সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তিতে আগ্রহ কম কেন?

সারাদেশে প্রায় ৬৪ হাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থাকলেও প্রশিক্ষিত শিক্ষক আর নানা সমস্যায় জর্জরিত থাকায় প্রতিনিয়ত বিদ্যালয়গুলোতে সন্তান ভর্তিতে আগ্রহ কমছে অভিভাবকদের। সংশ্লিষ্টরা সমস্যা থাকার কথা অস্বীকার করলেও শিক্ষাবিদদের মতে, এখনই এই অবস্থার উত্তরণ ঘটানো না গেলে এক সময় শিক্ষার্থী সংকটে পড়তে হবে। এমনকি একপর্যায়ে বিদ্যালয়গুলো বন্ধ করার প্রয়োজন হতে পারে বলেও আশঙ্কা করছেন তারা।

বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউটে বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা হিসেবে চাকরি করছেন সাব্বির হোসাইন। সামনের বছরই সন্তানকে স্কুলে ভর্তি করবেন বলে ভাবছেন। কিন্তু সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নিজের বাচ্চাকে ভর্তি করবেন না বলে এরই মধ্যে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।

সন্তানকে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কেন ভর্তি করবেন না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘সরকারি বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা তেমন প্রশিক্ষিত নন। এতে করে এই শিক্ষকদের পাঠদানে শিক্ষার্থীদের বেসিক ভালোভাবে গড়ে ওঠে না যার ফলে ভুগতে হয় ভবিষ্যতে।’

এছাড়া স্কুলগুলো অবকাঠামোগত দিক থেকে ততোটা উন্নত নয় বলে দাবি তার।’সরকারি বিদ্যালয়গুলোতে এখন যেসব শিক্ষার্থী ভর্তি হচ্ছে তাদের বেশিরভাগই নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তান এবং তাদের সঙ্গে মেলামেশা করলে সন্তানের ভিন্নপথে যাওয়ারও সুযোগ থাকে’ আশঙ্কা করে বলেন সাব্বির।

একই অভিযোগ রয়েছে নাসিমা সুলতানা নামের এক অভিভাবকের। সঙ্গে রয়েছে স্কুলের শ্রেণিকক্ষ ও পাঠদান পদ্ধতি নিয়ে অভিযোগ। তিনিও সন্তানকে ভর্তি করিয়েছেন একটি বেসরকারি বিদ্যালয়ে।

অভিভাবকদের এসব অভিযোগগুলোর সঙ্গে মিল রয়েছে ডেমোক্রেসিওয়াচের এক কেস স্টাডির। ওই স্টাডিতে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বেশকিছু সমস্যা উঠে এসেছে। এগুলো হচ্ছে- স্কুলগুলো অনেক দূরে দূরে অবস্থিত যা অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের যাতায়াতের জন্য কষ্টকর, স্কুলগুলোতে নেই যথেষ্ট শিক্ষা উপকরণ, শিক্ষকদের মধ্যে যথেষ্ট প্রশিক্ষণের অভাব রয়েছে।

ওই স্টাডিতে পাওয়া অন্যান্য সমস্যাগুলো হচ্ছে- স্কুলগুলোতে নেই যথেষ্ট আসবাবপত্র, পাঠদানের পাশাপাশি অন্যান্য সুযোগ সুবিধার ঘাটতি রয়েছে, শ্রেণিকক্ষগুলো তেমন আকর্ষণীয় নয় এবং স্কুলগুলো সম্পর্কে মানুষ তেমন একটা অবহিতও নন।

এক সময়ে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে প্রচুর শিক্ষার্থী ভর্তি হলেও ১৯৮০ সালের পর থেকে হঠাৎ করেই কমতে শুরু করে শিক্ষার্থী সংখ্যা। এর কারণ হিসেবে দাবি করা হয় দেশে কিন্ডার গার্ডেন প্রতিষ্ঠা পাওয়া।

সরকারি বিদ্যালয়গুলো যেখানে শিক্ষার্থীদের বিনামূল্যে বই বিতরণ করছে সেখানে উচ্চ বেতন নিলেও ক্রমেই বাড়ছে এগুলোতে অভিভাবকদের আকর্ষণ।

Post MIddle

এদিকে এসব অভিযোগ ও ডেমোক্রেসিওয়াচের কেস স্টাডিতে পাওয়া সমস্যাগুলোর কিছুই নেই বলে দাবি করছেন ঢাকা জেলার শিক্ষা কর্মকর্তা শাহীন আরা বেগম।

তিনি বলেন, ‘সারাদেশে বর্তমানে প্রায় ৬৪ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং শুধু রাজধানীতে ৯৫১টি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। এগুলোতে কোনো সমস্যা নেই এবং প্রচুর শিক্ষার্থী এসব বিদ্যালয়ে ভর্তি হচ্ছেন। শিক্ষকরাও যথেষ্ট প্রশিক্ষিত এবং বিদ্যালয়গুলোতে আধুনিক সুযোগ-সুবিধা যোগ করা হচ্ছে।’

দয়াগঞ্জ বাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়সহ রাজধানীর অনেক বিদ্যালয়েই শিক্ষার্থী সংখ্যা তিন শতাধিকের কম এমন পরিসংখ্যান তুলে ধরলে তিনি বলেন, ‘যেসব বিদ্যালয় ছোট সেগুলোতে শিক্ষার্থী সংখ্যা স্বাভাবিকভাবেই কম। বেশিরভাগ বিদ্যালয়েই হাজারের ওপরে শিক্ষার্থী রয়েছে এবং সরকারি বিদ্যালয়গুলোতে আগের চাইতে ভরসা অনেকটাই বেড়েছে।’

তবে তার এ মতের সঙ্গে পুরোপুরি দ্বিমত পোষণ করেছেন শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ড. মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী।

তিনি বলেন, ‘বিশ্বের কোনো দেশেই উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়া যেত না। আমাদের দেশে আগে তো মাধ্যমিক পাস করলেই শিক্ষক হওয়া যেত এমনকি এখনও উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে শিক্ষক হওয়ার সুযোগ রয়েছে মেয়েদের জন্য। এরফলে শিক্ষার মান দিন দিন খারাপ হচ্ছে এবং অভিভাবকরাও ভিন্ন দিকে ঝুঁকছেন।’

প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর সমস্যার কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেন, শিক্ষকরা যেমন কম প্রশিক্ষিত তেমন তাদের বেতনও দেওয়া হয় কম। এজন্য তাদের নিজের এলাকাতেই নিয়োগ দেওয়া হয় এবং এই সুযোগে তারা ক্লাস নেওয়া বাদ দিয়ে নিজের ব্যক্তিগত কাজেই বেশি ব্যস্ত থাকেন।

‘শিক্ষকরা অযোগ্য ও অদক্ষ হওয়ায় এই বিদ্যালয়গুলো থেকে যারা পাস করেন তাদের ভিত ততোটা শক্ত থাকে না যার ফলে পরবর্তীতে ভুগতে হয় এসব শিক্ষার্থীদের’ যোগ করেন মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী।

উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তাদের সহায়তায় শিক্ষকরা অনেক সময়ই ফাঁকিবাজি করে চলতে পারেন বলে মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর এই অবস্থা থেকে এখনই উত্তরণ ঘটাতে হবে সরকারকে। আর এটা সম্ভব না হলে এক সময়ে শিক্ষার্থী সংকট হবে এসব বিদ্যালয়ে এবং এরফলে স্কুল বন্ধ করে দেওয়ার মতো পরিস্থিতিও ঘটতে পারে।’

সকল অব্যবস্থাপনা ও সরকারি কর্মকর্তাদের অদায়িত্বশীলতা দূর করা গেলে বিদ্যালয়গুলোর এ অবস্থা থেকে উত্তরণ ঘটানো সম্ভব বলে মনে করেন মমতাজউদ্দীন।

সুত্র:প্রিয়.কম

পছন্দের আরো পোস্ট