আমার স্বাধীনতা দিবস ভাবনা

নিজেকে সব সময় গর্বিত নাগরিক মনে করি এ ভেবে যে- আমি স্বাধীন দেশের নাগরিক। স্বাধীন জাতি হিসেবে নির্ভয়ে আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোভাসি গানটি গাইতে পারি, স্বাধীনভাবে পত্র-পত্রিকায় লিখে নিজের মত প্রকাশ করতে পারি, সম্মানের সঙ্গে একটা চাকরি করতে পারছি সবই মুক্তিযুদ্ধের কারণেই। আমি মুক্তিযুদ্ধ দেখিনি। কারণ আমার জন্ম হয়েছিল ’৭১-এর প্রায় এক যুগ পরে। মুক্তিযুদ্ধকে যতটুকু জানি বড়দের কাছ থেকে শুনে, বইপুস্তক পড়ে। তবে আমি দেখেছি- স্বাধীনতা বিরোধীরা গাড়িতে জাতীয় পতাকা উড়িয়ে ঘুরে বেড়িয়েছে। আমি দেখছি- অনেকে উড়ে এসে জুড়ে বসে মুক্তিযোদ্ধা সেজে সনদ নিয়ে নানা সুযোগ সুবিধা নিচ্ছেন। কৈশোর থেকে তরুণে রূপান্তরের বয়সে ইতিহাস বিকৃতির যে চিত্র দেখেছি তা বদলাতে শুরু করেছে। তরুণ প্রজন্ম প্রকৃত ইতিহাস জানতে পারছে। এটা আমাদের জাতীয় জীবনে অনেক বড় পাওনা।

স্বাধীনতার জন্যে আমরা ঋণী ত্রিশ লক্ষ শহীদদের কাছে, আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে, আর মুক্তিযুদ্ধে সময় যেসব দেশ সহযোগিতা করেছে তাদের সবার কাছে। আজ স্বাধীনতার বয়স ছিচল্লিশ। নয় মাস যুদ্ধের পর ৩০ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে আমাদের এই স্বাধীনতা। সে সময়ের মানুষরা দেশের প্রতি তাঁদের কর্তব্য পালন করে নিজেদের জীবন উৎসর্গ করে গেছেন। অথচ স্বাধীনতার ৪৬ বছর পর আজও আমরা পুরোপুরি স্বাধীনতার সঠিক মূল্যায়ন করতে ব্যর্থ। আজ যখন দেখি, আমার পাশে দাঁড়ানো মানুষটিই দাবি করে বলে- নিজামী, কামারুজ্জামান, সাকা চেীধুরী কিংবা কাদের মোল্লাদের প্রতি অবিচার করা হয়েছে, তখন মুখ লুকানোর জায়গা থাকে না। কিংবা ক্রিকেট ম্যাচে স্বীয় মাতৃভূমি প্রিয় বাংলাদেশকে তুচ্ছ করে পাকিস্থানকে নির্লজ্জের মতো সমর্থন করে।

যারা এই দেশকে জন্ম দিয়েছেন কেবল তারাই জানেন এই দেশকে পৃথিবীর আলোয় আনতে কতটা অবর্ণনীয় দূর্ভোগ তাদের পোহাতে হয়েছে, আমরা তা সঠিক ভাবে জানিনা বলেই কারণে অকারণে দেশকে ছোট করে ফেলি বিশ্বের কাছে। প্রসব বেদনায় কাতর একজন মা-ই কেবল জানেন একজন সন্তান জন্ম দিতে কতটা কষ্ট সহ্য করতে হয়। অতঃপর ভূমিষ্ট সন্তানের দিকে তাকিয়ে সব যন্ত্রণা হাসি মুখে ভুলে যান এবং সেই সন্তানকে জীবনের চেয়েও ভালোবেসে সারাজীবন আগলে রাখেন। কিন্তু আমাদের কাছে সেই কষ্টানুভূতি পৌছায়নি বলেই ছোট ছোট কারণেই আমরা তুচ্ছ তাচ্ছিলো করে ফেলি। তাইতো- রাজনীতির নামে ধ্বংসাত্মক কর্মকা-, স্বাধীনতা বিরোধী জোটের নেতিবাচক রাজনীতি, আগুন দিয়ে মানুষ পোড়ানো, গাড়িতে আগুন দেয়া, রাজনৈতিক কর্মসূচির নামে পেট্রোল বোমা মারা, তথাকথিত অবরোধ, বন্ধ ডেকে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস অচল করার চেষ্টা, ধর্মের নামে জঙ্গিবাদীদের হামলা, মানুষ হত্যা, দেশ সম্পর্কে বাইরে খারাপ বার্তা দেয়াসহ নানা কর্মকা- চালিয়ে উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করার অপচেষ্টা চলে আসছে। সম্প্রতি দেশে জঙ্গিবাদ তথা স্বাধীনতাবিরোধী চক্র প্রতিনিয়ত দেশবিরোধী কর্মকান্ডে যুক্ত হচ্ছে। একের পর এক জঙ্গী হামলা করছে। কিন্তু এদেশের শান্তিকামী জনগণ মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণ করে তা প্রতিনিয়তই প্রতিহত করে আসছে।

আমাদের শিক্ষাঙ্গন আজ শিক্ষার সুষ্ট পরিবেশে বজায় রাখতে ব্যর্থ হচ্ছে। শিক্ষক দ্বারাই আজ শিক্ষার্থীরা ধর্ষিত হচ্ছে, লাঞ্ছিত হচ্ছে, শিক্ষকরাও সমান তালে প্রকাশ্যে নানান অপরাধে নিজেদের জড়াচ্ছে। চিকিৎসকেরাও আজকাল চিকিৎসা সেবাকে মহৎ পেশা হিসেবে দেখছেন না তারাও রাজনীতিবিদ হয়ে উঠছেন। সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী, আইনজীবীদের বড় অংশই আজ দলীয় রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েছে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সাধারণ মানুষ। লাখো শহীদের রক্তে, লাখো মা-বোনের সম্ভ্রমে অর্জিত আমাদের এই প্রাণপ্রিয় মাতৃভূমিকে দুর্নীতিবাজ, ঘুষখোরেরা দেশটাকে যতই ধ্বংসের পথে নিয়ে যাক আমরা ততই এই দেশটাকে আগলে রাখতে চাই। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় এই দেশটাকে গড়তে চাই, স্বাধীনতা পূর্ণ স্বাদ সবার ঘরে ঘরে পৌছে দিতে চাই। গ্রেনেড নয়, বোমা নয়, স্ট্যান গান নয় আমাদের হাতে ন্যায় নীতি আর সততার অস্ত্র তুলে দাও। এই অস্ত্র দিয়ে দেশকে আরো একবার স্বাধীন করতে চাই।

Post MIddle

স্বাধীনতার ইতিহাস নিয়ে আমাদের দেশে এতো বেশী রাজনীতি-আমার মনে হর পৃথিবীর আর কোন দেশে এমনটা পাওয়া যায়না। বিশেষ করে জাতির জনক নিয়ে। তাদের আর সব ব্যাপারে দ্বি-মত থাকলেও এই সব জাতীয় ব্যাপারে তারা দৃঢ় প্রতিজ্ঞ । এমন কি আমাদের প্রতিবেশী দেশে তারা তাদের ইতিহাসকে এক বিন্দু বদল করেন নি , তারা সবাই মহাত্মা গান্ধী কে এক বাক্যে স্বীকার করেন, পাকিস্তানে জিন্নাহকে সবাই এক বাক্যে স্বীকার করে, ইউএসএ’তে তারা রুজভেল্ট কে সবাই এক বাক্যে স্বীকার করে , এভাবে ভিয়েত নামে হো চি মিন কে তুরস্কে কামালকে, তবে আমরা কেন পারি না? আমাদের স্বাধীনতার তুলনায় ভিয়েতনামের ইতিহাস তো একবারেই নবীন,তারা আমাদের তুলনায় একেবারে নতুন ,কিন্তু তাঁদের এগিয়ে যাওয়া আমাদের চেয়ে বহুগুণে । তাঁদের এই এগিয়ে যাওয়ার পেছনে একটাই কারণ-জাতীয় ঐক্য। যেইটা আমাদের মধ্যে নেই বললেই চলে । এই ঐক্যের অভাবেই আমরা এগিয়ে যেতে পারছিনা ,আমরা আজো বিদেশীদের তাবেদারি করি। আর বিভিন্ন রাষ্ট্র সেই অনৈক্যের সুযোগে আমাদের উপর খবরদারী করছে।

এতো কিছুর পরও আমি বিশ্বাস করি- ২০২১ সালের মধ্য বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে পৃথিবীর বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে মালয়েশিয়া যেভাবে ঘুরে দাঁড়িয়েছে, যুদ্ধবিধ্বস্ত ভিয়েতনাম ২৫ বছর যুদ্ধ করে ঘুরে দাঁড়াল, জাপান আণবিক বোমায় বিধ্বস্ত হয়েও ঘুরে দাঁড়াল, আমরাও দীর্ঘদিন পর হলেও সে পথেই হাঁটছি। বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যও এদেশের অর্থনীতির বিকাশ ক্রমবর্ধমান। মানুষের গড় আয়ু, রিজার্ভ, দক্ষতা, রেমিটেন্স, দৈনন্দিন আয় বেড়েছে। শত বাধা পেরিয়ে বাংলাদেশ দৃঢ় পায়ে এগিয়ে যাচ্ছে। বিভিন্ন সূচকে দেশের উন্নয়ন হচ্ছে। কিন্তু এটি উন্নয়ন নয়, প্রবৃদ্ধি। সমতাভিত্তিক প্রবৃদ্ধি যখন হবে, তখনই প্রকৃত উন্নয়ন হবে। এখন গণদারিদ্র্য কমেছে কিন্তু ধনবৈষম্য বাড়ছে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে নারীর পদাচারণা বৃদ্ধি পেয়েছে। সাক্ষরতার হার বেড়েছে। সংবাদপত্রের স্বাধীনতার মাধ্যমে জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠা পাচ্ছে। নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগ পৃথকীকরণ করা হয়েছে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অল্প সময়ের মধ্যে দেশকে অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে গেছেন। এই অগ্রগতি ও উন্নয়নের ধারা চলতে থাকলে ‘ভিশন ২০৪১’ও বাস্তবায়ন হবে। উন্নত বিশ্বের মতো আমাদের বাংলাদেশও যে উন্নতির শিখরে উঠে আসবে সে বিষয়ে কোন দ্বিধা নেই।

এই স্বাধীনতার মাসে আসুন আমরা সবাই শপথ নিই-আমরা ঐক্যবদ্ধভাবে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাই , হানাহানির রাজনীতি পরিহার করি , ৩০ লক্ষ শহীদের রক্তের বিনিময়ে পাওয়া এই দেশকে সোনার বাংলায় পরিণত করি । আসুন মা, মাঠি ও মানুষকে ভালোবাসি । সবাইকে স্বাধীনতা দিবসের শুভেচ্ছা ।

মো. বশিরুল ইসলাম, জনসংযোগ কর্মকর্তা (দায়িত্বপ্রাপ্ত)।শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়

পছন্দের আরো পোস্ট