ও কেমন যেন
ঝড়ের মত এসে টেবিলে রাখা মানিকের স্টেথোটা হাতে নিয়ে বের হয়ে যেতে যেতে বলল পারুল ‘এই মানিক আমি তোর স্টেথোটা নিয়ে গেলাম। আমারটা হোস্টেলে ফেলে এসেছি।’
মানিক হাহা করে উঠল ‘নিয়ে গেলাম মানে। আমি চলব কিভাবে?’
‘ তুই করোটা ছিনতাই করে নে।’ অবলিলায় কথাটা বলে
স্টেথোটা গলায় ঝুলিয়ে পারুল হনহন করে বেড়িয়ে গেল।
পিছনে থেকে মানিক হইচই করতে লাগল। উপায়ান্ত না দেখে মাথা নাড়তে নাড়তে বলল ‘পাগলী একটা।’ এই ঘটনায় সে যে খুব অসন্তুষ্ট হয়েছে তার চেহারা দেখে কিন্তু তা মনে হল না। বরং মনে হল পারুলের এরকম উল্টাপাল্ট আচরনের সাথে ওরা বেশ অভ্যস্ত।
পারুল ওরকমই। কখন যে কি করবে সে নিজেও কি জানে? যখন যা মনে হয় তাই করে। একটু পাগলাটে। সব সময় অস্থির। তবে খুব মেধাবী। ডাক্তার হিসাবেও অসাধারন। তার ডায়োগনেসিস দেখে সিনিয়র ডাক্তাররাও অনেক সময় অবাক হয়ে যান।
তার আরো একটা গুন আছ। কারো উপকার করতে পারলে সে যেন বাঁচে। কারো বদলী ডিউটি করতে হবে, স্যারের কাছে কোন সুপারিশ করতে হবে, জটিল কোন রুগী এটেন্ড করতে হবে, কোন বিষয় কউকে বুঝিয়ে দিতে হবে যত ঝামেলাই থাক পারুলকে সে পাবেই। শুধু সহজ করে বলতে হবে ‘ পারুল আমার তো এই সমস্যা।’ ব্যাস।
মনটা ওর স্বচ্ছ কাচের মত। সেখানে সামাজিক ক্লেদের কোন আঁকিবুকি নেই। তাই সবাই তাকে ভালবাসে। আসলে ভাল না বেসে পারা যায় না। উদ্ভট সব কর্মকান্ডে হাসপাতালটা একদম জমিয়ে রাখে।
খুব ছোট বেলায় তার মা মারা যাবার পর বাবা আবার বিয়ে করে। ভারতেশ্বরী হোমসে মানুষ হয় সে। হোমসের ধরাবাধা পরিবেশে কেমন করে এমন মুক্ত মন নিয়ে বেড়ে উঠে ও কে জানে। মানিকের মনেও মাঝে মাঝে এই একই প্রশ্ন দেখা দেয়। এই মূহুর্তে মানিকের মনে এই কথাটাই খেলা করছিল। তাই স্টেথো হারানোর বেদনা ভুলে পারুলের চলে যাওয়া পথের দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বলে ‘পাগলী একটা।’
মানিকের রুম থেকে বের হয়ে পারুল যায় সুমনার ওখানে। সুমনা তখন নুতন এক রুগীর কেস হিস্ট্রি দেখছিল। পারুল সুমনার পিঠে হাত দিয়ে বলে ‘তুই আমার ৩৭ নাম্বার ওয়ার্ডের ৩ নাম্বার রুগীটা একটু দেখে দেনা।’
‘ কোন রুগীটা?’
‘ ঐ যে ক্যাট ক্যাটে রুগীটা। ক্যাট ক্যাট ক্যাট ক্যাট করতেই আছে।’
‘ তুই কি করবি?’
‘ আমি এখন চাঁদ দেখব। চাঁদ। বিরাট একটা আস্ত চাঁদ মাথার উপর ঝুলছে দেখছিস না?’
‘ চাঁদ দেখবি?’
‘ হ্যাঁ।’
সুমনা এখন সত্যি চাঁদ দেখবে। হসপিটালের চওড়া গাড়ী বারান্দাটায় একটা চেয়ার নিয়ে নেমে যাবে সে। তারপর জ্যোৎস্না দেখতে দেখতে গুন গুন করে গান গাইবে আর সামনে পা ছড়িয়ে দিয়ে একটু একটু নাড়তে থাকবে। এমন সময় গুলতে তাকে সম্মোহিতের মত লাগে। অপার্থিব দেখায় তাকে। পৃথিবীর মানুষ বলে মনেই হয় না তখন।
প্রফেসররা তাকে পাগলী বলে জানে কিন্তু খুব ভালবাসে। কারন সে কোন রোগীর দায়িত্ব নিলে তাঁরা সম্পূর্ন নিশ্চিন্ত থাকেন। ঐ রোগীর পরিবারকে মূহুর্তে নিজের পরিবার বানিয়ে ফেলবে এবংরোগীকে পরিবারের একজনের মত সেবা করতে থাকবে। সেখানে কোন ফাঁকি ঝুকি নেই। আপন পর বলেও কোন কিছু নেই। সবাই তার পরমাত্মীয়।
তবে খামখেয়ালীপনাটাই ওর যা সমস্যা।
ডাঃ মেজবাহ একদিন পারুলকে ডাকলেন। একটা রুগীর দায়িত্ব নিতে হবে। পারুল সরাসরি না করে দিল।
ডাঃ মেজবাহ যদিও ওকে চেনেন তবুও একটু রেগে বললেন’ কেন তোমার কি সমস্যা?’
‘ সমস্যা আছে স্যার। বিরাট সমস্যা।’
‘ কি সমস্যা।’
‘ উকুন সমস্যা।’
ডাঃ মেজবাহ হেসে ফেললেন।
আসল ঘটনা হলো ওর মাথায় উকুন হয়েছে। কিছুতেই যাচ্ছে না। যাবে কি। ভিজা চুল বেঁধে রাখবে। পারত পক্ষে আচড়াবে না। গোড়াটা আচড়ালেও আগা কখনও নয়। উকুনের আর দোষ কি। এমন নিশ্চিন্তের আবাস সে কোথায় আর পাবে। পারুল নিউমার্কেট থেকে উকুনের চিরুনী কিনে এনেছে। এখন ডক্টর্স রুমে বসে উকুন নিধন করবে। তারপর অন্য কথা।
মানিকের সাথে তার সম্পর্কটাও বেশ মজার। তুই তুকারি সম্পর্ক। সম্পর্কের মধ্যে কোন দেয়াল নেই। খুব বন্ধুত্ব কিন্তু সব সময় খুটাখুটি লেগেই আছে। মানিক পারুলের চেয়ে বৎসর দুই বড় কিন্তু বয়সের ব্যবধান কোন বিষয়ই নয় পারুলের কাছে। ব্যবধান ভেঙ্গে দেয়া মুহুর্তের ব্যপার মাত্র। ছোট বড় উপর নীচ ব্যপারগুলো তার ধর্তব্যের বাইরে। এগুলোকে সে থোরাই কেয়ার করে। সবাই সমান তার কাছে।
পারুলকে মানিকের খুব ভাল লাগে। হয়তো ভালওবাসে। কিন্তু বলার সাহস নেই। পারুল যে কি কান্ড করে বসবে কে জানে। মানিক কতদিন ভেবেছে ঝরনার জলের মত এই মেয়েটাকে যদি বশে আনা যেত তবে পরিবারের সবাইকে নিয়ে হইহই করে জীবনটা কাঁটিয়ে দেয়া যেত। কিন্তু সেই সাহস সে করে না। কারন ঐ মেয়েটা যে একটু পাগলী।
মানিকের জীবনটা সংগ্রাম মুখর। এইচ এস সির মাত্র দুটো পরীক্ষা বাকি এমন সময় হঠাৎ একদিন বাবা মারা গেলেন। সিভিয়ার হার্ট এটাক। হসপিটালে নেওয়ারও সময় পেল না। ছোট একটা সরকারী চাকরী করতেন। তেমন কোন সম্পত্তিও রেখে যেতে পারেননি। বড় বোনের বিয়ে হয় গিয়েছিল অনেক আগে। বড় ভাইয়াই এত দিন সংসার টেনে এসেছেন। তিনি খুব বড় একটা চাকরী করেন তা নয়। মানিক বুঝত সংসার চালাতে তার খুব কষ্ট হয়। ভাবী খুব সহজভাবে নিতে পারত না ব্যাপারটা। তাই কষ্টটা ছিল মারাত্মক। দুই পক্ষেরই। ডাক্তার হওয়ার পর বড় ভাইকে রেহাই দিয়েছে মানিক। স্বেচ্ছায় সংসারের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছে। ছোট ভাই বোনেরা স্কুল কলেজে পড়ে। লেখা পড়ার যা খরচ। তাকে খুব পরিশ্রম করতে হয়। হাসপাতাল ডিউটির পরও আরো দুতিনটি ক্লিনিকে পার্ট টাইম কাজ করে। শুক্র শনিবার কচুয়া যায় রুগী দেখতে। চাপ পরে শরীরে। এমনিতেই সে শারীরিক ভাবে দুর্বল। প্রায়ই অসুস্থবোধ করে। দুর্বল লাগে। সে পাত্তা দেয় না। পাত্তা দিলে তার চলবে কন? মানিক জানেনা যে জন্মগত ভাবে সে একটা কিডনী নিয়ে জন্মেছে। একমাত্র মা জানেন। বাবাও জানতেন। ছোট বেলায় কেবল পেটে ব্যথা হত মানিকের। পরীক্ষা করতে গিয়ে ধরা পরে। মনোবল ভেঙ্গে যাবে বলে মা কোন দিন কথাটা বলেনি তাকে। হয়তো ভাবেন ছেলেটা তাহলে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে পারবেনা। কিন্তু নিজে সব সময় সঙ্কিত থাকেন। মানিকের এত পরিশ্রম তার ভাল লাগেনা। তাকে চিন্তিত করে। কিন্তু উপায় কি। তাই বাসায় ফিরে মানিক যখন খেতে বসে মা এসে দাড়ঁড়ান মাথার কাছে। পরম মমতায় মানিকের গায়ে মাথায় হাত বুলাতে থাকেন। মনিক কিছু বলে না। সে জানে মা তখন মনে মনে প্রার্থনা করে ‘হে আল্লাহ আমার এই ছেলেটা যুদ্ধ করার জন্যই জন্মেছে। যুদ্ধ করার শক্তি তাকে দেও আল্লাহ। সব সময় তাকে ভাল রাখ।’ মানিক জীবনের জন্য পারুলের মত একজন স্বচ্ছ মনের সাথী চেয়েছিল জাগতিক যুদ্ধকে যে গায়েই মাখবে না। কিন্তু মানিক তার চিন্তাটাকে বেশী দূর শাখাপ্রশাখা মেলতে দেয় না কারন সে জানে সেটা সম্ভব নয়। সে যে একটা আস্ত পাগল।
মানিক মনে মনে আবার উচ্চারন করে ‘পাগলী একটা।’
হঠাৎ কি হল মা মাথা ঘুরে পরে গেলেন। মানিকের ছোটভাই বাবর ছিল শুধু বাসায়। সামনে এসএসসি পরীক্ষা। ও পড়ছিল। হঠাৎ ধুম করে একটা আওয়াজ শুনতে পেল। বাথরুম থেকেই যেন শব্দটা এলো। দৌঁড়ে গিয়ে দেখে বাথরুমের দরজা খোলা। বাথরুম আর ঘরের মাঝামাঝি পরে আছে মা। হয়তো খারাপ লাগছিল খুব। নিজেই বাথরুমের দরজা খুলে বাইরে আসার চেষ্ট করছিলেন। এসে সারতে পারননি। মাঝ পথে পরে গেছেন।
বাবর তাড়াতাড়ি মানিককে ফোন করল। মানিক তখন একটা জটিল রুগী দেখছিল। পারুলকে ধরিয়ে দিয়ে তাড়াতাড়ি একটা এম্বুলেন্স নিয়ে গিয়ে মাকে হসপিটালে এনে ভর্তি করে দিল।
খবর পেয়ে ডাক্তার ও নার্সরা দৌঁড়ে এল। মোটামুট একটা ভির জমে গেল। একটু পরেই এলেন ডাঃ সুনিল। উনি মেডিসিনের হেড। ডাঃ সুনিল দেখে বললেন মনে হচ্ছে না গুরতর কিছু। তিনি কয়েকটা টেষ্ট লিখে দিলেন। মানিককে বললেন তার আন্ডারে ভর্তি করে দিতে। মানিক দেখে শুনে একটা কেবিন নিয়ে নিল।
সারা রাত মা ঘুমালেন। পারুল মায়ের মাথার কাছে জেগে রইল। মানিক জোড়াজুড়ি করতে লাগল কিন্তু সে কিছুতেই যাবে না বরং রাগ করে বলল ‘তোর কাজ তুই কর। আমাকে নিয়ে ভাবতে হবে না।’ তারপর চোখে হাসির ঝিলিক তুলে মজা করে বলল ‘ তুই বরংআমার জন্য চিকেন বিরিয়ানি আর কোক নিয়ে আয়। ক্ষিধা লাগলে আমার পাগলামিটা আবার বেড়ে যাবে। হিহি।’ ও নিজেও জানে সে যে একটা পাগলী। মানিক আর কি করে। পারুলের মাথার চুল গুলো নেড়ে দিয়ে বেরিয়ে গেল।
সকালে রিপোর্টগুলো এলে দেখা গেল তেমন কিছু নয় ডাইবেটিকটা অনেক বেশী। হয়তো তখন মায়ের হাইপো হয়ে গিয়েছিল। তারপরও মানিক মাকে কয়েক দিন হাসপাতালে রেখে দিল। পারুল জান দিয়ে সেবা করল। সুমনা এসেও মাঝে মাঝে দেখে যেত মাকে। মায়ের কিন্তু সুমনাকে খুব পছন্দ হল। পারুলকে কেমন যেন একটু উদ্ভট মনে হল। যেন একটু ছিটগ্রস্থ। চুলটাও ভাল করে আচড়ায় না মেয়েটা। সেই তুলনায় সুমনা কত সুন্দর। টিপটপ সুবোধ শান্ত। সুমনাকে খুব ভাল লেগে গেল মায়ের। এমন কি ছেলের পাশে সুমনাকে কল্পনা করে একটু যেন পুলকিতও হলেন তিনি।
মানিক বিসিএস পাশ করেছে। একটু আগে মজনু ফোন করে জানিয়েছে। সেও পাশ করেছে। বৎসরখানেক আগে পরীক্ষা দিয়েছিল। এতদিনে রেজাল্ট হল। মানিক প্রায় ভুলেই গিয়েছিল কবে পরীক্ষা দিয়েছে। খবরটা শুনে মানিকের মিশ্র প্রতাক্রিয়া হল। যতটা খুশী হওয়ার কথা ছিল ততটা নয়। সরকারী চাকরীতে বেতন এত কম। কি করে চলবে প্রথমে এটাই তাকে বিব্রত করল। সে দোটানায় পরে গেল। চিন্তিতও হল একটু। তার এখন অনেক টাকা দরকার। এতগুলো ভাই বোনের পড়ালেখা। ফোনটা যখন আসে মানিক বাসায়ই ছিল। মাকে গিয়ে জানাল খবরটা। মা তো ভিষন খুশি। মায়েদের কাছে চাকরী মানেই সরকারি চাকরী। সমীহের বিষয়। মা তখন তখনই আনু খালাকে ফোন করে জানালেন খবরটা। কিন্তু মানিকের চিন্তায় গেল না। সে মনি মামার সাথে আলোচনা করল। মনি মামাও চাকরীতে জয়েন করার পক্ষে।
তিনি সোৎসাহে বললেন’ ভাইগনা সরকারী চাকরীই তো চাকরী। তুমি যদি প্রফেসর হতে চাও জয়েন তো করতেই হবে। সরকারি হাসপাতালের সাথে এটাচ্ট থাকলেই না বড় ডাক্তার হতে পারবে।’ তিনি বিবেচনা করলেন দূর ভবিষ্যতের। মানিক চিন্তা করছে অদুর ভবিষতের। কি করে চলবে। তারপরও অনেক বিচার বিবেচনা আলাপ আলোচনার পর জয়েন করারই সিদ্ধান্ত নিল মনিক। জনমতও তার পক্ষেই ছিল। তার পোষ্টিং হল নিলফামারি সরকারি হাসপাতালে। মানিক ভাবল আগেতো জয়েন করি তার পর চেষ্টা তদবির করে ঢাকায় আসতে চেষ্টা করব।
সরকারি চাকরি হয়েছে এখন মানিকের বিয়ে দিতে অস্থির হয়ে উঠলেন মা। নিলফামারিতে যাওয়ার আগে মানিকের বিয়ে দিয়ে দিতে চান। মেয়ে তার পছন্দ করাই আছে। প্রতি দিনের মত মানিক খেতে বসেছে। মা এসে তার পাশে দাঁড়ালেন। মাথায় গায়ে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন ‘রাগ না করলে একটা কথা বলতাম বাবা’। মানিক মাথা না তুলেই বলল ‘কি কথা মা?’
তিনি আমতা আমতা করে বললেন ‘বলছিলাম তোমার বিয়ের কথা।’
মানিক মজা করে বলল’ তোমার এই অপদার্থ ছেলেকে কে মেয়ে দিবে মা?’
‘অপদার্থ না ছাই। আমার এমন লক্ষী ছেলে। মেয়ের বাবারা বাড়ি বয়ে এসে মেয়ে দিয়ে যাবে দেখিস’
মানিক মিটিমিটি হেসে বলল’ তাই নাকি মা। মেয়ের বাবারা তো তাহলে মেয়ে নিয়ে খুব বিপদে আছে।’
মা আদুরে ভঙ্গিতে বললেন ‘আছেই তো।’ তারপর অভিমানের সুরে বললেন ‘না আমি আর কোন কথা শুনবনা। এবার তোর বিয়ে দিব। তারপর অন্য কথা। আমার মেয়ে পছন্দ করাই আছে।’
মানিক নিজেও কয়েক দিন থেকে বিয়ের কথা ভাবছিল। একান্ত নিজের করে কাউকে পেতে ইচ্ছা করছিল তার। শরীর তো আরেকটা শরীর চায়ই। তার উপর ভাল মন্দ শেয়ার করার জন্যও তো কাউকে চাই।
ও চট করে মায়ের মুখের দিকে তাকাল। দেখল সেখানে খেলা করছে স্বপ্ন। হয়তো মা তখন কল্পনা করছেন মিষ্টি একটা মেয়ে লাল শাড়ী আর গয়না পরে পায় পায়ে ঘুরছে আর কারনে অকারনে মা মা বলে ডাকছে। মাধুর্যে তার মনটা ভরে গেছে। মায়ের মুখে সূখের একটা ছায়া খেলা করতে দেখে মানিকের খুব ভাল লাগল কিন্তু রহস্য করে বলল’ এই অভাগার জন্য পছন্দ করা সেই অভাগিনী কে মা?
‘তোর সাথে কাজ করে ঐ যে ডাক্তার মেয়েটা সুমনা। ওকে আমার খুব পছন্দ হয়েছে।’
আশ্চর্য হয়ে মানিক চট করে মায়ের মুখের দিকে তাকাল। সুমনা যে সম্ভাব্য পাত্রী হতে পারে মানিকের কল্পনাতেও ছিল না। পারুলের চেহারাটা চোখের উপর ভেসেই মিলিয়ে গেল। তবে সুমনা যে তাকে পছন্দ করে মানিক টের পায়। প্রায়ই সে ছল ছুতায় কারনে অকারনে তাকে গিফ্ট দেয়। তার কোন কাজ করে দিতে পারলে খুশি হয়। মানিক কারনটা বুঝেও না বুঝার ভান করে। তেমন পাত্তা দেয় না। বন্ধুত্বের বাইরে যেতে চায় না। তবে এখন সুমনাকে নিয়ে একটু গভীর করে ভাবল। হৃদয়ের কোথায় যেন একটু পুলকও অনুভব করতে লাগল মনিক।
বেশ কিছুদিন পরে সুমনার সাথে মানিকের বিয়ে হয়ে গেল। মানিক সুমনাকে নিয়ে নিলফামারিতে চলে গেল ঘর ও চাকরী করতে। ধীরে ধীরে পারুল নামের পাগলী মেয়েটা মানিকের মন থেকে মুছে গেল।
সুমনাকে নিয়ে মানিকের সুখের সংসার। ভাই বোনেরাও প্রতিষ্ঠিত। পরীর মত দুই মেয়ে পিংকী আর রিংকী। মানিকের চোখের মনি। বড় মেয়ে অনার্সে পরে। ছোটটা সামনে মেট্রিক দিবে। অনেক চেষ্টার করেছে মানিক ঢাকায় আসার কিন্তু পারেনি। শেষ পর্যন্ত ময়মনসিংহে সেটেল্ড করেছে। একট ছোটখাট বাড়িও করেছে সেখানে। ময়মনসিং মডিক্যালে পোষ্টিং। প্রফেশনে খুব যে ভাল করেছে তা নয়। তার জন্য যে তদবির লাগে সেই শক্তি বা সাহস কোনটই তার নেই। অসুস্থতা অনেকটা দায়ী। প্রায়ই অসুস্থ থাকে। অসুখটা কি তাও ধরতে পারেনি। অবশ্য চেষ্টাও করেনি। গাফিলতিই অনেকটা। খুব খারাপ লাগলে নিজে নিজেই চিকিৎসা করে। সুমনা খুব চেচামেচি করলে রহস্য করে বলে ‘ ডাক্তারদের জমেরও অরুচি তুমি চিন্তা করোনা।’ সুমনা অভিমান করে। কিন্তু যে মানুষ কথা শুনে না তাকে কি করা যায়। মেয়েদের দিয়েও চেষ্টা করেছে সুমনা কিন্তু কোনই কাজ হয়নি। এক সময় সুমনাও হাল ছেড়ে দেয়। সপ্তাহে একদিন গফরগাও হসপিটালে যায় মানিক রুগী দেখতে। ট্রেনে যায় ট্রেনে ফিরে। সেদিও ট্রেনে ফিরছিল। ট্রেনেই খারাপ লাগছিল খুব। একটু বেশীই খারাপ লাগছিল। কোন রকমে বাসায় এসে পৌঁছতে পেরেছিল। প্রেসার মেপে দেখে একশ বিশ আর দুইশ। বেশ কিছুদিন থেকেই শরীরটা ভাল যাচ্ছে না। কেমন যেন দুর্বল লাগে। একটুতেই হাফিয়ে উঠে। মেজাজটাও খিটখিটে হেয়ে যচ্ছে। ভিক্ষুকের লক্ষী পায়ে ডাক্তারের ব্যবহারে। মানিক সেটা জানে। আজীবন সেই সাধনাই করে এসেছে। কিন্তু এখন কিছুতেই ধরে রাখতে পারছে না। ঐ দিন তো এক রুগীকে অপমানই করে বসল।
রোগীর নাম দেবাশিষ। বেশ ভদ্রলোক। সৌম্য শান্ত সুদর্শন। রেলের ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন। অবসর নিয়েছেন। সৌষ্ঠবে পড়ালেখার ছাপ। একহারা গড়ন ধবধবেপাঞ্জাবী পাতলা চুল রিমলেস চশমা স্মিত হাসি সব মিলিয়ে ভদ্রলোককে দেখলে বেশ সমীহ হয়। আগেও কয়েকবার এসেছেন। অনেক্ষন গল্পটল্প করে ঔষধ নিয়ে গেছেন। সেই খাতিরে সেদিনও দেবাশীষ বাবু তার রোগের একটু বিস্তরিত বিবরন দিতে গেলে মানিক প্রায় খেকিয়ে উঠল ‘এত সাত কাহনের তো দরকার নাই। আপনার রোগটা তো আমি জানি। শুধু বলুন এখন কেমন লাগে।’ দেবাশীষ বাবু থতমত খেয়ে তাকিয়ে রইলেন। এই ব্যবহার তিনি কল্পনাও করতে পারেননি। পরে অবশ্য মানিক সামলে নিয়ে ক্ষমা চেয়ে বলল ‘কিছু মনে করবেন না দেবাশীষ বাবু আমার শরীরটা ভাল যাচ্ছে না।’ ঘটনাটি মনে করে পরের কয়েকদিন খুব খারাপ লেগেছিল। তার দ্বারা এরকম ব্যাবহার খুবই অস্বাভাবিক কিন্তু প্রায়ই এখন এরকম হচ্ছে। নিজের সম্পর্কে মানিক খুবই উদাসিন। পারত পক্ষে ডাক্তার দেখাতে চায় না। কিন্তু এখন আর পারছে না।
কিডনী স্পেশালিস্ট ডাঃ হরুন-অর-রশিদ কপালে চিন্তার রেখা নিয়ে মানিকের টেষ্ট ও এক্সরে রিপোর্টের দিকে তাকিয়ে আছেন। কিছুক্ষন আগে রিপোর্টগুলো দেখতে দেখতে ঐ চিন্তার রেখাটি তার কপাল দখল করে নিয়েছে। মুখটা অসম্ভব গম্ভীর। মানিক রিপোর্টগুলো আগেই দেখেছে। ঐ রেখাগুলো সে খোলা বইয়ের মত পড়তে পারছে। নিজেও ভিষন চিন্তিত। রিপোর্ট গুলো থেকে মাত্র কিছুক্ষন আগে জানতে পেড়েছে যে জন্মগত ভাবে তার মাত্র একটিই কিডনী এবং সেটিও ফাইব্রোয়েটিক। অতিরিক্ত পরিশ্রম ও অনিয়মের কারনে আজ সেটিও সম্পূর্ন বিকল। মানিক এই মূহুর্তে উপলব্ধি করতে পারছে ছোট বেলায় কেন তাকে বেশীর ভাগ সময় রোগ শয্যায় কাটাতে হত। প্রায়ই জ্বর হত। জ্বর হলেই বাবা চিন্তিত মুখে সেবা করতে করতে একটু পর পর তার মুখের দিকে পলকহীন চেয়ে থাকতেন। মাকেও সেই সময় চিন্তিত দেখত। চিন্তিত বাবা ও মায়ের মধ্যে চোখে চোখে কি কথা হত। তারা হয়তো তার কিডনীর দুরবস্থার কথা জানতেন কিন্তু চিকিৎসার অতীত এই রোগের বিষয়ে চিন্তা করা ছাড়া আর কিছুই করার ছিল না। তখন হয়তো এই রোগের কোন চিকিৎসাই বের হয়নি।
ডাঃ হারুন এক্সরে কেরিয়ার থেকে চোখ সরিয়ে মানিকের দিকে তাকালেন। কিছুক্ষন চুপ করে থেকে চশমাটা খুলে টেবিলে রাখলেন। থাম ও তর্জনি দিয়ে চোখ দুটো কচলানেন। হয়তো পরবর্তী কথাগুলো পরপর সাজিয়ে নিলেন। তারপর পুনরায় চশমাটা পরে দুটো হাতের সবগুলো আঙ্গুল লক করে টেবিলের উপর রেখে একটু ঝুকে বসে মনিকের চোখে চোখ রাখলেন। গুমোট ভাবটা কাঁটানোর জন্য মুখে একটু হাসি টানার চেষ্টা করলেন কিন্তু হাসিটা তেমন ফুটল না। তারপর ধীরে ধীরে বললেন’ মানিক তুমি তো নিজেই একজন ডাক্তার। তোমাকে কিছুই বুঝানোর নেই। তুমি হয়তো এতক্ষনে জেনে গেছ তোমার ফাইব্রোয়েটিক কিডনী ছিল। শরীরের তেমন যত্ন নেওনি। তারউপর জন্মগত ভাবে একটা কিডনী নিয়ে জন্মেছ। তোমার কিডনীর এখন খুই জটিল অবস্থা। বলতে গেলে ই এস আর ডি ( এন্ড স্টেজ অফ রেনাল ডিজিজ) যাকে আমরা কিডনী ফেইলুর বলি।’ তিনি একটু থামলেন। কিছুক্ষন চুপ করে থেকে নরম গলায় বললেন’ আপাতত আমি ডায়ালেসিস সাজেস্ট করছি। আমার মনে হয় শেষ পর্যন্ত কিডনী ট্রেন্সপ্লেন্ট লাগবে। তুমি এর মধ্যে ডোনার খোঁজ।’ বলেই তিনি মানিকের অভিব্যক্তির দিকে তাকালেন। তিনি দেখলেন মানিক দুই হাতে মুখ ঢেকে বসে আছে। সম্ভবত সে কাঁদছে। মানিকের মনে তখন ফুলের মত সুন্দর দুই মেয়ের মুখ ভেসে যাচ্ছে যারা জীবনে কষ্ট কি জানেনা।মানিক সুমনা জীবন ভর সেই চেষ্টাই করেছে। যতই সে মেয়েদের কথা মনে করছে ততই তার বুকের ভিতর থেকে কান্না ঠেলে উঠছে। ডাঃ হারুন তাঁর চেয়ার থেকে উঠে এসে মানিকের কাঁধে হাত রাখলেন। কিছুক্ষন আস্তে আস্তে কাঁধে চাপড় দিলেন। মানিক কিছুটা সুস্থির হলে বললেন ‘মাই বয় ভেঙ্গে পরলে তো চলবে না। তুমিতো জান এখন এর ভাল চিকিৎসা আছে। এখন তোমার কাজ হবে একজন ভাল ডোনার জোগার করা। তুমি চাইলে আমি বিনা পয়সায় তোমার অপারেশন করে দিতে পারি। চিন্তা করোনা সব ঠিক হয়ে যাবে।’ মানিক পকেট থেকে রুমাল বের করে চোখ মুছল। তারপর ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়িয়ে বলল ‘ ধন্যবাদ স্যার দোয়া করবেন।’ ডাঃ হারুন ওর কাঁধে একট চাপ দিয়ে চেয়ারে গিয়ে বসলেন। মানিক খালি হাতেই বেড়িয়ে যাচ্ছিল। তিনি বেল চাপলেন। এটেন্ডেন্ট ছেলেটা ভিতরে এলে তার হাতে পে্রস্কিপসন ফাইল আর এক্সরে রিপোর্ট দিয়ে বললেন ‘স্যারকে গাড়িতে তুলে দিয়ে এস।’
সুমনা তার সাথে আসতে চেয়ে ছিল কিন্তু মানিক নিষেধ করেছে। ও আন্দজ করেছিল ডাঃ হারুন কি বলবেন। মানিক চায়নি সেই অসহায় অবস্থাটা তার পবিবার জানুক বিশেষ করে তার মেয়েরা। সুমনা জানলে তার প্রাথমিক প্রতিক্রিয়ায় মেয়েরাও জেনে যাবে। বাসার সবার মধ্যে পেনিক সৃষ্টি হবে। মানিক ভাবল বাসায় গিয়ে সুমনাকে বুঝিয়ে বলবে সে যেন যতটা পারে স্বাভাবিক থাকতে চেষ্টা করে। গাড়ীতে সে চোখ বুজে চোখের উপর ডান হাতটা তুলে দিল এবং যতটা সম্ভব সব কিছু থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে নিতে চাইল।
মনিকের একটা কিডনী দরকার। এটা এমন একটা জিনিস আত্মীয় বন্ধু বান্ধব কেউ স্বতস্ফূর্ত ভাবে এগিয়ে না এলে চাওয়া যায়না। অনেকেই হাহুতাশ করে কিন্তু এ ব্যপারে সবাই নিরব। এটাই স্বাভাবিক। সুমনা দিতে চেয়েছিল কিন্তু সে হাই ডায়বেটিক এর রুগী। এমনিতেই সারা বৎসর অসুস্থ থাকে। সম্ভব অসম্ভব সব রকম চিন্তা করল ওরা। একবার মেয়েদের কথাও চিন্তা করা হল কিন্তু সবই নাকচ হয়ে গেল। ডায়ালাইসিস চলা সত্বেও মানিকের অবস্থা দিন দিন খারাপের দিকে যাচ্ছে। শেষ পর্যন্ত প্রাইভেট ডোনারের কথা ভাবা হল। অনেকগুলো ডোনারের মধ্যে থেকে একজনকে সিলেক্ট করা হল। পরীক্ষা নিরীক্ষায় সব মেচ করে গেছে। ডাঃ হারুনই অপারেশন করবেন। সব ঠিকঠাক কিন্তু একদম শেষ মূহুর্তে দেখা গেল ডোনারের কিডলীর অবস্থাও খুব ভাল নয়।
পারুল পেপারের সাহায্য প্রার্থী খবর গুলো গভীর মনোযোগ দিয়ে পরে। মানুষের অসহায়তা তাকে ব্যাথাতুর করে। সময়ে সময়ে আবেগে আপ্লুত হয়ে সময়ে সময়ে কিছু কিছু সাহায্যও পাঠায়। এখন তেমন কোন কাজ নেই হাতে। এই মাত্র রাউন্ড শেষ করে এসেছে। এনাম মডার্ন হাসপাতালের সে এখন এমডি। ফুল প্রফেসর। এই হসপিটালেই সে প্রথম থেকে আছে। প্রমোশন হতে হতে এখন এমডি। জীবনে সে আর বিয়ে করল না। এই হসপিটালটাই তার ধ্যান জ্ঞান। রোগীরাই তার পরিবার। বিয়ের কথা সে চিন্তাই করে নি। একজনকে হয়তো করতে পারত কিন্তু সে যাক গে। বিয়ের সে প্রয়োজনই বোধ করে না। কোন কিছু নিয়েই গভীর করে ভাবতে তার ভাল লাগেনা। অতীত বর্তমান ভুত ভবিষ্যত। যখন যা মনে হয় তাই করতেই তার ভাল লাগে। কোন আত্মীয় স্বজনের সাথেই তার কোন সম্পর্ক নেই। বাবার সাথেও ছিল না যত দিন তিনি বেঁচে ছিলেন। বাবার শেষের ঘরে দুটো ভাই বোন আছে। তাদের সাথেও তার কোন সম্পর্ক নেই। বাবা বেঁচে থাকতে মাঝেমাঝে অনুযোগ করতেন ‘ তুই একদম যোগাযোগ রাখিসনা। মঝেমাঝে বাসায়ও তো আসতে পারিস।’
টেলিফোন ধরে ও বলতো’ রাখ তো। রাখ তো। আমিতো হোসটেলে ভালই আছি। এত কান্না কাটির কি আছে। ভাল লাগলে যাবনে।’ বলেই লাইন কেঁটে দিত। মা মারা যাবার পর ভারতীশ্বরী হোমসে মানুষ হয়েছে বলেই হয়তো সে কারো সাথে তেমন করে আত্মীয়তা বোধ করে না। আবার কাউকেই তার পর মনে হয় না। এমনই এক মানুষিকতা নিয়ে সে একা জীবন যাপন করে।
প্রথম আলোর তিন নাম্বার পৃষ্ঠায় কিডনী চেয়ে এক মধ্য বয়স্ক ভদ্রলোকের ছবি ছাপা হয়েছে। ভদ্রলোককে পারুলের খুব পরিচিত মনে হল। মনোযোগ দিয়ে ছবিটা দেখল। হঠাৎ সে মানিককে চিনতে পারল। এত দিন পর মানিক অনেক চেঞ্জ হয়ে গেছে। একটু মোটা হয়ে গেছে। মাথার চুলও পাতলা হয়ে গেছে। বাইরে দেখলে হয়তো চিনতেই পারত না। পারুল পেপার থেকে মানিকের টেলিফোন নাম্বারটা টুকে রাখল।
মানিককে ফোন করে একদিন তাকে দেখতে গেল পারুল। দরজা খুলল সুমনাই। পুরানো বান্ধবীকে পেয়ে সুমনা গভীর আবেগে জড়িয়ে ধরল। এক নজর দেখেই পুরুল বুঝতে পারল সুমনার উপর দিয়ে কি ঝড় বয়ে যাচ্ছে। স্পষ্ট ছাপ তার অবয়বে। সুমনা পারুলকে সোজা মানিকের ঘরে নিয়ে গেল। মানিক প্রায় বিছানার সাথে মিশে গেছে। ওকে আর চেনাই যায় না। কাগজের ছবির সাথে কিছুতেই মেলান যায় না। ওটা বোধ হয় ওর আগের ছবি। পারুল মানিককে কিছু বলতে পারল না শুধু দাঁড়িয়ে থেকে ওর হাত দুটি ধরে চোখের দিকে চেয়ে গভীর করে হাসল। পরম বন্ধুর হাসি যেখানে ছিল স্নেহ ভালবাসা আদর সহানুভুতি আনন্ত আশ্বাস। মনিক ওর দিকে তাকিয়ে চোখের পানি ছেড়ে দিল। কোন কথা বলতে পারল না। চোখের দুকোল দিয়ে পানি ঝড়িয়ে কেবল ওর ঠোট আর গলার কন্ঠী কাঁপতে লাগল।
সুমনা পারুলকে নিয়ে ড্রয়িং রুমে এসে বসল। এক মুহুর্তের জন্য পারুলের হাত ছাড়ল না সুমনা যেন কোন একটা ভরসার স্থল বড় বেশী প্রয়োজন তার। ড্রয়িং রুমেও পারুলের হাত ধরে সমস্ত ঘটনা বলে যেতে লাগল আর কাঁদতে লাগল। আরেকটা সোফায় মানিকের বৃদ্ধ মা বসে আঁচলে চোখ মুছছিলেন। পারুল সুমনাকে না তার শাশুড়ীকে একবারও সান্তনা দিবার চেষ্টা করল না। কোন শান্তনার বানীই কি তাদের এই দুর্মর কষ্ট থেকে উদ্ধার করতে পাবে? সেই বানী পারুলের জানা নাই। তাই সে সেই চেষ্টা করল না। সুমনাকে শুধু বলল মানিকের কাগজপত্র গুলোর এক সেট ফটোকপি দিতে ও একটু নিজে কনসাল্ট করতে চায়। বাসায় ফটোকপি ছিল। সুমনা একসেট ফটোকপি এনে দিল। দুই বন্ধবী করুন মুখে পরস্পরের কাছ থেকে বিদায় নিল।
বেশ কিছু দিন পর ডাঃ হারুন একদিন ফোন করলেন। তখন সন্ধ্যা হয় হয়। আজান পরবে পরবে। সূর্য্য এই মাত্র বিদায় নিয়েছে কিন্তু যাবার পথে নিজের অস্তিত্ত্বের খানিকটা পথে বিছিয়ে দিয়ে গেছে। তাই এখনও পুরোপুরি অন্ধকার হয়নি। মানিক বিষন্ন মনে জানলার বইরে নারকেল গাছটার দিকে তাকিয়ে ছিল সেখানে একটা কাক রাত্রের বিশ্রামের আয়োজন করছে। মানিক বিষন্ন মনে ভাবছিল ঐ কাকটাও কাল সকালের মুখ দেখার আশায় আনন্দ চিত্তে রাতের আশ্রয় খোঁজছে। তার সে আশাটুকুও নাই। হায় মানুষের জীবন এত অনিশ্চিত কেন? এখনও ডোনার জোগার হয়নি। একজনের সাথে কথাবার্তা চলছে। সে অনেক টাকা চাচ্ছে। মিলন কাকা কথাবার্তা বলছেন। এমন সময় ডাঃ হারুনের ফোনটা এলো। মানিক ফোনটা ধরতেই তিনি খুশী খুশী গলায় জানালেন ডোনার পাওয়া গেছে। ও যেন আগামী শনিবার অপারেশনের প্রিপারেশন নিয়ে চলে আসে। মানিক অবাক হয়ে গেল। ও জানতে চাইল ডোনার কে? ডা হরুন রহস্য করে বললেন ‘ তুমি আস তো আগে তারপর সব জানবে।’
অপারেশন থিয়েটার। মানিককে অপারেশনের জন্য রেডি করা হয়েছে। বাইরে সবাই উদ্বিগ্ন মুখে দাঁড়িয়ে আছে। ডাঃ হরুনের এসিস্ট করা ডাক্তার নার্সরা সবাই ব্যাস্ত। এখনও ডাঃ হারুন এসে পৌঁছাননি। ডোনারের নাম এখনও মানিকের অজানা। মনিক মনে মনে খোঁজছে কে হতে পারে কে হতে পারে। এমন সময় দরজা ঠেলে আরেকটা স্ট্রেচার ঢোকানো হল। মানিক দেখল ঐটাতে শুয়ে আছে পারুল। পারুলের গায়ে অপারেশনের পোশাক। পারুল মানিকের চোখে চেয়ে হাসল। পাছে মানিক চোখ দিয়েই কৃতজ্ঞতা জানায় তাই সে চোখ সরিয়ে নিল। আর একবারও মানিকের দিকে তাকাল না।
মানিক মৃদু কন্ঠে বলল ‘পারুল তুই এখনও মানুষ হলি না।’ তারপর আদর করে বলল’ পাগলী একটা। ‘
পারুল মানিকের ত্রিশ বৎসর আগের আদরের ডাকটা ঠিকই শুনতে পেল।