একুশ এগিয়ে চলার শক্তি
প্রতিটি জাতিই তার দেশকে ভালোবাসে, ভালোবাসে তার মাতৃভাষাকে । মাতৃভাষার অধিকার রক্ষার্থে প্রতিটা জাতিই সচেতন, তবে মায়ের ভাষাকে ভালোবেসে, তার অধিকার রক্ষার্থে নিজের জীবন উৎসর্গ করা, বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দেওয়ার মতো দৃষ্টান্ত ইতিহাসে বিরল। এমনি এক অকুতোভয় জাতি বাঙালী জাতি। যারা মাতৃভাষার অধিকার রক্ষার্থে নিজের জীবন বিলিয়ে দিতে এতটুকু কুণ্ঠাবোধ করেনি।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান ও ভারত বিভক্ত হওয়ার পর বাংলাদেশ নামের এই ভুখ-টি পাকিস্তানের অন্তর্ভূক্ত হয়। তখন এই অংশটি পূর্ব পাকিস্তান নামে পরিচিতি লাভ করে। দেশ বিভক্তের পর থেকেই পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বাঙালী জাতির উপর বিভিন্ন ভাবে নির্যাতন ও শোষন করতে থাকে। কেড়ে নিতে চায় বাঙালী জাতির ইতিহাস, ঐতিহ্য ও স্বাধীনতা। নস্যাৎ করে দিতে চায় বাঙালীর সংস্কৃতি ও ভাষা।
১৯৪৮ সালের ১৯ মার্চ পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকায় আসেন। ২১ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে অনুষ্ঠিত জনসভায় তিনি দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে ঘোষণা করেন, “উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা।” ২৪ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সমাবর্তনেও তিনি অনুরুপ ঘোষণা দিলে ছাত্র সমাজ প্রতিবাদমূখর হয়ে ওঠে এবং ‘না’ ‘না’ বলে প্রতিবাদ জানায়। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার অল্প কয়েক মাসের মধ্যেই পূর্ব বাংলায় ভাষাকেন্দ্রিক যে আন্দোলন শুরু হয় তা ছিল বাঙালী জাতীয়তাবাদের প্রতি আস্থার বহিঃপ্রকাশ। এতে বোঝা যায় এই ভুখন্ডে বসবাসকারী ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীগুলো রাষ্ট্রভাষা উর্দু নয়, বাংলাকেই সমর্থন করে।
১৯৫২ সালের ২৬ জানুয়ারী ঢাকার পল্টন ময়দানে অনুষ্ঠিত জনসভায় পাকিস্তানের নতুন প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিম উদ্দিন জিন্নাহকে অনুকরন করে উর্দুকে পাকিস্থানের রাষ্ট্রভাষা করার নতুন ঘোষনা প্রদান করেন। এর প্রতিবাদে ছাত্র সমাজ ৩০ জানুয়ারী ধর্মঘট পালন করে। ৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ছাত্র ধর্মঘট পালিত হয়।
কারাবন্দি শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকা মেডিকেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থায় ২১ ফেব্রুয়ারির কর্মসূচি পালনে ছাত্র ও আওয়ামী মুসলিম লীগের নেতাকর্মীদের ডেকে পরামর্শ দেন। তার পরামর্শ অনুযায়ী ২১ ফেব্রুয়ারি দেশব্যাপী সাধারণ ধর্মঘট এবং ঐদিন রাষ্ট্রভাষা দিবস পালন করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় । এছাড়া ভাষার দাবি প্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার সংকল্প ঘোষনা করা হয়।
পাকিস্থানি শাসকগোষ্ঠী বাঙালী জাতিকে দমিয়ে রাখার জন্য ২১ ফেব্রুয়ারি থেকে ১৪৪ ধারা জারিসহ সভা-সমাবেশ, মিছিল একমাসের জন্য নিষিদ্ধ ঘোষনা করে। ভাষা আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ ১৪৪ ধারা ভঙ্গের সিদ্ধান্ত নেয়। ২১ ফেব্রুয়ারি সকাল ১১ টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় এক সভা অনুষ্ঠিত হওয়ার পর মিছিল বের হয়। ঢাকা মেডিকেল কলেজের সামনে পুলিশ মিছিলে লাঠিচার্জ ও কাদুনে গ্যাস নিক্ষেপ করতে শুরু করে। এক পর্যায়ে পুলিশ গুলিবর্ষণ করলে আবুল বরকত, জব্বার, রফিক ও সালামসহ অনেকেই শহীদ হন। এছাড়া আহত হন অনেকেই। এই খবর সারাদেশে ছড়িয়ে পড়লে বাঙালী জাতি ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে এবং মিছিল, মিটিং ও সমাবেশসহ বিভিন্ন কর্মসূচি করতে থাকে। ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে চট্টগ্রামের কবি মাহবুবুল আলম “কাঁদতে আসিনি, ফাসির দাবি নিয়ে এসেছি ” শীর্ষক কবিতা রচনা করেন । তরুণ কবি আলাউদ্দিন আল আজাদ এই প্রতিবাদে “স্মৃতির মিনার” কবিতা রচনা করেন। আব্দুল গাফফার চৌধুরী রচনা করেন “ আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি।”
এভাবে ভাষা আন্দোলন চারদিকে ছড়িয়ে পড়লে পাকিস্থান সরকার বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয়। ১৯৫৬ সালে পাকিস্থানের সংবিধানে বাংলা ভাষাকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। নিজের ইতিহাস, ঐতিহ্য, ভাষা ও সংস্কৃতি নিয়ে পূর্ব পাস্থিানের বাঙালী ও অন্যান্য জাতিগোষ্ঠী মাথা উঁচু করে দাড়ানোর সাহস ও আত্বপ্রত্যয় খুঁজে পায়।
বাঙালীর জাতীয়তাবাদের ক্ষেত্রে রয়েছে ২১শের অনুপ্রেরনা। কেননা, বাঙালীর জাতীয়তাবাদ বিকাশে ভাষা আন্দোলন সকলকে ঐক্যবদ্ধ করে। নিজস্ব জাতিসত্ত্বা, ভাষা ও সংস্কৃতির সম্পর্ক এবং গুরুত্ব পূর্ব বাংলার মানুষের কাছে অধিকতর স্পষ্ট হয়ে ওঠে। বাঙালী হিসেবে নিজেদের আত্বপরিচয়ের রাজনীতি, অর্থনীতি, শিক্ষা, সাংস্কতি গড়ে তোলার গুরুত্ব উপলব্ধি করতে থাকে। ভাষাকেন্দ্রিক এই ঐক্যই জাতীয়তাবাদের মুল ভিত্তি রচনা করে, যা পরবর্তী সময়ে স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্টের প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।#
আসিফ হাসান বিজয়। প্রথম বর্ষ । গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়