এতে সহজেই বুঝা যায়, শয়তান তাদেরকে ষোলআনায়ই গ্রাস করে ফেলেছে। তারা মূলত জ্ঞান পাপি ও জীবিত অন্ধ।
যখন অন্যায়ভাবে বনি আদমের রক্ত ঝরে, তখন উল্লাস করে ইবলীস, কেননা সে ফিৎনা সৃষ্টিতে সফল হয়েছে। আর যখন আল্লাহর কোন বান্দা তাঁর জন্য কুরবানি করে রক্ত ঝরায় তখন ইবলীসের আর্তনাদ শুরু হয়ে যায়; বছর বছর কুরবানির মৌসুমে আমরা যেন মানুষরূপী ইবলীসের আর্তনাদ শুনতে পাই। যেমনটি বলেছেন আল্লাহ তায়ালাÑ “মিনাল জিন্নাতি ওয়ান্নাস” Ñঅর্থাৎ (কুমন্ত্রণা দানকারী এ শয়তান) জিন ও মানুষের মধ্য থেকে। (সূরা আন্নাস : ০৬)
কথায় কথায় আমরা বলে থাকিÑ ত্যাগেই শান্তি, ত্যাগেই মুক্তি। বাস্তবিকও তাই। দুনিয়ার কোন স্বার্থ ছাড়া অর্থ দানকারী ব্যক্তিই কেবল উপলব্ধি করতে পারেন যে, অর্থদানে হৃদয়ে কতদটা প্রশান্তি নেমে আসে। তেমনি একটি গৃহপালিত পশুকে অতিযতেœ লালন-পালন করে বড় করে একদিন আল্লাহর জন্য তার গলায় ছুরি চালানোর মধ্যে কতটা আতিœক পরিশুদ্ধি নিহিত তা কেবল নিষ্ঠাবানদের পক্ষেই উপলব্ধি করা সম্ভব। অন্যথা, ব্যক্তি সেই একই পশুটিকে কিন্তু চিরদিন ধরে রাখতে পারবে না, কখনো না কখনো সে তাকে জবাই করে খাবেই। হতে পারে তা কোন অনুষ্ঠানের ভোজে কিংবা বিক্রয় করা অর্থ খরচ করে। সেসব ক্ষেত্রে কিন্তু উল্লেখিত আত্মিক পরিশুদ্ধি হয় না বা ধর্মবিদ্ধেষীদের চিৎকার-মৎকারও শোনা যায় না। তাই সকলের উচিত তাদের নিজ নিজ ইবাদাতগুলোকে নিষ্ঠার সাথে পালন করা, অপরের অধিকারের প্রতি যতœবান হওয়া এবং জিন শয়তান ও মানুষ শয়তানের কুমন্ত্রণা থেকে আল্লাহ তায়ালার নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করা। ইবরাহীম ও ইসমাঈল আলাইহিস সালাম ত্যাগের যে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন তা আমাদের মাঝে প্রস্ফুটিত করা। তবেই সত্যিকারের আনন্দ ধরা দিবে এসে আমাদের কাছে আর আমরা পারবো প্রাণ ভরে ঈদের আনন্দ উদযাপন ও উপভোগ করতে। তখন আর রাস্তার দুপাশে থালা নিয়ে কেউ দাঁড়িয়ে থাকবে না, সবাই যাবে ঈদের মাঠে; একে অপরের সাথে দেখা হলে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে মিষ্টি হেসে বলে উঠবে ঈদ মুবারক ঈদ!