পাঠদানে চাই বন্ধুসুলভ শিক্ষাগুরু
স্কুলে স্যারের ব্যাতের বাড়ির শাসনটা ভাল লাগে নি কারও। কলেজ জীবনে শাসনের কড়াকড়ির মানটা স্কুলের চেয়ে কিছুটা কম হলেও মধুর নয় কোনভাবেই। বাংলাদেশের পরিবেশে শিক্ষার্থীদের মতবাদটা এরকমই থাকে। কেননা শিক্ষার্থীদের মত করে পাঠদানের রেওয়াজ আজও চালু হয় নি এদেশে। শাসনের হারটাকে বাড়িয়ে দিয়ে ভালোবাসা বা স্নেহের কোমল রুপকে আড়ালে রেখে কঠিন রুপটাকে সামনে নিয়ে পাঠদানে অভ্যস্থ প্রায় সকল শিক্ষকরা। আর শিক্ষার্থীরাও চেপে যায় তাদের নিজস্বতাকে। ফলে সম্পূর্ণ মানসিক বিকাশের পথ বন্ধ হয়ে যায় তাদের, কিছুটা ব্যাঘাত ঘটে উজ্জ্বল সম্ভাবনার।
সমাজের এমন অব্যাবস্থাপনাকে বাহবা দিলেও বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে সম্পূর্ণ ভিন্ন রুপ দেখে শিক্ষার্থীরা। একজন শিক্ষার্থীর গবেষণাধর্মী শিক্ষা শুরু হয় বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে। এখানে একজন শিক্ষার্থীর জীবন গঠনে শিক্ষক শুধু নির্দেশনা দেয়া বহি মাধ্যমিক স্তরের মতো অনেক দায়িত্ব পালন করতে পারেন না। এ পর্যায়ে একজন শিক্ষকের ক্লাস নেয়ার জন্য শিক্ষার্থী যতটুক সময় অধ্যয়ন করে তার চেয়ে শিক্ষককে বেশি সময় অধ্যয়ন ও গবেষণা করতে হয়।
বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের সাথে শিক্ষকের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি হয়। গ্রাম্য ভাষায় বলা হয়, ‘বাবার পায়ের জুতা ছেলের পায়ে ফিট হলে তখন বাবা ছেলের মধ্যে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে।’ ঠিক তেমনিভাবে একজন শিক্ষক যখন শুধু দিকনির্দেশনা দিয়ে একজন শিক্ষার্থীর ওপর শিক্ষা অর্জনের বাকি দায়িত্ব চাপিয়ে দিতে পারেন তখন শিক্ষক শিক্ষার্থীর মধ্যেও আদেশের সম্পর্ক নয় বরং পরামর্শকের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। গোটা ছাত্রজীবনে সম্ভবত বিশ্ববিদ্যালয়ের গন্ডিটাই সবচেয়ে আনন্দের এবং উপভোগ্য।
এখানে শিক্ষার্থী যেমন উন্মুক্ত পরিবেশে সামাজিকভাবে জ্ঞান অর্জনের সুযোগ পায় তেমনি শিক্ষকও উদারভাবে তার জ্ঞানের পরিধি শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রসার লাভ করাতে সক্ষম হয়। মাধ্যমিক কিংবা উচ্চমাধ্যমিক স্তরে শিক্ষার্থীদের জ্ঞান শুধু পাঠ্যপুস্তকের গন্ডিতে সীমাবন্ধ থাকলেও বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে উন্নীত হয়ে একজন শিক্ষার্থী তার সকল দায়িত্বের প্রতি সচেতন হয় এবং কিভাবে একজন সচেতন এবং সফলমানুষে পরিণত হওয়া যায় তার সিঁড়ির সন্ধান পায়। এতদিন শিক্ষার্থীদের প্রতি রাষ্ট্র দায়িত্ব পালন করেছে কিন্তু এখন রাষ্ট্রের প্রতি শিক্ষার্থীদের দায় শোধ করার সুযোগ হয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের গন্ডিতে এসে শিক্ষার্থীদের সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিকসহ সকল জ্ঞানের শাখা সমৃদ্ধ হতে শুরু করে।অন্যদিকে শিক্ষকগণ হচ্ছেন মানুষ গড়ার কারিগর। একটি জাতির উন্নতি ও অগ্রগতির পেছনে শিক্ষকদের বিরাট অবদান। আর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকগণ সে ভিত্তিটা রচনা করে দেন। সুতরাং দুনিয়ার সকল বড় মানুষই তাদের প্রথম জীবনের শিক্ষকদের কাছে ঋণী থাকেন, তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা ও সম্মান প্রদর্শন করেন। পরিণত বয়সে গিয়েও শিক্ষকের পায়ের ধুলো মাথায় নেন। কিন্তু বর্তমানে সামাজিক পরিস্থিতি এমনটাই হয়েছে যে সে কৃতজ্ঞতাবোধ, শিক্ষকের প্রতি সম্মান প্রদর্শন একেবারেই হারিয়ে যাচ্ছে। এখন প্রায়শঃই বড় বড় কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিভিন্ন দাবি আদায়ের নামে শিক্ষকদেরকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করতেও দেখা যায়। অশ্রাব্য ভাষায় গালাগালি, হুমকি, ঘণ্টার পর ঘণ্টা কার্যালয়ে তালা লাগিয়ে অবরুদ্ধ করে রাখা, ক্লাস বর্জন তো স্বাভাবিক ঘটনা। সমাজব্যবস্থার এমন অধঃপতন কেন হয়েছে এবং এর পেছনে ছাত্ররা দায়ী নাকি শিক্ষক দায়ী তা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
অথচ এক সময় সমাজে শিক্ষকের মর্যাদা ছিল সবার উপরে। ছাত্রদেরকেমানুষ করতে শিক্ষকগণ অনেক কঠোরতা করতেন কিন্তু অভিভাবগণ তাতে কোন ধরনের আপত্তি করেছেন বলে জানা যায় না। তারা বুঝতেন যে, তাদের সন্তানের মঙ্গলের জন্যই শিক্ষকদের এই আপাত কঠোরতা।
কিন্তু আজ আমাদের অবস্থা কি হয়েছে? আইন করে আমরা শ্রেণিকক্ষে বেত নেওয়া বন্ধ করেছি। ছাত্ররা শিক্ষকদের সাথে বেয়াদবি করছে। নীতি-নৈতিকতা, সততা, ওয়াদা রক্ষা, মিথ্যা না বলার মত সদগুণগুলো শিখছে না। ফলে সমাজে অপরাধীর সংখ্যা দিন দিন বেড়ে চলছে। দেখা যাচ্ছে, যে যত বেশি শিক্ষিত সে তত অসৎ। রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ড থেকে শুরু করে জাতীয় নেতৃত্বে পর্যন্ত যে যত উপরে উঠছে সে তত বেশি দুর্নীতিবাজ হচ্ছে, তত বেশি সে রাষ্ট্রের সম্পদ অবৈধভাবে ভোগ করছে। সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে অন্যায়, অবিচার প্রবেশ করে মানুষের জীবন দুর্বিসহ হয়ে উঠেছে। প্রতিনিয়ত অসৎ মানুষগুলোর কাছে সৎ মানুষগুলো ঠকছে, অপমানিত হচ্ছে।
প্রশ্ন হচ্ছে, সমাজ ও শিক্ষাব্যবস্থার এই ব্যর্থতার পেছনে এককভাবে ছাত্ররাই কি দায়ী? না, প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষাকে পণ্য বানিয়ে এবং শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণের কারণে ছাত্র-শিক্ষক উভয়ের স্বাভাবিক সম্পর্কটুকু হারিয়ে গেছে। আজকের প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রচুর অর্থ খরচ করে ছাত্র-ছাত্রীরা পড়া-লেখা করে, শিক্ষকগণও শিক্ষা দেওয়াকে অন্যান্য আর আট-দশটা পেশার ন্যায় একটি পেশা মনে করে ছাত্রদের কাছ থেকে যথা সম্ভব নানা কায়দা-কানুন করে অর্থোপার্জন করেন। ফলে উভয়ের সম্পর্ক হয়ে গেছে ক্রেতা-বিক্রেতার মত। এর পেছনে শিক্ষকদের ব্যর্থতাও কম নয়।
ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ককে নিয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে সবাই প্রথমেই বলে ওঠে সম্পর্কটা বন্ধুত্বপূর্ণ হতে হবে। সাভারের গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসী বিভাগের ৪র্থ বর্ষের শিক্ষার্থী আল আকসার সাজিদ জানান-“সম্পর্কটা বন্ধুত্বপূর্ণহতে হবে অবশ্যই। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে শিক্ষকদেরকে আমরা যেভাবে পাই সেটা অন্য কোন অবস্থানে পাই নি। তবে তাদেরকে স্বার্থহীন হতে হবে। কেননা এই পেশাটাকে মহান পেশা বলা হয় এই একটি কারণেই। বন্ধুসুলভ সম্পর্কের কথা আমরা মুখে মুখে যতই বলি না কেন বাস্তবে আমরা ঠিক ততটা পাই না। তার কারণ হিসেবে আমার মনে হয় সমস্যাটা পুরো গোটা সমাজের, আমাদের শিক্ষা ব্যাবস্থার। তাই এই সমস্যা নিরসনে এগিয়ে আসতে হবে আমাদের সকলের। জাতীয় সমস্যার মধ্যেও আমরা এই সমস্যাটাকে ফেলতে পারি।”
সাভারের গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসী বিভাগের শিক্ষক কিশানু সিকদার বলেন-“বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে এই সম্পর্কটা অনেকটা বন্ধুর মতন। কিন্তু সব স্থানে নয়। যেখানে ঠিক তাদের জ্ঞানের ভান্ডারকে সমৃদ্ধ করতে যেমনটা প্রয়োজন হয় তেমনটাই হতে হবে। বাংলাদেশের পরিবেশে তার কিছুটা ব্যাতিক্রম হলেও আমরা বলতে পারি বিশ্ববিদ্যালয় গন্ডিতে তা যথেষ্ট মধুর। প্রয়োজনে আমরাই তাদের বন্ধু, প্রয়োজনে শত্রু। শিক্ষার্থীরা অনেক সময় বুঝে উঠতে পারে না শিক্ষকরা কেন তাদের প্রতি কঠোর হয়। সে বিষয়টা বোঝানো আমাদের দায়িত্ত্ব, এখানে তাদের মানসিক অবস্থাটা আমাদেরকেই বুঝতে হবে।”
শিক্ষার অন্যতম উদ্দেশ্য মানুষকে নীতিবান জীব হিসেবে গড়ে তোলা। শিক্ষার মাধ্যমে যদি মানুষ নৈতিক না হতে পারে তবে সে মানুষের শিক্ষাগ্রহণ করে উপকার কি হবে? শিক্ষার্থীরা যদি মনে করে থাকে কয়েক দশক পূর্বে তাদের উত্তরসূরিদের শিক্ষকরা শাসন করতো তাই এখন তার প্রতিশোধ হিসেবে শিক্ষার্থীরা শিক্ষকদের শাসন করবে তবে দেশটা গোল্লায় যেতে কতক্ষণ? প্রত্যেক দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিবর্গের বিষয়গুলো নিয়ে একটু গভীরভাবে ভাবা দরকার। দিনে দিনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এবং শিক্ষা সংশ্লিষ্ট যেসব আলামত প্রকাশ পাচ্ছে তা আদৌ সুবিধার নয়। এ সকল লক্ষণ ধ্বংসে ইঙ্গিত দিচ্ছে।
শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সম্পর্ক একটা আধ্যাত্মিক সম্পর্ক। এ সম্পর্কে যদি চিড় ধরে তবে দেশের অগ্রযাত্রা থমকে দাঁড়াবে এবং ফেরাউনের সময়ের মতো জাতি মূর্খতে পরিণত হবে। শিক্ষার্থীরা যদি ডজন ডজন সার্টিফিকেটও অর্জন করে কিন্তু নৈতিকতা না শিক্ষতে পারে তবে সে শিক্ষার বিন্দুমাত্র মূল্য আছে বলে বিশ্বাস করি না। শিক্ষাক্ষেত্রের বর্তমান অবস্থা নিয়ে সকল মহলকে ভেবে দেখার আহ্বান জানাই। শিক্ষা কাঠামো কিংবা অন্য কোনও পরিবর্তনও যদি সমাধানের উপায় হয় তবে তা করতে যেন পিছপা হতে না হয়। শিক্ষা অর্জনের মাধ্যমে গড়ে উঠুক সোনার বাংলাদেশ।