সে কেমন প্রেম আমার

পরিবারের অমতে আমরা যখন প্রেমটি আর চালিয়ে নিতে পারছিলাম না, ক্রমশ অলিখিত এক দূরত্বের দিকে হাঁটছিলাম দু’জন। আসলেই কি দূরত্বের দিকে হাঁটছিলাম ? কলেজের প্রাকটিক্যাল ক্লাসে ব্যাঙ কাটবার সময়টাতে প্রচণ্ড বুকে ব্যথা নিয়ে হাসপাতালে ডাক্তারের শরণাপন্ন হলে গ্যাসটিকের ওষুধ দিয়েই ডাক্তার নিশ্চিন্ত। সে ওষুধে ব্যথা সেরেছিলো কিনা তা আজ আর মনে করতে পারছিনা। তবে বুকের গহিনে অদ্ভুত এক “কোথাও কেউ নেই” টাইপের শূন্যতা বিরাজ করছিলো।

Post MIddle

এরই মাঝে সময় গড়ায় বেশ। ততদিনে আমি আমার মফঃস্বলের কলেজ শেষ করে ঢাকায় পড়ছি। সেও বুয়েটে পড়া শেষে সবে চাকুরীতে যোগ দিয়েছে। এক খাঁখাঁ রৌদ্রের দুপুরে কলেজের কয়েনবক্সের সামনে দাঁড়িয়ে থাকলাম দীর্ঘ লাইনে। নাম্বারটি সেই কবে দিয়েছে ! অথচ ফোন করা হয়নি কখনো। খানিক সংকোচে নাম্বার ডায়াল করলাম,
“আমাদের কি দেখা হতে পারে ?”
“হ্যাঁ কালই এবং হয়তোবা এটিই শেষবার ” (অন্যপ্রান্তে অস্থিরতা)
শেষবার ! কথাটি কেমন ভারি আর বিষণ্ণ শোনালো।

দেখা হল যেন অনেক কাল, মহাকাল পর ! সে অন্য এক মানুষ ! ঠিক দেবদাসও বলা যায় না। আবার ব্যাখ্যা করার মতন কোন শব্দও আপাতত মনে আসছে না। বলল,
~ স্কলারশিপ নিয়ে বাইরে চলে যাচ্ছি, এবং কালই ফ্লাইট।
— কালই ? কোথায় ?
~ জাপান, সাইতামা ইউনিভার্সিটি ।
এরপর আমরা কেউই আর কোন কথা বলিনি। আমরা একে অপরের মন পড়তে পারি। সেই মুহূর্তে আমরা পৃথিবীর সমস্ত কিছু থেকে একলা হয়ে যাই। ভীষণ এক নৈঃশব্দ্যে ছেয়ে থাকে বিশাল পাঁচতলা বাড়িটি।

সে চলে যাবার পর বাড়ির অন্য সদস্যদের কাছ হতে অবিরত অশ্রুজল লুকাতে বাথরুমে দরজা বন্ধ করে দাঁড়িয়ে থাকি। একসময় মুখে পানির ঝাপটা দিয়ে চোখ মেলি। বেসিনভর্তি পানি ঘুরতে ঘুরতে আবর্তনের মাধ্যমে নিচে তলিয়ে যায়। আয়নায় বিষন্ন এক “একলা আমি”কে দেখি। পরদিন ঢাকার আকাশ ছিল গাঢ় নীল। খণ্ডখণ্ড মেঘ ছিল কোথাও কোথাও। সেই আকাশ দিয়ে উড়ে যাওয়া প্রতিটি উড়োজাহাজের দিকে আমি মাথা তুলে তাকিয়েছিলাম বুকচেরা দীর্ঘশ্বাসে। ভূগোল ক্লাসে ম্যাডাম যখন নায়াগ্রা জলপ্রপাত পড়ায়, আমি তখন বিশ্ব মানচিত্র দেখি। জাপান খুঁজি। সাইতামা ইউনিভার্সিটি খুঁজি।

নিস্তব্দতার, নৈঃশব্দ্যের আজ তেইশ বছর।
জীবন কেবলই এক ছোট গল্প, তাই নয় কি ?

হাসান আজিজুল হক এর ভাষায় বলি মানুষ খানিকটা অতীতে বাঁচে,খানিকটা ভবিষ্যতে বাঁচে। এই দু’ধরনের বাঁচাই একরকম স্বপ্নের মধ্যে বাঁচা, খানিকটা আত্নরক্ষার মতো।

সবাইকে ভালোবাসা দিবসের শুভেচ্ছা…

রিমি রুম্মান
নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র

পছন্দের আরো পোস্ট