নিউইয়র্কের স্পেশালাইজড হাইস্কুলে ভর্তিযুদ্ধে রিয়াসাতের জয়

আজ নিউইয়র্ক সিটির অত্যন্ত সম্মানজনক ৮টি স্পেশালাইজড হাইস্কুলে ভর্তি পরীক্ষার রেজাল্ট দিবে জানতাম। প্রতিবছর গড়ে ৩০ হাজার অষ্টম শ্রেণি পড়ুয়া ছাত্রছাত্রী ভর্তি পরীক্ষায় অবতীর্ণ হয়।মেধানুযায়ী নির্বাচিত হয় কেবল ৩ হাজার ছাত্রছাত্রী। আমার অষ্টম শ্রেণি পড়ুয়া ছেলে রিয়াসাত এই পরীক্ষায় প্রস্তুতির জন্য কঠোর পরিশ্রম করেছে বিগত দিনগুলোয়। স্বাভাবিকভাবেই আমরা স্বপ্ন দেখেছিলাম ভালো একটি স্কুলে তাঁর সুযোগ পাবার।

চমৎকার আবহাওয়ার একটি দিন ছিল আজ। আম্মাকে নিয়ে রুটিন চেকআপের জন্য ডাক্তারের চেম্বারে অপেক্ষা করছিলাম। যদিও অন্যসব বাঙালী মায়েদের মতোই রেজাল্ট কি হবে তা নিয়ে চিন্তিত ছিলাম । হাত,পা ঠান্ডা হয়ে আসছিল। প্রতি মূহুর্তে ঘড়ি দেখছিলাম। অবশেষে ফোনের অন্যপ্রান্ত থেকে ছেলের উচ্ছ্বসিত কন্ঠস্বর, “আম্মু আমি Stuyvesant High School এ চান্স পেয়েছি”।

ডাক্তারের চেম্বারে অন্যসব রোগীদের অগোচরে দু’হাতে মুখ ঢেকে অঝোরে কাঁদলাম, আনন্দের কান্না। আনন্দে মানুষ কেন কাঁদে, এ প্রশ্ন মনের মাঝে উঁকি দিত বারবারই। আনন্দে তো মানুষ প্রাণখুলে হাসবার কথা। আজ বেশ উপলব্ধি করলাম আনন্দের কান্নার পেছনে লুকিয়ে থাকে ভীষণ এক বেদনা থেকে উঠে আসার গল্প। আমার অশ্রুজল নিমেষেই সংক্রমিত হলো পাশেই বসে থাকা আম্মার মাঝেও। চোখ মুছছিলাম আমরা বউ-শ্বাশুড়ী দু’জনেই। প্রতিনিয়ত আমার হতাশাকে দূরে ঠেলে যুদ্ধ করে উঠে আসার গল্পের স্বাক্ষী যে শ্বাশুড়ী আম্মা।

মনে পড়ে সেই ডাক্তারের কথা, যিনি আজ থেকে তেরো বছর আগে রিয়াসাত গর্ভে থাকাকালীন সময়ে আমায় বলেছিলেন, “আপনার সন্তান জেনেটিক ক্রটি নিয়ে জন্মানোর সম্ভাবনা আছে।” যিনি কাউন্সিলিং এর মাধ্যমে আমায় বোঝাতে চেয়েছিলেন ক্রটিপূর্ণ সন্তান জন্মদানের কুফল সম্পর্কে| আমরা আমদের সিদ্ধান্তে অটল থেকেছিলাম সেইদিন| বলেছিলাম, “ডক্টর, আমাদের প্রথম সন্তান, সে যেমনই হোক আমরা তাঁকে পৃথিবীর আলো বাতাসে আনবো, ভালোবাসবো, আগলে রাখবো “।

মনে পড়ে সেই কিন্ডারগার্টেন শিক্ষিকার কথা, যিনি আমাকে স্কুলে ডেকে নিয়ে বলেছিলেন, “তোমার সন্তানের সাথে আমরা কোনভাবেই কমউনিকেট করতে পারছি না| না সে আমাদের কথা বুঝে, না আমরা তাঁর কথা বুঝি।”

Post MIddle

Stuyvesant High Schoolমনে পড়ে সেই নিউরোলজিস্টের কথা, যিনি আমায় পরামর্শ দিয়েছিলেন পার্কে নিয়ে বাচ্চাদের সাথে আমার সন্তানকে মেশার, খেলার সুযোগ করে দিতে। তাঁর কথামত বাস, ট্রেন ধরে দূরের পার্কে যাবার সেইসব সীমাহীন কষ্টের দিনগুলো একে একে ভেসে উঠে সামনে। পার্ক থেকে ফেরার পথে ক্লান্ত, ঘুমন্ত ৬ বছরের রিয়াসাতকে কোলে করে বাড়ী ফিরবার কঠিন যুদ্ধের দিনগুলোয় আমার শ্বাসকষ্টকে খুব মনে পড়ে। মাঝপথে ক্ষণিক থেমে ইনহেইলার নেওয়ার কথা আমি কেমন করে ভুলি ?

Stuyvesant High Schoolস্কুলে রিয়াসাতের ক্লাসের একমাত্র বাঙালী ছেলেটির মায়ের মুখও ভেসে উঠে সামনে। কৃতজ্ঞতায় মাথা নত হয়ে আসে, যাকে আমি প্রতিনিয়ত বিরক্ত করতাম হোমওয়ার্কসহ নানাবিধ তথ্যের জন্য। কেননা সেই সময়গুলোতে রিয়াসাত আমায় বলে বোঝাতে পারেনি কি তাঁর হোমওয়ার্ক কিংবা শ্রেণি শিক্ষক কি বলেছে।

আমার সেই সহজ সরল ছেলেটি STUYVESANT এর মতো একটি নামী স্কুলের গর্বিত ছাত্র হতে যাচ্ছে। কৃতজ্ঞতা সৃস্টিকর্তার প্রতি…

New York City Department of Education এর অধীনে আটটি স্পেসালাইজড স্কুলের জন্যে এই ভর্তিযুদ্ধ। এখানে নাইন, টেন, ইলেভেন, টুয়াল্‌ভ এই চার ক্লাস মিলে হাইস্কুল। প্রাপ্ত নাম্বারের ভিত্তিতে স্কুলগুলো ছাত্রছাত্রীদের সীমিত আসনে সুযোগ দিয়ে থাকে। যেমন, আটশ নাম্বারের এই পরীক্ষায় Stuyvesant স্কুলে সুযোগ পেতে হলে কমপক্ষে ৫৫৫ নাম্বার পেতে হবে। তেমনি Bronx Science এ সুযোগ পেতে কমপক্ষে ৫১২, Staten Island ৫০৩, Lehman College ৫০১, York College ৫০০, HS for Math, Science and Engineering ৪৯৮, Brooklyn Technical ৪৮৩, Brooklyn Latin ৪৭১। পরীক্ষার সময়সীমা দুইঘণ্টা তিরিশ মিনিট।

Stuyvesant High School

রিমি রুম্মান। নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র

পছন্দের আরো পোস্ট