লেখক হওয়ার পূর্বশর্ত একজন নিরহংকারী মানুষ হওয়া

একজন মডেলের মূলধন তার রূপ। তা দিয়েই তিনি দিব্যি চলে যেতে পারবেন মিডিয়ার চাহিদায় তার সময়ের সুবর্ণ দিনগুলো।একজন অভিনেত্রীর মূলধন তার অভিনয় দক্ষতা। এই দক্ষতা দিয়ে কৃষ্ণবর্ণ রং নিয়েও তিনি অনায়াসে কাটিয়ে দিতে পারবেন স্বর্ণালি দুই-একটা যুগ।

স্বর্ণকারের মূলধন তার কৌশল। মানুষের আবিষ্কৃত প্রাচীনতম মৌলকে তিনি বিশুদ্ধকরণের মাধ্যমে কৌশল জানার গুণেই করতে পারেন খাদহীন ঝলমলে সোনা।

একজন কামারের মূলধন তার কর্ম জানা। কামারশালায় হাপড় দিয়ে কয়লার আগুনকে উসকে রাখেন তিনি। তারপর আগুনে লোহা গরম করে তা পিটিয়ে তৈরি করতে পারেন দা-বটি-খন্তা-কুড়াল। এমনকি মানুষ খুন করার ছুরি, তলোয়ার, কিরিচও।

একজন রাজনীতিবিদের মূলধন তার নীতি। নতুন কোনো রাজনীতিবিদের নীতির নিয়তই বলে দেবে তিনি ন্যায়পরায়ণ হবেন, নাকি হবেন নৈতিকতাহীন।

ডাক্তারের মূলধন তার পঠিত ও অর্জিত জ্ঞান। অর্জিত জ্ঞান দিয়েই তিনি ভয়ানক মুহূর্তে বাঁচিয়ে তুলতে পারেন খাদে পড়ে যাওয়া বাসের মুমূর্ষু সব প্রাণ।

সংবাদকর্মীর মূলধন সততা ও নির্ভীকতা। সত্যের হাত ধরে তিনি মিথ্যার বেসাতিকে জনসম্মুখে এনে প্রকাশ্যেই চপেটাঘাত করতে পারেন। আই সেল বি ক্রুয়েল অনলি টু বি কাইন্ড তার কলমে এই নীতি থাকলে তিনি বারবার না মরে একবারই মরেন!

একজন শিক্ষকের মূলধন তার জ্ঞানের সঠিক চর্চা করার মানসিকতা। তা দিয়ে তিনি একাই বানাতে পারেন কয়েক শ সত্যিকারের মানুষ।

একজন চালকের মূলধন তার চালিকাশক্তি। গন্তব্যে পৌঁছানোর লক্ষ্যে এই চালিকাশক্তিই তাকে পৌঁছে দিতে পারে রোজ হাজারটা ঠিকানায়।

Post MIddle

একজন লেখকের?

একজন লেখকের অবধারিত গুণ হলো নিরহংকারী থাকা।

ব্যক্তিত্ব, বিনয় ও আত্ম-অহংকারের তফাৎ জানা। আগ্রহী ও সবার কথা শোনার মানসিকতা তার জন্য অপরিহার্য। অহংকারী কখনো সত্যিকারের লেখক হতে পারেন না। কখনোই না। মেধা থাকলেও না। মেধা ভর্তি কোনো অহংকারী যদি লিখতে আসেন তবে তিনি ঝরে পড়ার জন্যই আসেন। যেমন বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কয়েক শ আসনের জন্য এক লাখ ফরম বিক্রি করে। আর এই পরীক্ষা নেওয়া হয় ঝরার জন্যই, নেওয়ার জন্য নয়।

কোনো অর্থসম্পন্ন লেখক যদি নিম্নবিত্তের নুন আনতে পান্তা ফুরানোর গল্প তার ঘরের বাজার সদাই আনা ছেলেটার কাছে বসে শোনার মানসিকতা না রাখেন, তবে কীভাবে তার গল্পে তেমন চিত্র তুলে ধরবেন তিনি নিখুঁতভাবে?

তিনি যদি নাইবা বসতে পারেন প্যান্টের জড়তা কাটিয়ে, লুঙ্গি পরা ভিখারির থলেতে সারা দিনের ভিক্ষার পর কী কী সঞ্চয় আছে তা দেখার জন্য; তবে তিনি কীভাবে বুঝবেন ঠিক কত টুক হাঁটলে ওদের হাঁড়িতে ভাত ওঠে? কখন তাদের মুখে ফোটে ভাতের মাড়ের মতো লেপ্টে থাকা আনন্দ। কী করেই বা বুঝবেন ক্ষুধার্ত হলে তাদের কাছে পাতের ভাতকে মনে হয় তারাপুঞ্জের দল!

কোনো লেখক যদি সমতল থেকে উঠে আসেন, তিনি যদি সমাজের উঁচু তলার মানুষগুলোর মনের ভাব করমর্দন করতে যাওয়ার ইঙ্গিতে ধরতে পারার সাহস না রাখেন, তবে তিনি কীসের লেখক? তিনি যদি হুইস্কির বোতলের ছিপি খোলার ধরন দেখে অনুমান করতে না পারেন তবে তিনি কীভাবে লিখবেন উচ্চবিত্তের সাজানো অন্দরে সুখ আছে, কিন্তু শান্তি নেই।

আমি বলি, একজন লেখক হওয়ার পূর্বশর্ত একজন নিরহংকারী মানুষ হওয়া এবং সমাজের সর্বস্তরের মানুষের সঙ্গে কথা বলা কিংবা পারিপার্শ্বিক অবস্থা বোঝার মানসিকতা রাখা। আর সেসব আয়ত্তে রেখে যদি কেউ সত্যিকারের লেখক হয়ে ওঠেন তবে সবশেষে বিনয় ধরে রাখা তার জন্য বাধ্যতামূলক।

বিনয় বাধ্যতামূলক উল্লেখিত সব পেশায় স্ব স্ব স্থানে প্রতিষ্ঠিত হওয়া সব মানুষদের জন্য। কেননা অহংকার কিংবা ঔদ্ধত্য কিছুই দেয় না, বরং নেয়।

জাহান রিমা: শিক্ষার্থী, ভ্যালেন্সিয়া কলেজ, ফ্লোরিডা, যুক্তরাষ্ট্র।

পছন্দের আরো পোস্ট