
খুবিতে যথাযোগ্য মর্যাদায় একুশে ফেব্রুয়ারি পালিত
যথাযোগ্য মর্যাদায় গতকাল ২১ ফেব্রুয়ারি খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে মহান শহিদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালিত হয়। এ উপলক্ষে সকাল সাড়ে ৬ টায় শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ প্রশাসন ভবনের সামনে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিতকরণ ও কালো পতাকা উত্তোলনের পর উপাচার্য প্রফেসর ড. মোহাম্মদ ফায়েক উজ্জামানের নেতৃত্বে প্রভাতফেরি কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে পৌঁছায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে সেখানে উপাচার্য শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণ করেন। এসময় ট্রেজারার, বিভিন্ন স্কুলের ডিন, পরিচালক, রেজিস্ট্রার (ভারপ্রাপ্ত), ডিসিপ্লিন প্রধান, ছাত্র বিষয়ক পরিচালক, প্রভোস্টবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন। এর পরপরই খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি, স্বাধীনতা শিক্ষক পরিষদ, খানজাহান আলী হল, অপরাজিতা হল, খানবাহাদুর আহছানউল্লা হল, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হল, বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হল, ন্যাশনালিস্ট টিচার্স এ্যাসোসিয়েশন, কলা ও মানবিক স্কুল, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় স্কুল, স্থাপত্য, কম্পিউটার বিজ্ঞান ও কৌশল, ব্যবসায় প্রশাসন, নগর ও গ্রামীণ পরিকল্পনা, ফরেস্ট্রি এন্ড উড টেকনোলজি, ফিশারিজ এন্ড মেরিন রিসোর্স টেকনোলজি, বায়োটেকনোলজি এন্ড জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং, এগ্রোটেকনোলজি, ইলেক্ট্রনিক্স এন্ড কমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং, পরিবেশ বিজ্ঞান, ফার্মেসি, গণিত, সায়েল সায়েন্স, ইংরেজি, অর্থনীতি, সমাজ বিজ্ঞান, পদার্থবিজ্ঞান, রসায়নবিজ্ঞান, বাংলা ভাষা ও সাহিত্য, পরিসংখ্যান, ডিভেলপমেন্ট স্টাডিজ, ড্রইং এন্ড পেইন্টিং, প্রিন্টমেকিং, ভাস্কর্য, মানবসম্পদ ও ব্যবস্থাপনা, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা, ইতিহাস ও সভ্যতা, আইন ও বিচার ডিসিপ্লিন ও শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর মধ্যে চেতনা একাত্তর, বাঁধন, ভৈরবী, ওংকার, ছায়াবৃত্ত, শৃণুতা, স্পার্ক, অফিসার্স কল্যাণ পরিষদ, কর্মচারিদের পক্ষ থেকে এবং আশপাশের স্কুল-কলেজের শিক্ষক ছাত্র-ছাত্রী ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানের পক্ষে শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণ করা হয়।
পরে বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রিয় শহীদ মিনার চত্বরে মুক্তমঞ্চে মহান শহিদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উদযাপন কমিটির আহবায়ক প্রফেসর ড. মোসাম্মাৎ হোসনে আরার সভাপতিত্বে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। আলোচনা সভায় উপাচার্য প্রফেসর ড. মোহাম্মদ ফায়েক উজ্জামান, ট্রেজারার খান আতিয়ার রহমান, ইংরেজি ডিসিপ্লিনের প্রফেসর ড. আহমেদ আহসানুজ্জামান, এগ্রোটেকনোলজি ডিসিপ্লিনের প্রফেসর ড. মোঃ সারওয়ার জাহান এবং শিক্ষার্থীদের মধ্যে ভাস্কর্য ডিসিপ্লিনের নাফিজুর ইসলাম, বাংলা ভাষা ও সাহিত্য ডিসিপ্লিনের সিফাত আলমগীর শাওলীন বক্তব্য রাখেন। এছাড়া অনুষ্ঠানে উপাচার্য আইন ও বিচার ডিসিপ্লিনের উদ্যোগে প্রকাশিত একুশের স্মরণিকা দেয়াল ভাঙ্গার গান এর মোড়ক উন্মোচন করেন। এসময় সংশ্লিষ্ট স্কুলের ডিন ও ডিসিপ্লিন প্রধান প্রফেসর ড. মোঃ ওয়ালিউল হাসানাত এবং ছাত্র বিষয়ক পরিচালক প্রফেসর ড. অনির্বাণ মোস্তফা উপস্থিত ছিলেন। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে দেশাত্ববোধক গান, কবিতা আবৃত্তি করা হয়। অন্যান্য কর্মসূচির মধ্যে ছিলো বাদ যোহর ভাষা শহীদদের আত্মার মাগফেরাত কামনায় বিশ্ববিদ্যালয় জামে মসজিদে দোয়া এবং সন্ধ্যা সাড়ে ৬ টায় বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রিয় শহিদ মিনার চত্বরে প্রদীপ প্রজ্জ্বলন।
অনুষ্ঠানে উপাচার্য তাঁর বক্তৃতায় আমাদের ভাষা আন্দোলনের পূর্বাপর তথ্যসমৃদ্ধ ঘটনা, পর্ব তুলে ধরে বলেন প্রকৃতপক্ষে ১৯৪৭ সালের অনেক আগে থেকে এবং ধর্মেরভিত্তিতে দেশ বিভাগের পরও আমরা দেখতে পাই বাংলা কখনও উচ্চবিত্তের ভাষা ছিলো না। এটি ছিলো নিম্নবিত্ত বা নিম্নবর্গের ভাষা। সাধারণ মানুষের ভাষা। বাংলা ভাষার লিখিতরূপের আদি নিদর্শন চর্যাপদের শব্দশৈলীতে, বর্ণনায়, উপমায় আমরা সে প্রমাণ পাই। আমরা লক্ষ্য করি বাংলা ভাষায় সাধারণ মানুষের সকল প্রকার অভিব্যক্তি ও আবেগ প্রকাশের সাথে অন্যকোনো ভাষার তুলনা হয় না। আমাদের মাতৃভাষা যেনো আমাদের অস্তিত্ব ও মননে সুদীর্ঘকাল থেকে গভীরভাবে প্রথিত। অঞ্চলে অঞ্চলে বাংলা ভাষায় কথা বলার ভঙ্গির কিছুটা তফাৎ লক্ষ্য করা গেলেও আবেগ ও ভাবপ্রকাশের ভিন্নতা নেই। হাসি-কান্না, প্রেম-বিরহে বাংলাভাষায় অভিব্যক্তি একই রকম। পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠি যখন আমাদের মায়ের সেই মুখের ভাষা, আবেগ কেড়ে নিতে চায়, আত্মঅধিকার ছিনিয়ে নিতে চায় তখন সাধারণ মানুষের চেতনায়, অস্তিতে আঘাত আসে ।
তিনি বলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সাধারণ মানুষের এই অনুভূতি ও আবেগ অনুধাবন করতে পেরেছিলেন, তিনি সবসময়ই নিম্নবর্গের সাধারণ মানুষের পাশেই ছিলেন। তাদের প্রতিনিধিত্ব করতেন, তাদের কথাই চিন্তা করতেন বলেই ভাষার দাবিতে সোচ্চার হন, নেতৃত্ব দেন। প্রকৃতপক্ষে রাষ্ট্রভাষার দাবির মধ্যেই অন্তর্নিহিত ছিলো বাংলাভাষার রাষ্ট্রের স্বপ্ন। এ কারণেই বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনই সাধারণ মানুষের মধ্যে বাঙ্গালি জাতিসত্ত্বার চেতনা জাগ্রত করে। অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ-প্রতিরোধ গড়ার সাহস যোগায়। চুয়ান্নর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনের ফলাফল বলে দেয় তা একদিকে ছিলো বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের প্রভাব ও অন্যদিকে সাধারণ মানুষের প্রত্যাশার প্রতিফলন। এ পথ ধরেই বাঙ্গালি তাঁর স্বাধিকার আদায়ের পথে নামে যার সার্থক নেতৃত্ব দেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতিপর্বেই তিনি ঘোষণা করেন বাঙ্গালির রাষ্টভাষা হবে বাংলা। তাই তিনি মুক্তিযুদ্ধের পর বাহাত্তরের ১০ জানুয়ারি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের মাটিতে পা রাখার কয়েকদিনের মধ্যেই সর্বস্তরে বাংলাভাষা ব্যবহারের আদেশ জারি করেন। সংবিধানে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলাভাষাকে অন্তর্ভূক্ত করা হয়।
তিনি বলেন বাংলা একাডেমিতে প্রথমবার তিনি যাওয়ার শর্ত হিসেবে বাংলা ভাষার চর্চাকারী,ভাষা সৈনিক, বুদ্ধিজীবী আবুল ফজল ও জসীম উদ্দীনকে পাশে নিয়েই অনুষ্ঠানে বসেছিলেন। তিনি বাংলাভাষার সমৃদ্ধির জন্য, সার্বজনীনতার জন্য, বিশ্বজনীনতার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের প্রতি বিদেশী পাঠ্য পুস্তক, গবেষণাপত্র বাংলায় অনুবাদ এবং বাংলায় রচিত পাঠ্য পুস্তক বিদেশী ভাষায় অনুবাদ কারার জন্য আহবান জানিয়ে বাংলা একাডেমিকে বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে পত্রপ্রদানের পরামর্শ দেন। তিনি এ কাজে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-গবেষকদের রয়েলিটি বা সম্মানীর ব্যবস্থাও চালু করেন। ফলে দেশে অনুবাদ চর্চার সংস্কৃতি গড়ে ওঠে। কিন্ত পঁচাত্তরের পনেরই আগস্টে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর সেই প্রচেষ্টার আর পুণরুত্থিত হয়নি। অনুবাদচর্চা বহুকাল প্রাতিষ্ঠানিক রূপনিতে পারেনি। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা সরকারের প্রচেষ্টায় বাঙালির মাতৃভাষা দিবস আজ জাতিসংঘের স্বীকৃতি পেয়ে তা বিশ্বজনীন পরিচিতি, পালনীয় ও স্মরণীয় বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। জাতি হিসেবে এটাও আমাদের বড় গর্বের বিষয়। আমাদের ভাষা সমৃদ্ধ হলে তা সার্বজনীন হবে এবং বিশ্বে আমাদের ভাষার গ্রহণযোগ্যতা আরও বাড়বে। তবে ভাষার উৎকর্ষ সাধনের দায়ভার প্রথমে পড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর । আমি খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রিয় শিক্ষার্থীদের প্রতি এ আহবান জানাই যে অন্য ভাষায় জ্ঞানার্জনের আগে নিজ ভাষায় যেনো তারা সমৃদ্ধ হয়। তা হলে তারা আরও সুন্দর ও সহজভাবে বিশ্বজনীন জ্ঞান অর্জন করতে পারবে।