ক্লাশ ভালো না লাগলেও ডিপার্টমেন্টের প্রতি ভাললাগাটা ছিলো সবসময়
ভার্সিটি জীবনে অনার্স ফাইনাল পরীক্ষা চলাকালীন একদিন ডিপার্টমেন্টের এক ম্যাডামের কাছে গিয়েছিলাম। এক উদ্ভট সমস্যা সমাধানের প্রত্যাশায়। যদিও জানতাম এই ম্যাডাম এই কথা শুনলে ঝাঁড়ি দিয়ে রুম থেকে বের করে দিবে, বৈকি কপালে অনেক কিছুই জুটতে পারে। তারপরেও আমি আশাবাদী মানুষ, তাই গিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম ঝাঁড়ি খেলে খেলাম, সম্ভবতার মান কখনো জিরো হতে পারে না।
আমরা সাথে, আমার মতোই এক বন্ধু ছিলো, দু’জনের একই অবস্থা। পরিক্ষা দিয়ে সবেমাত্র বের হয়েছি। ম্যাডামে রুমে ভদ্রভাবে সালাম দিয়ে ভিতরে ঢুকলাম। কাঁধে ব্যাগ ঝুলানো, মুখে ক্লান্তির ছাপ, শরীরে কিছুটা অজানা ভয়ে দুরুদুরু কাঁপছে। আসলে কোনোদিন তো কোনো টিচার-ম্যাডামের কাছে যাওয়া হয় নি। আর প্রয়োজনও তেমন হয় না। তাই এই অজানা ভয় কাজ করছিলো। আর ম্যাডামের আমাদের মতো স্টুডেন্টদের চেনার কথা না। সারাবছর ক্লাশ করি না, মাঝেমাঝে ক্লাশে গেলেও ব্যাকবেঞ্চে বসে ঝিমাই, না হলে চাতক পাখির মতো স্যার-ম্যাডামদের ক্লাশ শোনার চেষ্টা করি। উনারা আসলে অনেক ভালই বুঝান কিন্তু আমার মাথায় কেনো জানি এসব ঢুকে না। তাই ক্লাশে যাওয়ার আগ্রহটা থার্ড ইয়ারে উঠার পর থেকেই হারিয়ে গেছে।
আমজনতা চিন্তাও করতে পারবে না ভার্সিটি লেবেলে ফার্স্ট ইয়ার সেকেন্ড ইয়ারে ক্লাশের প্রতি কতটা সিরিয়াস ছিলাম? ক্লাশ ভালো না লাগলেও ডিপার্টমেন্টের প্রতি ভাললাগাটা ছিলো সবসময় । তাই নিয়মিত অনিয়মিত দুটো মিলেই যাওয়া হতো। ম্যাডাম আমাদের দেখেই বললেন, কিছু বলবে তোমরা? আরো সুন্দর করে বললেন, তোমরা কি এই ডিপার্টমেন্টের স্টুডেন্ট? আজন্ম গোমড়া মুখটা কিছুটা মেকি হাসি দিয়ে হাসিমুখ করে হ্যা! সূচক জবাব দিলাম। ম্যাডাম তখন কিছুতা নড়চড়ে বসলেন। কোন ইয়ারে পড়ছো তোমরা? এ প্রশ্ন শুনেই বুঝে গেলাম বাঁশঝাড় আসছে। আমতাআমতা করে জবাব দিলাম, ম্যাডাম! আমাদের অনার্স ফাইনাল পরিক্ষা চলছে। সাতটা পরিক্ষা শেষ হয়ে গেছে। ম্যাডাম তখন মাথা নাড়িয়ে বললেন, আচ্ছা! আচ্ছা ! তাহলে তো আজকে তোমাদের পরিক্ষা ছিলো আর নেক্সট পরিক্ষাটা তো আমার। আমরা একটু খুশি হয়ে জবাব দিলাম, জ্বী! ম্যাডাম! আর আমরা পরিক্ষা শেষ করেই আপনার সাথে দেখা করতে এসেছি। ম্যাডাম তখন আবার একটু নড়েচড়ে বসে বিশাল গাম্ভীর্য নিয়ে বললেন, বলো! তোমাদের কিভাবে সহযোগিতা করতে পারি? এ কথাশুনেই আমাদের মনে খুশির বন্যা শুরু হয়ে গেছে। আমরা ভেবেছি ম্যাডাম তাহলে আমাদের সাহায্য করবেন।
বন্ধু আমার কিছু বলতে চাইছিলো। ওকে থামিয়ে দিয়ে আমিই আমতাআমতা অমায়িক ভদ্রভাবে বলা শুরু করলাম। ম্যাডাম! আপনার সব ক্লাশ আমরা তেমন করতে পারি নি। তবে বেশ কয়েকটা ক্লাশ করেছি খুব ভাল লেগেছে কিন্তু পরবর্তীতে কন্টিনিউ রাখতে পারি নি। সবাই বলাবলি করছে আপনি সৃজনশীল এবং ক্লাশ লেকচার থেকে প্রশ্ন করবেন। ছয়দিন পর আপনার কোর্সের পরিক্ষা, কারো কাছে আপনার সম্পুর্ণ ক্লাশ লেকচার নেই। ম্যাডাম! আপনার ক্লাশ লেকচারগুলো আমাদের যদি একটু ফটোকপি করার সুযোগ দেন। আমাদের জন্য খুব ভালো হয়। ম্যাডাম আমার কথাশুনে মনেহয় আকাশ থেকে পড়লেন। দেখেই বুঝতে পারলাম, তার চক্ষুচড়ক গাছে। ম্যাডাম দামী চেয়ারে হেলান দেয়া থেকে সোজা হয়ে বসে, আমাদের দু’জনের দিকে করুণার দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন, আমি ক্লাশনোটগুলো তো, এই যে তোমরা টিবিলের উপর বইগুলো দেখতে পাচ্ছো( আমি দেখলাম কমপক্ষে ১০ খানা বই হবে। ইয়া ভারি ভারি। যেটা আমি অনার্স চার ইয়ার মিলেও কিনি নাই।)। এখান থেকে তৈরি করেছি। তোমরা বইতো কিনেছো, তাই না। এই লাল বইটা দেখছো,(জীবনে প্রথম দেখলাম বইটা) এটা থেকে পড়বে ? আমি না সুচক জবাব দিলাম। ম্যাডাম! বাঁশ মনেহয় আগে থেকেই রেডি করে রেখেছিলেন। খুব শান্তভাবেই বললেন, সারাবছর ক্লাশ করো নি, একটা বই কেনো নি। তাহলে তোমরা আমার কোর্সে পাশ করবে কিভাবে? ম্যাডাম আরো কিছু বলতে চাইছিলেন মনেহয় কিন্তু আমি একটু কথার মাঝে কথা ঢুকিয়ে বললাম। ম্যাডাম! এই ছয়দিন করে পড়েই, তিন ইয়ার সম্মানের সহিত পাশ হয়ে গেছে। আশাকরছি ম্যাডাম এটাও হয়ে যাবে।
বন্ধু দেখলাম পিছন থেকে খোঁচা দিলো। বুঝলাম আর কিছু বললে ঝামেলা আছে। ম্যাডাম আমাদের শেষ বাঁশটা দেওয়ার জন্য রেডি হয়েছিলেন। জিজ্ঞাসা করলেন তোমাদের জিপিএ কতো? রেজাল্ট জানার পর ম্যাডামের যতটা খুশি হওয়ার কথা কিন্তু ঠিক ততটা খুশি হতে পারলেন না। কিছুটা বাঁকাভাবেই বললেন, রেজাল্ট তো ভালোই। ম্যাডামের সাথে আরো কিছুক্ষন কথা হলো, আমার চালাক চতুর বন্ধুও ম্যাডামকে কনভিন্স করার চেষ্টা করলো কিন্তু তিনি কোনোভাবেই তার লেকচার, হ্যান্ডনোট ফটোকপি করতে দিতে রাজি হলেন না। বিভিন্ন কথায়, যুক্তিতে, ইনিয়ে বিনিয়ে আমাদের না করে দিলেন। আমরাও সুন্দরভাবে সালাম জানিয়ে ভদ্রভাবে ম্যাডামের রুম থেকে বের হয়ে আসলাম।
বাইরে বের হওয়ার পর বন্ধু আমারে কিছুক্ষন ঝাঁড়লো। বললো, তর লাইগাই তো গেলাম। আমি জানতাম আমাদের এসব দিবো না। আমরা নামে মাত্র স্টুডেন্ট এই ডিপার্টমেন্টের, হুদাই বেইজ্জতি হওয়ার দরকার আছিলো? আমার মুখে আর কথা নাই। কলার ঝুপড়িতে বসে দু’জনে সিগারেটের ধোঁয়া উড়াতে উড়াতে ভাবতে থাকি এই কোর্সের পাশ হবে কেমনে? আর এই কোর্স পাশ না হইলে অনার্স পাশ হবে কেমনে? চিন্তায়, টেনশনে কেউ কারো দিকে তাকাই না। ভাবতেছি, ম্যাডাম যদি বই থেকে প্রশ্ন করে আর এখন যদি আমরা বই কিনিও তাও লাভ হবে না। কি পড়াইছে তাও তো জানি না? ভাবলাম এতো চিন্তা করে লাভ নাই এখন। একটা পরিক্ষা দিয়া বের হইছে, মাথা ঘুরতাছে, রুমে গিয়ে আগে ঘুমাই রাতে চিন্তা করা যাবে! কি করা যায়? রুমে আসার পর ঘুম তেমন আসলো না।
সন্ধ্যার পর বন্ধুবান্ধবের কাছে দৌড়াদৌড়ি শুরু করলাম। যার কাছে যা শীটপাতি, ক্লাশ লেকচার, হ্যান্ডনোট আছে সব নিয়ে রুমে এসে পড়া শুরু করলাম। তিনদিন পড়ার পর যা বুঝলাম পড়া খুব বেশি না। একই প্রশ্ন বারবার বিভিন্ন জায়গায় দেয়া। আমার বন্ধুটারে জানাইয়া দিলাম, দোস্ত! পড়া বেশি না তিনদিনে কভার করতে পারবি। আমরাও চোখ নাক মুখ বন্ধ কইরা ছয়দিন পড়াশুনা করে পরিক্ষার হল’এ বসে গেলাম। প্রশ্ন দেখেই এবার আমাদের চক্ষুচড়ক গাছে। পঞ্চাশ মার্কসের পরিক্ষা, প্রশ্ন উল্টাইয়া পাল্টাইয়া দেখলাম সরাসরি কমন পড়ছে মাত্র পনের বিশ মার্কসের মতো, আর গুলো এন্সার করা যাবে তবে সোজাভাবে নয়, একটু বাঁকা ভাবে। হিশাব কইরা দেখলাম সম্মানের সহিত পাশ হয়ে যাবে মনেহয়। পরিক্ষার রুমের অবস্থা মোটামুটি গরম, কথাবার্তায় ম্যাডামকে সবাই একহাত দেখো নিলো। ম্যাডামের প্রিয়ভাজন নিয়মিত ক্লাশ করা ছেলেটাও দেখলাম মাথা চুলকাচ্ছে।
লেখা শুরুর আগে ভাবলাম প্রশ্ন যেমন সৃজনশীল, উত্তরও তেমন সৃজনশীল হবে। নো টেনশন। পরিক্ষার শুরু হওয়ার কিছুক্ষনের পরেই দেখলাম কোর্সের ম্যাডামের আজ আমাদের রুমে গার্ড পড়েছে। ছেলেমেয়েরা একটু কথাবার্তা বলার চেষ্টা করছে কিন্তু দেখলাম ম্যাডাম সবাইরে ঝাঁড়ি দিয়া ঠান্ডা কইরা ফালাইলো। আর ম্যাডাম বারবার গর্বের সহিত বলছেন, আমি বলেছিলাম নিয়মিত আমার ক্লাশ করতে। আমি এও বলেছিলাম গতানুগতিক প্রশ্ন হবে না। তোমার তো সবাই শীট পড়ে পাশ করতে চাও। আশাকরছি আমার কোর্সে সেটা হবে না। এমনিই প্রশ্নের অবস্থা এই, তার উপর ম্যাডামের মহামান্য তেলেজমাতি বাণী। কথাশুনে মাথার তাঁরতুর সব ছিঁড়ে যাওয়ার অবস্তা।
মাথা নীচের দিকে দিয়ে, মাথা ঘামাইয়া সৃজনশীল উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করছি, এমন সময় পাশে থেকে এসে কে যেনো জিজ্ঞাসা করলো, প্রশ্ন কেমন হয়েছে? প্রশ্নশুনে মনেহলো গরম মাথায় আবার যেনো কে বাড়ি মারলো। মাথাটা ঘুরিয়ে চশমার ফাঁক দিয়ে তাকিয়ে দেখলাম, আমার কোর্সের ম্যাডাম। আমাকে ঠিক চিনে রেখেছে। হাসিমুখ করে বললাম, ম্যাডাম প্রশ্ন একটু সৃজনশীল হলেও উত্তরগুলো প্রায় একই। স্টান্ডার্ড মানের প্রশ্ন হয়েছে ম্যাম। আমার কথাশুনে ম্যাডাম মনেহয় খুব বেশি খুশি হতে পারলেন না। আমার পাশ থেকে আমার বন্ধুটারে তুইল্লা নিয়ে সামনে বসাইলো।
বন্ধু আমার চাতক পাখির মতো একবার শুধু আমার দিকে চাইলো। মনেমনে বললাম, বন্ধু কিচ্ছু করার নাই। পরিক্ষা শেষ করার পর দেখলাম অনার্স জীবনের শেষ থিউরি পরিক্ষাটা এক্কেবারে খারাপ হয় নি। অন্তত ফেল করার চিন্তা মাথা থেকে নেমে গেছে। অনার্সের রেজাল্ট পাবলিশ হওয়ার পর দেখলাম সম্মানের সহিত সম্মান পাশ হয়ে গেছে। আর কোর্সে নাম্বার চারশত আটে কিন্তু সর্বোচ্চ গ্রেডিং নিয়েই পাশ করেছিলাম। ম্যাডামের কথাগুলো আজ কেমন জানি মনেপড়লো? ভাবছি ম্যাডাম সেদিন ওভাবে বাঁশ না দিলে কোর্সের ভয়াবহতা বুঝতে পারতাম না, আর অদম্য জেদ নিয়ে পড়তামও না। আহা! ভার্সিটির সেই সোনালী জীবন এখন ইতিহাস।