সেই যে আমার নানা রঙের দিনগুলি

নিউইয়র্ক সিটির স্কুলগুলোয় গ্রীষ্মকালীন ছুটি চলছে। দু’মাসের এই দীর্ঘ ছুটিতে এখানকার মানুষগুলো সাধ এবং সাধ্য অনুযায়ী সপরিবারে ছুটে যায় দূরদূরান্তে অবকাশ যাপনে। শহুরে যান্ত্রিকতা, ব্যস্ততা আর কোলাহলের বাইরে পাহাড়, সমুদ্র, হ্রদ কিংবা গাছ-গাছালী’র ছায়া ঘেরা নির্জনতার কাছাকাছি কোথাও। প্রস্তুতি নিয়ে প্রতি সপ্তাহে সপরিবারে বন্ধুরা মিলে দলেবলে ছুটে যাই আমরাও। গত সপ্তাহে সমুদ্রতীরে দিনভর কাটিয়ে এ সপ্তাহে আবার পাহাড়ের খুব কাছে সারা দিনমান। গর্জনরত উত্তাল সমুদ্র আমায় যতোটা না টানে, তারচে য়েও বেশি টানে স্থির, নিশ্চল দাঁড়িয়ে থাকা মৌন পাহাড়।

দিনভর আমাদের সন্তান’রা সেইসব স্থানে কখনো তেড়ে আসা বিশাল ঢেউ নিয়ে খেলা করে, আনন্দে আত্নহারা হয়। কখনবা সবুজ ঘাসে ছুটোছুটি খেলে। আবার কখনো হ্রদের স্বচ্ছ পানিতে মনের আনন্দে সাঁতার কাটে। হ্রদগুলো খুব একটা গভীর নয়, এবং স্থির মিঠা পানি বলে সেখানে অনেকটা স্বাচ্ছন্দ্যে শিশুরা ডুবে যাওয়া, ভেসে উঠার খেলায় মত্ত থাকে। একটা সময় চারিপাশে বিকেলের সূর্যের তেজ কমে যাওয়া নরম আলো ছড়িয়ে পড়লে আমরা সাথে করে নিয়ে যাওয়া খাবার, পানীয় আর ফ্লাস্কের চা নিয়ে বসি। বেলা শেষের এই সময়টায় এক কাপ গরম চা’য়ে আয়েশি চুমুকে আমাদের সমস্ত দিনের ক্লান্তি উবে যায় নিমেষে।

সেদিন শেষ বিকেলে কোথাও যখন আর কোন রোদ ছিল না, সেই সময়টায় চা’য়ের কাপে এমনই আয়েশি চুমুক দিতে দিতে পাহাড়ের দিকে চোখ পড়তেই দেখি সুউচ্চ পাহাড়ের গায়ে কিছু রোদ তখনো ঝুলে আছে। অদ্ভুত সুন্দর এক দৃশ্য! নরম ঘাসের উপর খালি পায়ে হেঁটে বেড়াবার সময় মনে পড়ে, বহুদিন এমন করে হাঁটিনি ঘাসে! বহু বহু দিন! উদ্দাম বাতাসে ঘাসের বুকে বসে থাকি অনেকক্ষণ। সেখান থেকে বিশাল আকাশকে মনে হয় যেন সে আছে খুব কাছে, ছুঁয়ে দেয়া দূরত্বে। যেন বহুক্ষণের বিশ্রামে আমি, আকাশ আর পাহাড়!

ঘন হয়ে আসে সন্ধ্যার আঁধার। আমরা বন্ধুরা নিজ নিজ গাড়িতে বসি। গাড়িগুলো ছুটে চলে হাইওয়ে ধরে। রাস্তার দু’ধারে দাঁড়িয়ে থাকে প্রাচীন সব বৃক্ষ। পিছনে রেখে আসি উঁচু পাহাড়, গাঢ় অন্ধকার আর একরাশ নির্জনতা। যেন শৈশবের আমার নানুবাড়ির সেই সাঁঝবেলার সুনসান নীরবতা। যেখানে সাঁঝ না হতেই নেমে আসতো মধ্যরাতের নিস্তব্দতা। যেখানে কুপির নিভুনিভু আলো মুখের কাছে এগিয়ে এনে মুরুব্বীদের কেউ কেউ বলতো,” তুমি পালনের মাইয়া না ? মাশ্‌আল্লাহ্‌ মাশ্‌আল্লাহ।” স্কুল বন্ধের সময়টায় আমাদের অবকাশ যাপন বলতে ছিল গাঁয়ের দিকে অর্থাৎ নানাবাড়ি, দাদাবাড়ি বেড়াতে যাওয়া। সেখানে পুকুরে ডুবে ডুবে গোসল করা, পিঠা খাওয়া সহ আরো কতো হিরন্ময় স্মৃতি! সেখানে জীবন ছিল অন্যরকম। জীবনের সময়গুলো কতো দ্রুত ফুরিয়ে যায়!

Post MIddle

Rimee Rummanসারাদিন ছুটোছুটির ক্লান্তিতে গাড়ির পেছনের সিটে বসা রিয়াসাত, রিহান গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। সামনে আমরা দু’জন। বাড়ির দিকে ফিরছি। গাঢ় অন্ধকার পেড়িয়ে এসেছি ইট পাথরের ঝলমলে যান্ত্রিক নগরীতে। মনের গহীন কোণে তখনো আঁধার। দূরের কোন নক্ষত্রের মতো অস্পষ্ট একটি মুখ ভেসে বেড়ায় চোখের তারায়। বুকের ভেতরে প্রতিটি হৃদস্পন্দনে উচ্চারিত হয় একটি নাম __ তুমি “পালন” এর মাইয়া না ? গাড়িতে গান বাজছে,

সবাই বলে ওই আকাশে লুকিয়ে আছে খুঁজে নাও
ও তোতা পাখি রে, শিকল খুলে উড়িয়ে দেবো
মা’কে যদি এনে দাও
আমার মা’কে যদি এনে দাও…

ভালো থাকুন সকলে।

রিমি রুম্মান।নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র

পছন্দের আরো পোস্ট