এক স্বপ্নবাজ তরুণ মনিরুল ইসলাম

যুগে যুগে জগতে গীত হয়েছে তরুণ এবং তারুণ্যের জয়গান।অসম্ভবকে সম্ভব করতে ঝুকি নিতে পারে তারুণ্য।চিরচেনা প্রথাকে ডিঙিয়ে সাহস,আত্নবিশ্বাস,মনোবলের অপুর্ব সমন্বয় আর সেই সাথে ম্যাজিকাল নেতৃত্ব, এমনই একজন স্বপ্নবাজ তরুন মনিরুল ইসলাম মনির।স্বপ্নকে পুঁজি করে এতদিনে তিনি উঠে এসেছেন সেরা তরুন সংগঠকদের তালিকায়।প্রায় ৫ টি সংগঠনের নেতৃত্বে আছেন সফল এই সংগঠক।সদ্যমাত্র পড়াশোনা শেষ করেছেন রাজধানীর অন্যতম বেসরকারি স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবিএ অনুষদ থেকে। বেড়ে উঠার গল্প,সংগঠনের সব কিছু নিয়ে এবারের একটি ব্যাতিক্রমধর্মী স্বাক্ষাতকার।স্বাক্ষাতকারে নিয়েছেন হাসান সাকিব
হাসান সাকিব: আপনার পরিবার ও বেড়ে উঠা?
মনির: ৪ ভাই বোন এর মধ্যে আমি তৃতীয়।বাবা ফিরোজ আহমেদ প্রবাসী ব্যাবসায়ী ও চাকুরীজীবী ,মা মনোয়ারা বেগম।আমার জন্ম এবং বেড়ে উঠা রাজবাড়ী জেলার কালুখালী উপজেলার বড়ইচারার এক প্রত্যন্ত গ্রামে।
হাসান সাকিব: আপনি বর্তমানে একজন সফল সংগঠক, আপনার জীবনের প্রথম সংগঠন নিয়ে পাঠককে কিছু বলুন,এবং কিভাবে সংগঠনে আসা?
মনির: আমি যখন স্কুলে পড়তাম,তখন দেখতাম স্কুলে অনেক সমস্যা হতো। অনেক অস্বচ্ছল ছাত্র ছাত্রীরা টাকা পয়সার অভাবে পড়াশুনা চালিয়ে নিতে পারতো না,এই ব্যাপারগুলি কেন জানি আমার মনে নাড়া দেয়।তারপর কয়েকজন স্নাতক পড়ুয়া বড় ভাইদের সাথে খোলামেলা কথা বলি,একটা সিদ্ধান্ত নেই।যেই সিদ্ধান্ত সেই কাজ।তবে সিদ্ধান্ত যদি ও খুব দ্রুত নিয়েছিলাম,তবে কাজটি করতে অনেক বাধা প্রতিবন্ধকতা এসেছিল।তারপর ও সংগঠনটি প্রতিষ্ঠা করেছিলাম “মেধাবিকাশ ছাত্র সংসদ”। আমাদের প্রতিষ্টাতা সদস্য ছিলেন ৮ জন।আমি বাদে সবাই ছিলেন স্নাতকোত্তর এ পড়ুয়া ছাত্র।বর্তমানে এটি রাজবাড়ি জেলার ঐতিহ্যবাহী একটি ছাত্র সংগঠন।আমি সাধারন সম্পাদক হিসেবে কাজ করছি।এটাই আমার প্রথম সংগঠন।
Post MIddle
হাসান সাকিব: যতদুর জানি আপনি একজন বিতার্কিক,বিতর্কে কিভাবে আসা সহ বিতর্কে করতে গিয়ে মজার কোন অভিজ্ঞতা পাঠককে শেয়ার করুন?
মনির: ছোটবেলা থেকেই বিটিভিতে জাতীয় বিতর্ক প্রতিযোগিতার অনুষ্টানগুলি নিয়মিত দেখতাম।তখন ছিল সনাতনী পদ্ধতি।৫ মিনিট যে যার মত বলে চলে যেত।এই ৫ মিনিটে দেখতাম খুব স্বল্প সময়ে সুন্দর সাবলীল ভাষার যুক্তির লড়াই আর নানা তথ্য।এই ব্যাপারগুলি আমাকে অনেক মুগ্ধ করতো।আর ঠিক তখন থেকেই বিতর্কের প্রতি ভালোলাগা শুরু।স্কুল, কলেজে বিতর্কের ক্লাব না থাকায় বাসার আয়নার সামনেই হয়েছি বিতার্কিক।এখন ও মনে আছে রাত ১২ টায় ওয়াশরুমে একা একা বিতর্ক করছিলাম, মা দরজা খুলে খুবি ভয় পেয়েছিলেন যে পাগল হয়েছি এই ভেবে।আর আয়না বিদ্যা বাদ দিয়ে বাস্তবে বিতার্কিক হওয়ার সুযোগ মিলল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর।বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ক্লাব ছিল স্টামফোর্ড ডিবেট ফোরাম। সোহান ভাইয়ের উৎসাহে ও উদ্দীপনায় ৭ম স্টামফোর্ড ফ্রেশার্স বিতর্ক প্রতিযোগীতায় অংশগ্রহণ করি।প্রায় ৩২ টি টিমকে পেছনে ফেলে আমি, বেনজির আবরার,মনিকা সেই টুর্নামেন্টে রানার্স আপ হই।রানার্স আপ হওয়ার পর এমিরেটস অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান স্যারের  হাত থেকে পুরষ্কার পাওয়ার উৎসাহ ও ছিল আমার লাইফের টার্নিং পয়েন্ট।তারপর এস ডি এফের হয়ে বিভিন্ন প্রতিযোগীতায় অংশগ্রহণ ও বিভিন্ন টুর্নামেন্টের সমন্বয়কের কাজ করে সাংগাঠনিক ভাবে উপকৃত হয়েছি।তাছাড়া ক্লাবিং করতে গিয়ে এমন কিছু বড় ভাই, ছোট ভাই, বোনদের পেয়েছি,যা স্মৃতির পাতায় আজীবন বেচে থাকবে
হাসান সাকিব: আপনার নিজের গড়া সংগঠন “বন্ধুনীড়” বর্তমান সময়ে সবচেয়ে পরিচিত পাওয়া একটি সামাজিক সংগঠন।”বন্ধুনীড় ” সম্পর্কে কিছু বলেন?
মনির: সমাজের অবহেলিত,ছিন্নমূল, সুবিধাবঞ্চিত মানুষদের কষ্ট, দুর্ভোগ ছোট বেলা থেকেই আমার কেন জানি সহ্য হত না। বন্ধু আবরার ( বেনজির আবরার) দুজনে একদিন মালিবাগ চায়ের দোকানে বসে সে ব্যাপারে কথা বলি, অবশেষে দুজনে মিলে সিদ্ধান্ত নেই নিজ ডিপার্টমেন্ট এর ৫৪ ব্যাচের ১২ জন বন্ধুকে নিয়ে এই মহৎ উদ্যোগ শুরু করার।প্রতিষ্ঠার বছর আমরা চেষ্টা করেছি রোজার মধ্যে পরপর ৩ দিন প্রায় ৫০ জন পথ শিশুদের সংগে টিম ” বন্ধুনীড়” এর ইফতারি আয়োজন করার,একই বছরে মান্ডা,কমলাপুর,যাত্রাবাড়ী তে অসহায় মানুষদের মাঝে কম্বল বিতরণ করা হয়।২১ শে ফেব্রুয়ারি, ২৬ শে মার্চ, ১৬ ই ডিসেম্বর বিভিন্ন এতিমখানা ও পথশিশুদের দুপুরের খাবারের আয়োজন করা হয় এবং ” বন্ধুনীড়ের” প্রত্যেক সদস্যগন সেই দিন তাদের সাথে গল্প আড্ডার ছলে এই বিশেষ দিনগুলির গুরুত্ব ও তাৎপর্য তুলে ধরেন।গত বছর আমাদের সংগঠনটি কচুয়াতে প্রায় ২০০ মানুষকে কম্বল বিতরণ করে এবং প্রায় ৪০০ মানুষকে বিনামুল্যে চিকিৎসা সেবা দিয়েছে।একই বছর ৯০ পরিবারকে ঈদের নতুন কাপড় দেয়ার চেষ্টা করেছি।এর মধ্যে যে অদ্ভুত ভাললাগা কাজ করে সেটাই অনুভব করেছি।তাছাড়া ৫৫০ জনকে কখনো  নিজেদের সদস্য রক্ত দিয়েছে কখনো বা রক্ত ম্যানেজ করে দেয়া হয়েছে।এ বছর বন্যাদুর্গত এলাকার মানুষদের জন্য টিম ” বন্ধুনীড়” সহ প্রায় ৪ টি সংগঠন নগদ ২ লক্ষ টাকা উঠিয়েছে তাছাড়া ৪০০ পরিবারকে ৭ দিনের খাবার তুলে দেয়া হয়েছে।আমাদের সাধ আছে সাধ্য নেই।যতটুকু পেরেছি কাজ করেছি,আরো কাজ করতে চাই এই অসহায় মানুষদের মুখে দুষ্প্রাপ্য হাসি ফোটাতে।বর্তমানে সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হিসেবে আছি।
হাসান সাকিব: দেশের একমাত্র বিশ্ববিদ্যালয় ভিত্তিক সংগঠন ” স্টামফোর্ড মাদকবিরোধী ফোরামের”প্রতিষ্ঠাতা ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে আছেন,সংক্ষেপে বলুন পাঠকদের।
মনির: আমরা সকলেই জানি এই সময়টাকে বলা হয় তরুণদের স্বর্ণযুগ। তারুন্যের চেতনায় বিশ্বাসী তরুণদের মাদকের ভয়াবহ থাবা থেকে ফিরিয়ে আনতে এবং তাদের মধ্যে মাদকের বিরুদ্ধে জনসচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষেই “স্টামফোর্ড মাদকবিরোধী ফোরাম” প্রতিষ্ঠার চিন্তাভাবনা শুরু হয়।অবশেষে বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি বোর্ডের অন্যতম সদস্য ও মাইক্রোবায়োলজি ডিপার্টমেন্টের এসিস্ট্যান্ট প্রফেসর ড.ফারহানাজ ফিরোজ ম্যামের চেষ্টায় আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্ট মহোদয় প্রফেসর ড.এম এ হান্নান ফিরোজ স্যারের অনুমোদনে ১০১ সদস্য বিশিষ্ট একটি কমিটি পেয়ে যাই।বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৫ টি ক্লাবের সেরা ক্লাবিয়ানদের সমন্বয়ে এই ক্লাবটির কমিটি হওয়াতে আমাদের বিভিন্ন কার্যক্রম ইতিমধ্যে বেশ সফলতার ছোঁয়া পেয়েছে।বর্তমানে ক্লাবটির চীফ -কো অর্ডিনেটর হিসেবে আছেন ড.ফারহানাজ ফিরোজ ম্যাম,প্রেসিডেন্ট হিসেবে আছেন রাখিল খন্দকার নিশান,সাধারন সম্পাদক হিসেবে আছেন বেনজির আবরার।
হাসান সাকিব: বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন সংগঠনের হয়ে বিভিন্ন রেডিও, টেলিভিশনে আপনাকে দেখা যায়,তখন আসলে কেমন অনুভুতি লাগে?
মনির:দেখুন, ব্যাক্তিগত পর্যায় থেকে একটি প্রতিষ্ঠানের হয়ে কাজ করা যেমন গৌরবের তেমনি উৎকন্ঠার।উৎকন্ঠার বললাম এই কারনে ব্যাক্তিগত কাজে তেমন জবাবদিহি থাকে না,কিন্তু সেটা যখন একটি প্রতিষ্ঠানের হয়ে কাজ করি তখন জবাবদিহিতার ব্যাপার এমনিতেই চলে আসে।বিভিন্ন সময় সংগঠনের হয়ে বিভিন্ন টিভি,রেডিও শোতে গিয়েছি।এস এ টিভির জনপ্রিয় শো “ইয়ুথ ভয়েস” ” ঈদ আড্ডা”  ” ফার্স্ট ডেট” রেডিও টুডের ” Afternoon Cafe” এবং কিছুদিন আগে বন্ধুনীড়ের হয়ে এটি এন নিউজের জনপ্রিয় টক শো ” YOUNG NITE” এ অংশগ্রহণ করাটা নি:সন্ধেহে ভাল লাগার ব্যাপার।
হাসান সাকিব: ভবিষ্যত নিয়ে পরিকল্পনা?
মনির:  আমার স্বপ্ন নিজ গড়া সংগঠন ” বন্ধুনীড়” দেশের ৬৪ টি জেলায় থাকবে।প্রতিটি জেলার অসহায়, দুস্থ, ছিন্নমূল মানুষগুলির মুখে হাসি ফুটবে,এটাই আমার স্বপ্ন।তবে ব্যাক্তিগত স্বপ্ন হিসেবে যদি বলি তাহলে বলব নিউজ প্রেজেন্টার কিংবা রেডিও আরজে হওয়ার প্রবল ইচ্ছা আছে।স্বপ্ন দেখি CIP হওয়ার ( কমার্শিয়াল ইম্পরট্যান্ট পার্সন) অবশেষে বলতে চাই স্বপ্নের চেয়ে ও বড় হতে চাই, অনেক বড়।
হাসান সাকিব: তরুনদের উদ্দেশ্যে কিছু বলুন।
মনির: দেখুন,আমি নিজে ও একজন তরুণ।চারদিকে তরুনদের জয়জয়কার। আগের মত পিছিয়ে নেই তরুণরা।তারা নিজেদের নিয়ে ভাবছে,নিজেদের কে চিরচেনা গন্ডি থেকে বের করে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্যের প্রমান দিয়েছে ইতিমধ্যে।তরুণদের উদ্দেশ্যে একটি কথাই বলব পাঠ্যপুস্তকের গন্ডি থেকে নিজেকে বের করে এক্সট্রা কারিকুলাম একটিভিজে নিজেকে সক্রিয় রাখা উচিত।শিক্ষা জীবন সমাপ্তির পর সার্টিফিকেট এর সাথে সিভি ভারী করার মুল হাতিয়ার হিসেবে থাকে আপনার কো কারিকুলাম একটিভিটিজ।সেটা হতে পারে বিতর্ক,হতে পারে অন্য যে কোন সামাজিক সংগঠন ।
এতে আপনার কমিনিকেশন স্কিল,সাংগঠনিক ক্ষমতা,নেতৃত্ব, দক্ষতা বেড়ে যায়।মনে রাখতে হবে হোচট খাওয়া মানেই হেরে যাওয়া নয়,নতুন ভাবে বেচে থাকতে সেই হোচট ই আপনাদের জন্য টার্নিং পয়েন্ট হিসেবে কাজে লাগবে।জিতে গেলে করার আর কিছুই থাকেনা,তবে হেরে গেলে জেতার জন্য অনেক কিছুই করার থাকে।পরিশেষে বলতে চাই,৩০ লক্ষ শহীদের বিনিময়ে পেয়েছি আমরা স্বাধীনতা,যেটি করতে ছিলনা কোন স্বার্থ,ছিল প্রচন্ড ভালবাসা,আবেগ আর দেশের প্রতি অগাধ ভালবাসা।আর সেই রক্ত দিয়ে কেনা স্বাধীনতার এক টুকরো সবুজ বাংলাদেশের জন্য কাজ করাটাই হোক সকল তরূণদের প্রধান লক্ষ।
হাসান সাকিব: আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ,এডুকেশন ২৪ কে সময় দেওয়ার জন্য।
মনির: আপনাকে ও ধন্যবাদ
পছন্দের আরো পোস্ট